ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিরচেনা সেই হৈ হৈ রৈ রৈ নেই

প্রকাশিত: ২২:২৪, ১ জুন ২০২০

চিরচেনা সেই হৈ হৈ রৈ রৈ নেই

মোরসালিন মিজান ॥ শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা। কতভাবে যে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। তবে শুরুটা বলা চলে এসএসসি দিয়ে। দীর্ঘ স্কুল জীবনে কী শেখা হলো তা এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য এটি তাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আশার কথা যে, অন্যান্যবারের মতো এবারও সিংহভাগ শিক্ষার্থী চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছে। যারপর নাই খুশি তারা। তবে স্কুল বন্ধ। শূন্য ক্যাম্পাস। চিরচেনা সেই হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার এবার আর দেখা গেল না। ঘরে বসে যে যার মতো করে উদ্যাপন করল শিক্ষার্থীরা। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। তারপর থেকেই ফলের জন্য অপেক্ষা। এরই মধ্যে বদলে যেতে থাকে বিশ্ব পরিস্থিতি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘরে ঢুকতে থাকে মানুষ। বাংলাদেশেও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু। এ অবস্থায় ফল কবে বের হবে তা নিয়ে সংশয় সন্দেহ দেখা দেয়। শেষতক রবিবার প্রকাশিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল। এদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ফেসবুক লাইভে এসে ফলাফলের নানা দিক তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। আনন্দের সঙ্গে তিনি জানান, পাসের হার এবং ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তিতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্যবারের চেয়ে এগিয়ে আছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন। পাসের হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট। পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৩০ হাজার ৩০৪ জন। মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন পরীক্ষার্থী। গতবারের চেয়ে এবার ৩০ হাজার ৩০৪ জন বেশি পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ এই সূচক অর্জন করেছে। তার মানে আনন্দটাও এবার বেশি। বেশি বটে। প্রকাশের তেমন সুযোগ ছিল না। অন্যান্য বছর এমন দিনে রাজধানীর স্কুলগুলো দারুণ উৎসবে মাতে। সকাল হতে না হতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় সমবেত হয় ফল প্রত্যাশীরা। তারপর হাসিরাশি আনন্দ। দল বেঁধে নাচ গান। বাদ্য বাজনা। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা। ফড়িংয়ের মতো লাফানো। আরও কত কী! শিক্ষক অভিভাকদেরও উৎসবে যোগ দিতে দেখা যায়। হায়! এবার তার কিছুই হলো না। নামকরা স্কুলগুলো ছিল বন্ধ। ফল প্রকাশ উপলক্ষে কোনটির গেট খোলা হয়েছিল। কোনটির বন্ধ। দুপুরে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায় সুনসান নীরবতা। বিশাল ক্যাম্পাসে সবুজ বৃক্ষারাজী ছাড়া আর কিছু তেমন চোখে পড়লো না। যেন শূন্য ফাঁকা মাঠ। সেই ইউনিফর্ম পরা দুরন্ত মেয়েগুলোর দেখা পাওয়া গেল না। শিক্ষকরাও অনুপস্থিত। নোটিস বোর্ডে একটি শুকনো নোটিস সেঁটে রাখা হয়েছিল। সেটি দেখেই কেবল বোঝা যাচ্ছিল এসএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। অভিন্ন দৃশ্য ছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানেও ফল প্রকাশ উপলক্ষে সমবেত হয়নি কেউ। স্কুলের মূল গেট বন্ধই ছিল। ভবনের আশপাশের রাস্তায় ইউনিফর্ম পরা ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় লেগে থাকার কথা এদিন। কিছুই চোখে পড়ল না। হলো না উদ্যাপন। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের ফল যথারীতি ভাল। উদ্যাপনটাও বেশ ঘটা করে হওয়ার কথা ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সবের কিছুই এবার হয়নি। ড্রাম পেটানো, লম্ফঝম্ফ, সেলফি তোলা সবই অতীত হয়ে গিয়েছিল এদিন। একই কারণে ফল প্রকাশের দিন দেখা যায়নি কোন শিক্ষক কিংবা অভিভাবককে। ভাল ফল করায় প্রিয় সন্তানের গালে চুমু খাচ্ছে মা। আবেগঘন এই দৃশ্য প্রতি বছর কোন না কোন স্কুলে দেখা যায়। এবার বের হননি বাবা মায়েরাও। তবে হাসি-আনন্দের এত বড় উপলক্ষ বলে কথা। একেবারে মাঠে মারা যেতে পারে না। আর তাই ঘরে বসে সীমিত আকারে উদ্যাপন করেছেন অনেকে। সকালের পর থেকেই মোবাইল ফোনে বা কম্পিউটারে ডুবে ছিলেন ফল প্রত্যাশীরা। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে প্রাক নিবন্ধন সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। ফিরতি খুদে বার্তায় ফল জানিয়ে দেয়া হয় তাদের। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে ফল খুঁজে নেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। এরপর থেকেই উদ্যাপন শুরু। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেউ কেউ আগেভাগে অনলাইনে মিষ্টির অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন। যথাসময়ে তাদের বাসায় মিষ্টি পৌঁছে গেছে। তবে একটু দেরি করে যারা অর্ডার দিয়েছেন তারা আর পাননি। এসএসসির ফলের কথা ভেবে বাড়তি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন দোকানীরা। এরপরও চাহিদা বেশি হওয়ায় তারা পেরে ওঠেননি বলে জানা যায়। অবশ্য এদিন থেকে সরকারী বেসরকারী অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় বহু মানুষ কাজে যোগ দেন। ফেরার পথে তাদের অনেকেই ভিড় করেন মিষ্টির দোকানে। তেজগাঁওয়ের একটি দোকানে কথা হয় আনিসুল ইসলাম নামের এক অভিভাবকের সঙ্গে। তার মেয়ে হুমায়রা হলিক্রস থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাবা তাই ভীষণ খুশি। বলছিলেন, একমাত্র কন্যা ভাল রেজাল্ট করেছে। কিন্তু করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। ক্যাম্পাসে সবাই মিলে উদ্যাপন করতে পারেনি। আনন্দ প্রকাশেরও তেমন সুযোগ নেই। তাই আপাতত মিষ্টি কিনে নিয়ে যাচ্ছি। নিজের পাড়ার দোকানে মিষ্টি পাননি। খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছেন বলে জানান তিনি। একই দোকান থেকে মিষ্টি কিনছিলেন মুকুল নামের এক তরুণ। কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমার ভাগ্নি এসএসসি পাস করেছে। তাকে একদফা মিষ্টিমুখ করিয়েছি। কিন্তু আরও দুই আত্মীয়ের বাসায় মিষ্টি পাঠাতে হবে। তাই আবার ঘর থেকে বের হতে হলো। জানা যায়, এদিন বাবা মা কৃতকার্য হওয়া সন্তানকে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন। তেমনি সন্তান মিষ্টিমুখ করিয়েছে বাবা মাকে। ছবি তোলা হয়েছে ঘন ঘন। এসব ছবি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। এর বাইরেও নানা আয়োজন ছিল বাসা বাড়িতে। সবমিলিয়ে একটু অন্যরকম গেল দিনটি। বহিঃপ্রকাশ কম হলেও আনন্দ আবেগ আর উচ্ছ্বাসের কোন কমতি ছিল না।
×