ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ খুরশীদ আলম খান

মানিলন্ডারিং অপরাধে সংঘবদ্ধ চক্র এবং হুন্ডি

প্রকাশিত: ২০:০৯, ১ জুন ২০২০

মানিলন্ডারিং অপরাধে সংঘবদ্ধ চক্র এবং হুন্ডি

মানিলন্ডারিং অপরাধে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র (Organized Crime) একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত বর্তমানে বিচারাধীন বিভিন্ন মামলায় এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তবে এর ধরন ভিন্ন ভিন্ন। এটা হতে পারে হুন্ডি চক্র, মানবপাচারকারী চক্র, হতে পারে পরিবারভিত্তিক অথবা গোষ্ঠীভিত্তিক। হুন্ডি বলতে আমরা কি বুঝি? মানিলন্ডারিংয়ে হুন্ডি বলতে অবৈধ অর্থ বৈধ করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ (Organized) আকারে অনেক সময় বৈধভাবে বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। সাধারণত এসব ব্যবসায় প্রচুর নগদ অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে হুন্ডির জন্য গৃহীত নগদ অর্থ নিজেদের বৈধ ব্যবসার সঙ্গে মিশিয়ে একে বৈধ রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সাধারণত ব্যাংকিং লেনদেনে অবৈধ অর্থের প্রচুর লেনদেন ঝুঁকিপূণ। কারণ, এক্ষেত্রে সন্দেহজনক রিপোর্টিংয়ের সম্ভাবনা থেকে যায়। এতে দালিলিক প্রমাণও রয়ে যায়। সংঘবদ্ধ অপরাধ ছাড়া হুন্ডি ব্যবসা সম্ভব নয়। একাধিক লোকের সম্পৃক্ততা ছাড়া এসব অপরাধ সংঘটন সম্ভব নয়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে হুন্ডি ব্যবসা মার্কিন যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভারতবর্ষে (বিশেষ করে চিকিৎসা এবং ভ্রমণের ক্ষেত্রে) এবং মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, দুবাই, সৌদি আরব, ওমানের সঙ্গে সর্বাধিক হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, ভারতে সাধারণত চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমণের জন্য প্রচুর অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়। আবার চোরাচালানের অর্থ প্রদানের জন্যও হুন্ডি ব্যবহার করা হয়। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ ব্যবস্থায় একটি সহজ পন্থা হলেও এর মাধ্যম অবৈধ লেনদেনের সুযোগ থাকায় মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধেরও সুযোগ থেকে যায়। এথেকে পরিত্রানের উপায় কি? প্রথম উপায় হলো অস্বাভাবিক লেনদেন রোধ করা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা পরিচালিত কোন হিসাব যদি পূর্ব ঘোষিত লেনদেনের অনুমিত মাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিহীন কোন লেনদেন হয় বা গ্রাহকের আর্থিক সম্পদের সঙ্গে প্রাপ্ত কোন তথ্য অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়, তাহলে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করে সঙ্গে সঙ্গে দুদক এবং বিএফআইইউকে অবহিত করে ত্বরিত আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক-এর নির্দেশনা অনুযায়ী অস্বাভাবিক লেনদেন শনাক্তকরণ ও পরিপালন করার নিমিত্তে প্রত্যেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে গ্রাহকের হিসাবের সম্ভাব্য লেনদেনের অনুমিত মাত্রা (Transaction Profile) সম্পর্কে গ্রাহকের ঘোষণা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রয়োজনবোধে গ্রহাকের সম্ভাব্য লেনদেনের নির্দিষ্ট সময় পর পর হালনাগাদ করতে হয়। ঘোষিত লেনদেনের মাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিহীন লেনদেন সাধারণভাবে অস্বাভাবিক বলে বিবেচ্য হবে, যদি গ্রাহকের কাছে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া না যায়। সাধারণত হুন্ডির টাকা লেনদেন ও পরিবহন বেআইনী। এতে সংশ্লিষ্ট প্রবাসীরা কর (Tax) রেয়াত থেকে বঞ্চিত হন। টাকা পরিবহনের পথে ছিনতাইয়ের শিকার হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থানায় অভিযোগ দেন না। অবৈধ পথে আসা এসব টাকা মাদক ও অবৈধ অস্ত্র খাতে বিনিয়োগের আশঙ্কা থাকে। হুন্ডির টাকা ছিনতাইকারীকে ঘটনার শিকার হওয়ায় তারা থানায় অভিযোগ দিতে যান না। হুন্ডি ব্যবহারের কারণগুলো হচ্ছে : গ্রাহকের হাতে হাতে হুন্ডির টাকা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা থাকে; প্রত্যন্ত অঞ্চলে হুন্ডির টাকা প্রেরণ করা যায় সহজেই; অতি দ্রুত হুন্ডির টাকা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় কম খরচে; জাতীয় পরিচয় পত্র বা কোন প্রকার দালিলিক প্রমাণের প্রয়োজন হয় না; সর্বোপরি অধিক হারে এক্সচেঞ্জ রেট পাওয়া যায়। বিকল্প অর্থ প্রেরণ পদ্ধতি হলো অর্থ বা মূল্য বিশ্বের এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তরের অপ্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সাধারণত নগদ অর্থ স্থানান্তর করা হয় না। বরং বিদেশের এজেন্টকে যে কোন পদ্ধতির সাঙ্কেতিক ভাষার মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের নির্দেশ প্রদান করা হয়। বিকল্প অর্থ প্রেরণ ব্যবস্থা বা হুন্ডির উৎপত্তি পশ্চিমা ব্যাংকিং ব্যবস্থার উদ্ভবের বহু পূর্বে খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০০ সালে এ ধরনের ব্যবস্থার প্রচলন ছিল এবং এর উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশেই। