ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খাদিজা খানম ঊর্মি

শিক্ষার্থীদের কোয়ারেন্টাইনের দিনলিপি

প্রকাশিত: ০১:১২, ৩১ মে ২০২০

শিক্ষার্থীদের কোয়ারেন্টাইনের দিনলিপি

ব্যস্ত দিন কাটে ল্যাব কিংবা ক্লাসে। নতুন নতুন শিটের বোঝা আর সেমিস্টার ফাইনালের টেনশনে মগজ ভারি প্রতিনিয়ত। কারও বা নানা ধরনের সামাজিক অথবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজে সময় কাটে। আবার কেউ রেজাল্ট বাড়াতে একাডেমিক পড়াশোনা আর শীট, নোট তৈরি করাতেই ব্যস্ত। ক্যাম্পাস জীবনের স্বাভাবিক চিত্র এমনটাই। এভাবেই স্বাভাবিক জীবন কাটাতে অভ্যস্ত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। নানা উচ্চাশায় মোড়ানো স্বপ্ন ছুঁতে শতশত ভাবনায় ঘেরা যাদের মন। বহু পরিকল্পনা করেও শিক্ষার্থীরা সময় খুঁজে পান না নিজের মতো করে কাটাতে। ক্যাম্পাসে নানা ব্যস্ততার মাঝে সময় পার হয়ে যায়। কিন্তু কোভিড-১৯ ভাইরাসটি যেন শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়ে এসেছে অপূরণীয় অবসর সময়। সংক্রমণের শুরু থেকেই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে সকলেই নিজ বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন। কিভাবে কাটছে শিক্ষাজীবনের বৈসাদৃশ্য এ সময়। অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রহিম বলেন, করোনাভাইরাসে স্থবির হয়ে পড়ছে পুরো বিশ্ব। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা। ফলে চরম উৎকন্ঠায় কাটছে প্রতিটি মুহূর্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মনে হয় না কখনও মানুষ এতো বেশি আতঙ্কে ছিল। কিছুক্ষণ পরপরই টেলিভিশন এবং ফেসবুকে চোখ রাখি প্রিয় মাতৃভূমি এবং বিশ্বের খবর জানতে। করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সকলের হতাশা, বিষণœতা ও অনিশ্চয়তা। আমাদের পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস বড় ভাই প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটাতে কয়েক মাস আগে সৌদি থেকে ছুটিতে এসে আর যেতে পারছেন না। ফলে দুশ্চিন্তা প্রতিদিনই বাড়ছে। এইদিকে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় মিস করছি প্রিয় সহপাঠীদের। শুধু তাই নয় ক্যাম্পাস বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেছে ক্যারিয়ার গড়ার লড়াইও। অনলাইনে স্কীল ডেভেলপমেন্ট, লেখালেখি, ঘুম, নামাজ, লুডু, ক্যারাম খেলার মধ্যেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি কখন সুস্থ হবে এই পৃথিবী! কখন আবার পূর্বদিগন্তে নতুন সূর্য উদিত হবে! অনুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান সবুজ বলেন, করোনায় বদলে গেছে আমাদের জীবন। এটি আমাদের যান্ত্রিক জীবনে বিশাল এক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতার সুবাদে সংবাদের পিছনে ছুটতে ছুটতেই কাটত কর্মব্যস্ত দিনগুলি। করোনার কারণে সেই ব্যস্ততা এখন আর নাই। সবার মতো আমিও বাড়িতেই সময় কাটাচ্ছি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এতটা সময় বাড়িতে থাকা হয়নি কখনও। পরিবারের সবার সঙ্গে সময় কাটাতে না পারার যে আক্ষেপ ছিল সেটাও হয়ত কিছুটা পূরণ হচ্ছে এই মহামারীর সময়ে! বাড়িতে থাকলেও চেষ্টা করছি ইতিবাচকভাবে সময়টা কাজে লাগাতে। বেশ কিছু অনলাইন কোর্সে অংশ নিচ্ছি। করোনার এই সময়টাতে বেশকিছু বই পড়ে শেষ করেছি যেগুলো নানা কারণেই আগে পড়া হয়ে উঠেনি। ইউটিউব থেকে মুভি দেখেও সময় কাটছে। বাড়িতে থাকলেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও বন্ধুদের সঙ্গে। করোনার এই সময়টাতে দেশ এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে প্রাণের নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের যেকোন খবর দেশবাসীর কাছে বাসা থেকেই পৌঁছে দিচ্ছি আমরা ক্যাম্পাস সাংবাদিকেরা। এসব মিলিয়েই কেটে যাচ্ছে সময়। ইনফরমেশন সায়েন্স এ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিহা তাসমিম বলেন, ঈদ-পূজা কিংবা ছুটি পেয়ে বাড়ি বেড়াতে আসা আর এবারের এই করোনায় ছুটি পেয়ে বাড়ি আসার বিষয়টি একেবারেই আলাদা। হল ছেড়ে আসার সময় কারোর মনে হৈ-হুল্লোড় কিংবা আনন্দ ছিল না। রোজ সকালে ক্লাস, ডিপার্টমেন্টে কারণে অকারণে ঘোরাঘুরি, ক্লাসের ফাঁকে টং বসে নাস্তা করা, মামার চায়ের দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়া, গল্প স্টাডি আর দিনশেষে বঙ্গমাতা হলে ফিরে আসা এভাবেই কাটত ক্যাম্পাসে প্রতিটি দিন। