ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও লঞ্চে উপেক্ষিত

গণপরিবহন চলাচল শুরু

প্রকাশিত: ২২:০২, ১ জুন ২০২০

গণপরিবহন চলাচল শুরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দ্বার খুলল গণপরিবহনের। করোনা সঙ্কটে দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর সর্বোচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে চালু হয়েছে ট্রেন, লঞ্চ ও অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল। সরব হয়েছে পথ। আজ সোমবার থেকে ৬০ ভাগ বাড়তি ভাড়ায় আসনপ্রতি একজন যাত্রী নিয়ে শুরু হবে বাস যাত্রা। তবে রবিবার গণপরিবহন চলাচলের প্রথমদিনে ট্রেন স্বাস্থ্যবিধি মেনেচলা সন্তোষজনক হলেও নৌপথে অরাজকতা দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব একেবারেই মানা হয়নি। দাঁড় করিয়েও যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে। কর্মস্থলে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকামুখী মানুষের স্রোত অব্যাহত আছে। অফিস চালু ও যানবাহন চলার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে রাজধানী ঢাকা। কিছু কিছু সড়কে বাড়তি গাড়ির চাপে যানজট দেখা গেছে। বিআরটিসিসহ বেশকিছু বাস চলেছে নগরীতে। এছাড়া অটোরিক্সা, লেগুনা, ইজিবাইক চলেছে বাড়তি ভাড়ায়। অফিসকরা যাত্রীদের যানবাহন সঙ্কটে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশে চলেছে প্রাইভেটকার। কারণে অকারণে রাস্তায় চলাচল বেড়েছে সাধারণ মানুষের। রাস্তা, অফিস থেকে শুরু করে বাজারসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে শিথিল হয়ে আসছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার। যে যার ইচ্ছামতো চলতে দেখা গেছে। তবে অনেক দোকানপাট এখন বন্ধ রয়েছে। এ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও নগরীর মোড়ে মোড়ে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের ভিড় দেখা গেছে। যানবাহন কম থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে এই বাহন ব্যবহার করেছেন। প্রাইভেটকারও চলেছে ভাড়ায়। হাতিরঝিলে চালু হয়েছে ওয়াটার টেক্সি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ২৬ মার্চ থেকে চলা সাধারণ ছুটির মেয়াদ না বাড়িয়ে ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস খোলা রাখার পাশাপাশি গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৩ দফা নির্দেশনাও দেয়া হয়। দেশে সংক্রমণের মাত্রা যখন বাড়ছে তখন মহামারী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ও সমালোচনার মধ্যেই ‘মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে’ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করার বিকল্প নেই এমন যুক্তি তুলে ধরে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১৫ দিন গণপরিবহন চলাচল ও করোনায় সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন একাধিক মন্ত্রী। তবে মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর গণপরিবহন চলতে সড়কপথে ১৩টি, নৌযান ও রেলে ১৪টি ও বিমানে ১০টি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেয়। যদিও এসব নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তাই এখন দেখার বিষয়। মালিক ও শ্রমিক নেতারাও এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক করার ঘোষণা সঙ্কটের মাত্রা আরও বাড়াতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরাও। ঝুঁকি নিয়ে নৌপথে যাত্রা ॥ গণপরিবহন চলার খবরে ফের সরব হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের কেন্দ্রস্থল রাজধানীর সদরঘাট। ভোর থেকে ঢাকা নদী বন্দরে বিভিন্ন গন্তব্যের মানুষের ভিড় দেখা গেছে। পরিবহন লকডাউনের কারণে যারা দীর্ঘসময় আটকে ছিলেন তাদের মধ্যেই বেশি বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। তবে লঞ্চে ওঠারপথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের স্যানিটাইজার, স্যাভলন দিতে দেখা গেছে। যদিও বেশিরভাগ যাত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে এতটা যত্নবান নন। সব মিলিয়ে দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর করোনাভাইরাসের মহামারীর বিস্তারের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই নৌপথে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়েছে। সকাল পৌনে ৭টার দিকে প্রথম যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি সোনারতরী চাঁদপুরের উদ্দেশে সদরঘাট ছেড়ে যায় বলে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্ধারিত সূচী অনুযায়ী, স্বাস্থ্যবিধি মেনে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে। এমভি সোনারতরী পর একে একে এমভি গাজী এক্সপ্রেস-৪ জামাল-৪, পুবালী ও বোগদাদীয়া শরীয়তপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায় বলে তিনি জানান। সকাল ৮টায় বরিশালের উদ্দেশে সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায় গ্রীন লাইন। ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, সদরঘাটের আটটি প্রবেশপথে জীবাণুমুক্তকরণ টানেল বসানো হয়েছে; হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সব নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, লঞ্চের ডেকে কোন যাত্রী কোথায় অবস্থান করবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সদরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মোঃ পাবেল মিয়া বলেন, সদরঘাটে যাত্রী চলাচল সামনে রেখে পুলিশ সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ট্রেনযাত্রা শুরু ॥ করোনাভাইরাসের মহামারীর বিস্তারের মধ্যেই সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। রবিবার থেকে আট জোড়া ট্রেন সূচী অনুযায়ী চলাচল শুরু করেছে বলে দাবি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। মঙ্গলবার থেকে আরও ৯ জোড়া ট্রেন চলাচল করবে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। তাছাড়া ট্রেন যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক জানান, যাত্রীরা যেন নির্দিষ্ট আসনে বসতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্ল্যাটফরমে প্রবেশমুখে ও ট্রেনের কামরার সামনে যাত্রীদের স্যানিটাইজার দেয়া হচ্ছে। ট্রেনের দরজা, হাতল, আসন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের শরীরের তাপমাতওা পরীক্ষা করে ট্রেনে ওঠার অনুমতি দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যাত্রীদের সুরক্ষিত রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা ট্রেনের যাত্রীরা আসন অপরিষ্কার থাকা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার নিয়ে কিছুটা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তবে যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা গেছে। সকাল থেকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী অনলাইনে টিকেট বিক্রির মাধ্যমে ট্রেনগুলো ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল শুরু করে। প্রথমদিন চালু হওয়া আট জোড়া ট্রেনের মধ্যে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের চার জোড়া ট্রেন বনলতা এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় ও লালমনি এক্সপ্রেস- রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ বলেন, যেহেতু কাউন্টার থেকে কোন টিকেট বিক্রি হচ্ছে না তাই অতিরিক্ত যাত্রী যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। নির্ধারিত টিকেটের বাইরে কোন যাত্রী যাতে ট্রেনে উঠতে না পারে সেই বিষয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে স্টেশনগুলোতে। সকালে রাজশাহী স্টেশনে নিজে উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের চার জোড়া ট্রেনও- সোনারবাংলা, সুবর্ণ, কালনী ও উদয়ন এক্সপ্রেস চলাচল করছে বলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মোঃ মিয়া জাহান জানান। তিনি বলেন, কয়েকটি ট্রেনের কিছু টিকেট অবিক্রীত রয়ে গেছে। তবে টিকেটের বাইরে কোন যাত্রী যেতে পারবে না। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, রবিবার ৮ জোড়া ট্রেন পূর্বের শিডিউল অনুযায়ী চলেছে। ৩ জুন থেকে আরও ১১ জোড়া ট্রেন যাত্রা শুরু করবে। মোট ৩৮টি ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে। ৩ জুন থেকে তিস্তা এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, রূপসা এক্সপ্রেস, কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস, মধুমতি এক্সপ্রেস, মেঘনা এক্সপ্রেস, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চালু হবে। দায়িত্বে অবহেলা পেলেই ব্যবস্থা- নৌ প্রতিমন্ত্রী ॥ সরকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তি কিংবা লঞ্চ মালিকরা দায়িত্বে কোন শিথিলতা দেখালে কোন ছাড় দেয়া হবে না, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নৌ যোগাযোগে স্বাস্থ্যবিধির কোন ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেন চলছে ॥ রেল স্বাস্থ্যবিধি গাইড লাইন অনুযায়ী পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেন চালানো যায়। তদারকি করা হচ্ছে। সেটা অনেকটা আমরা করতে পারছি। যাত্রীদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে, যাতে তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেন ভ্রমণ করেন। রবিবার রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন। রেলমন্ত্রী বলেন, জীবন প্রত্যেকের। সবার দায়িত্ব নিজেকে সুরক্ষা রাখা। আমরা আমাদের কোন ঘাটতি থাকে, সেটা আমরা পূরণ করব। নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, সরকার ১৫ দিন দেখবে গণপরিবহন চলাচলের ফল। সেটা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, রেল পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। চুল পরিমাণও কোন ঘাটতি নেই। যাত্রীরাও নিজেদের সুরক্ষা করবেন। মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। এ সময় রেলের নবনিযুক্ত সচিব, মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক টিকেটে বিক্রির মাধ্যমে ট্রেন চালু করা হবে। যদি ট্রেন ৫০০ সিটের হলে ২৫০ সিটের টিকেট বিক্রি করা হবে। যাতে এক সিট থেকে দূরত্ব নিশ্চিত করে অন্য যাত্রী বসতে পারে। অর্ধেক যাত্রী হলেও টিকেটের দাম বাড়ছে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সরকারী সিদ্ধান্ত ছাড়া ভাড়া বাড়াতে পারি না। রেলের ভাড়া যা আছে, তাই থাকবে। বাসের ভাড়া বৃদ্ধি হলে রেলে চাপ বাড়বে। ট্রেনগুলোর সঙ্গে লাগেজ ভ্যান যুক্ত থাকবে যাতে কৃষকরা শাকসবজি ফলমূল পরিবহন করতে পারে। এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই চালু হওয়া যেসব গণপরিবহন স্বাস্থ্যবিধির শর্তগুলো মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
×