অপূর্ব কুমার ॥ আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে ঘোষণা করা হবে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট। ঘোষণা করতে যাওয়া বাজেটে (২০২০-২১ অর্থবছরে) পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য থাকছে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ। চলতি বছরের শুরুর পর থেকে চলা দরপতনে অস্থিতিশীল পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ঘোষণা করতে যাওয়া এই বাজেটকে কেন্দ্র করেই ১১ দফা প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। করোনা দুর্যোগ থেকে দেশের শেয়ারবাজারকে টেনে তুলতে ডিএসই চায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করহার কমানো, নতুন তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে তিন বছরের করছাড়সহ মোট ১১টি সুবিধা।
দীর্ঘ নয় বছর পর ড. খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন সিকিউটিরিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্ব শেষ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে সাজানো হয়েছে নতুন কমিশন। মূলত নতুন এই কমিশনকে ঘিরেই বিনিয়োগকারীদের মাঝে আশার সঞ্চার হচ্ছে। এছাড়া দুই মাসের বেশি বিরতির পর নতুন লেনদেন শুরুও আশা জাগাচ্ছে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে লেনদেন খরায় ভুগতে থাকা বন্ড মার্কেটকে চাঙ্গা করতেও বাজেটে প্রণোদনা থাকছে। বন্ড তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের খরচ কমানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বন্ড ছাড়লে নিবন্ধন ফিসহ যাবতীয় খরচ কমানো হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নামমাত্র খরচে বন্ড তালিকাভুক্ত করা যাবে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একটি করপোরেট বন্ড আছে। এটি ইসলামী ব্যাংকের আইবিবিএল মুদারাবা বন্ড। এটিই শুধু লেনদেন হয়। এ ছাড়া ২২১টি ট্রেজারি বন্ড আছে। এই বন্ডগুলো লেনদেন হয় না। বন্ডগুলোকে লেনদেনযোগ্য করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ এ প্রণোদনায় থাকছে: করপোরেট কর হার কমানোর উদ্যোগ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমানোর উদ্যোগ এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) আরও শক্তিশালী করা। আইসিবিকে বড় অঙ্কের এটি ফান্ডের অর্থ জোগান দেয়া। অর্থমন্ত্রী এই প্রস্তাবগুলোকে বাজেটে রাখতে আশ্বাস দিয়েছেন। এছাড়া পুঁজিবাজারের উন্নয়নে আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য বিদ্যমান কর হার কমানো ও লভ্যাংশে কর মওকুফের সীমা বৃদ্ধিসহ ১১ দফা প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এ বাজেট প্রস্তাব জমা দেয়া হয়। ডিএসই থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমানোর প্রস্তাব করেছে ডিএসই। কর হার ২৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (মার্চেন্ট ব্যাংক ছাড়া) কর হার ৩৭.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩২.৫০ শতাংশ করা, নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথম ৩ বছর কর হার সুবিধা ১০ শতাংশ থেকে বাড়ানো ও নতুন বন্ডের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম ৩ বছর ১০ শতাংশ হারে কর সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আসন্ন ২০২০-২০২১ বাজেট উপলক্ষে লভ্যাংশে কর মওকুফের সীমা ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া যেসব লভ্যাংশের ক্ষেত্রে দুইবার অগ্রিম কর (এআইটি) নেয়া হয়, সেখান থেকে অব্যাহতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জের কর মওকুফ সুবিধা ১০ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের কাছ থেকে অগ্রিম কর হার (এআইটি) ০.০৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.০১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে ডিএসই।
এ ছাড়া আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ, মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ, লভ্যাংশ আয়ের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ, সরকারীভাবে শেয়ার ক্রয়ে প্রণোদনাসহ ১৬টি বাজেট প্রস্তাব জানিয়েছে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এসব প্রস্তাব জানানো হয়েছে।
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে মহামারী করোনাভাইরাসজনিত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ন্যূনতম আগামী পাঁচ বছরের জন্য আসন্ন জাতীয় বাজেটে নিঃস্বার্থভাবে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া। চলমান করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি পূরণের জন্য মার্জিন এ্যাকাউন্টের সুদ চলতি বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মওকুফের সুযোগ দেয়।
এছাড়া চলতি বছরের বিও এ্যাকাউন্টের চার্জ মওকুফ করতে হবে। আর আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত মার্জিন এ্যাকাউন্টের সুদ সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নির্ধারণ। ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সব প্রকার লভ্যাংশ আয়ের ওপর সব ধরনের ভ্যাট, ট্যাক্স মওকুফ ও অতি দ্রুত বাইব্যাক কোম্পানি আইন বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়ছে।
ডিএসইর এক ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বর্তমানে দেশে লক্ষাধিক কোম্পানি নিবন্ধিত হলেও মধ্যম ও বৃহদায়তনের কমপক্ষে কয়েক হাজার কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার সুযোগ আছে। অথচ শুধু কয়েক শ’ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আছে, যা নগণ্য। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করতে বেসরকারী পুঁজি সঞ্চালনে প্রয়োজন।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুুঁজিবাজারের কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ প্রয়োজন। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে সমন্বয়ের কথা বলছেন তারা। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের গুজবে কান না দিয়ে জেনে বুঝে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তারা।
বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে তাদের। এছাড়া আগামী বাজেটে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য চমক থাকবে বলেও আশ্বস্ত করেছেন তিনি। আগামীকাল সোমবারই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা জানিয়েছেন তিনি। বিএসইসির নতুন প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করেন, পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আস্থা ফিরিয়ে আনা। বাজারকে গতিশীল করতে যা যা করণীয় সবই করবে কমিশন। আগামী বাজেটও পুঁজিবাজারবান্ধব হবে বলে আশ্বাস তার।