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ ধরনের বিকল্প অর্থ প্রেরণ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। বিভিন্ন দেশে এ ধরনের পদ্ধতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে এ ব্যবস্থার নাম ‘হাওয়ালা’, বাংলাদেশ ও ভারতে ‘হুন্ডি’, চীনে ‘ফেই চিয়েন’, থাইল্যান্ডে ‘ফু কুয়ান’ এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ‘ব্লাক মার্কেট পেসো এক্সচেঞ্জ’। ‘হুন্ডি’ অর্থ প্রেরণ ব্যবস্থায় একটি সহজ পন্থা হলেও এর মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনের সুযোগ থাকায় মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের মতো অপরাধ এই ব্যবস্থা ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত করে থাকে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে কালো টাকার প্রভাব বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে বিকল্প অর্থ ব্যবস্থা হিসেবে হুন্ডিকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলেও পুরোপুরি সফলতা এখনও অর্জিত হয়নি। ‘হুন্ডি’ প্রতিরোধের সুফল পেতে হলে ব্যাংকিং সেক্টরের সেবাকে আরও গতিশীল করতে হবে। অর্থাৎ, অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত সেবা প্রদান, কম সার্ভিস চার্জ আদায় এবং অধিক হারে এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে বেশি উৎসাহিত হবে এবং এর প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর। এ ছাড়াও ব্যাংকগুলোকে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, কেউ যেন এ ধরনের লেনদেনে কোন ব্যাংক হিসাবের সহায়তা নিতে না পারে সে ব্যাপারে সর্তক হতে হবে। সম্প্রতি লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদাহ শহরে ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জন অভিবাসীকে খুন করেছে মানবপাচারকারী চক্র। খবরে প্রকাশ স্থানীয় এক মানব পাচারকারীর হত্যার বদলা নিতে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে নৃশংস এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলীতে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে মাবনপাচারকারী পরিবারের হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশীর কাছ থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন পনেরো আগে ৩৮ জন বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক বেনগাজী হয়ে ত্রিপোলী আসছিলেন। পথে তাঁদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা দাবি করেন মূল মানবপাচারকারী। টাকা না দিলে ছাড়া হবে না- এ কথা বলে তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশী ও আফ্রিকান অভিবাসীরা ওই মানব পাচারকারীকে খুন করেন। এর জের ধরে তাদের ওপর নির্বিকারে গুলি চালায় সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র মানবপাচারকারী দল। এই মর্মান্তিক ঘটনা সময়ের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে যে, মানিলন্ডারিং অপরাধে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যারা টাকার জন্য অভিবাসীদের জিম্মি করে রেখেছিল। পুরো ঘটনাটি পাচার সংক্রান্ত। লিবিয়ার মিজদাহ শহরে ২৬ বাংলাদেশীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের খবর আমাদের প্রচলিত আইনের মানিলন্ডারিংয়ের সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের প্রতারণা ও জালজালিয়াতির বিচারের কার্যকারিতাকে জ¦লন্ত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। লিবিয়ার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুদক এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে গুরত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা উচিত, বিশেষ করে মানিলন্ডারিংয়ে মানব পাচারকারী চক্রের ভূমিকা। বিষয়টি অতীব মর্মস্পর্শী। এ ছাড়াও ভেবে দেখতে হবে লিবিয়া কি বালাদেশের অভিবাসীদের ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে? লেখক : এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, সম্পাদক, ঢাকা ল’ রিপোর্টস (ডিএলআর)
×