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সব কিছু বদলে দিয়েছে। ঘরে বসে বই পড়ে, টিভিতে নিউজ দেখে, বাসার বাগানের পরিচর্যা করে, মুভি দেখে, রান্না শিখে সময় কাটানো হয়। দেশের এই ক্রান্তিকালে বাসায় থাকাটা নিজের জন্য এবং সবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাটাই উত্তম। সকলে সচেতন থাকুন, নিরাপদ থাকুন, সুস্থ থাকুন সেই কামনা করি। আর অবশ্যই সবাই বাসায় থাকার চেষ্টা করুন। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতিয়া জাহিন রাইদাহ বলেন, গোটা বিশ্ব আজ স্থবিরতায় বিরাজমান শুধু একটি ভাইরাসের ভয়াবহতায়। প্রাত্যহিক জীবনের চিরচেনা আনাগোনা থমকে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের স্বার্থেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে অবস্থান করতে হচ্ছে সবাইকে। প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যস্ততা, নিয়ম নীতিমালা, পছন্দ অপছন্দের কর্মকা-ের প্রতি অভিযোগ জানান দেয় নিজেকে সময় দেয়ার প্রয়োজনীয়তা। একান্তই নিজেকে জানার ও পরিবার পরিজনদের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা তৈরিতে এর চেয়ে উত্তম সময় হয় বোধকরি কেউ পায়নি। যদিও ক্যাম্পাসের ব্যস্ততা, প্রিয় শিক্ষক দের ক্লাস, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো মস্তিষ্কে শূন্যতা সৃষ্টি করে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতায় বলতে গেলে এ সময়টাতে বই পড়া, বিভিন্ন স্কীল ডেভেলপমেন্ট করা ও পরিবারের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোয় এ করোনা যুদ্ধ তুলনামূলক সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া নোবিপ্রবির শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সহায়তায় আমাদের শিক্ষা সঙ্কট দূর করতে ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে ইতোমধ্যেই কোর্সেরার মতো প্ল্যাটফর্ম স্পন্সর করেছে। তাছাড়া নোবিপ্রবি ডিবেটিং সোসাইটিও বিভিন্ন অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানশাণিত করার সুযোগ তৈরি করছে প্রতিনিয়ত, যা মূলত কোয়ারেন্টাইন অভিজ্ঞতাকে বিষাদ ঠেকাতে কার্যকর। বাংলাদেশ এ্যান্ড লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল কবীর ফারহান বলেন, কোভিড-১৯ এর তা-বে পৃথিবী আজ অসহায়। এর আতঙ্ক সকলের জীবনে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ক্লাস-পরীক্ষা, এসাইনমেন্টের পাশাপাশি এক সংবাদকর্মী হিসেবে সংবাদ সংগ্রহ এবং প্রকাশ নিয়ে ক্যাম্পাসে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। কিন্তু নোভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হঠাৎ ধারাবাহিক সব ব্যস্ততা দূর করে দেয়। ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পর থেকেই নিজ বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছি। কিছুটা আতঙ্কিত হলেও এটি নিজেকে পরিপূর্ণ করার উত্তম সময় বলে মনে করছি। তাই নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় দেয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করে তা প্রকাশের পাশাপাশি স্কীল ডেভেলপমেন্টে সময় পার করার চেষ্টা করছি। সংগ্রহে থাকা কিছু বই যা এতদিন ব্যস্ততার কারণে পড়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি সেগুলো পড়ে শেষ করছি। এই ভাইরাস মোকাবেলার একমাত্র মাধ্যম সচেতনতা অবলম্বন। তাই সবাই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার চেষ্টা করি।
×