ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতি সচল রাখা ও সঙ্কট মোকাবেলার বিকল্প নেই সংক্রমণ রোধে সরকারী গাইডলাইন ও কঠোর তদারকির তাগিদ গণপরিবহনের জন্য ১৪ পরামর্শ

ঝুঁকির মধ্যেই পথচলা ॥ স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গী হবে করোনা

প্রকাশিত: ২১:৫২, ৩০ মে ২০২০

ঝুঁকির মধ্যেই পথচলা ॥ স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গী হবে করোনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে দুই মাসের বেশি সাধারণ ছুটি শেষে আগামীকাল রবিবার থেকে অবরুদ্ধ অবস্থা কাটিয়ে অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহনের পাশাপাশি ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু ফের সচল হচ্ছে। প্রশ্ন হলো দেশে কোভিড-১৯ সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত কতটুকু ইতিবাচক হবে। করোনা প্রতিরোধে সরকারী প্রজ্ঞাপনে ১৩ দফা গাইডলাইন দেয়া হলেও সেক্টরভিত্তিক পৃথক গাইডলাইন জরুরী বলে মনে করেন অনেকেই। সরকারের নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও করোনাকে মানিয়ে নিয়ে চলা ছাড়া সামনের দিনগুলোতে আর কোন পথ খোলা নেই। দেশের অর্থনীতি, শিল্পায়ন, উন্নয়নের গতি সচল রাখাসহ সার্বিক সঙ্কট মোকাবেলায় একমাত্র পথ হলো সেক্টরভিত্তিক লকডাউন শিথিল করা। অন্যথায় দেশে যেমন দারিদ্র্যের হার বাড়বে, তেমনি বাড়বে বেকারত্ব। বাড়বে অভাবি মানুষের সংখ্যা। দেখা দিবে খাদ্য সঙ্কট। বন্ধ হয়ে যাবে শিল্পকারখানা। বিনিয়োগের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে ফিরতে হবে স্বাভাবিক জীবনে। আর এখন স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গী হবে করোনা। এজন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তেমনি স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আলোচনা করে কর্মপদ্ধতি ঠিক করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা আরও বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী বৈশি^ক এই মহামারী শীঘ্রই থামার কোন লক্ষণ নেই। তেমনি দ্রুত সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে আলোর দেখা মিলছে না। বেঁচে থাকার জন্য সামনের দিনগুলোতে একমাত্র পথ নিজ দায়িত্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে কর্মসংস্থানে যোগ দেয়া। তেমনি সরকারী-বেসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা। গণপরিবহনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৯০ লাখ শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে প্রয়োজন তদারকি। সেইসঙ্গে বিকেল চারটার মধ্যে দোকানপাটসহ বাজার বন্ধ নিশ্চিত করতে জোর মনিটরিং করারও পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় সঙ্কটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে ফের আনুষ্ঠানিক লকডাউন বা কারফিউ জারি ছাড়া সামনে বিকল্প কিছু থাকবে না। দেশে যখন প্রায় প্রতিদিন সর্বাধিক কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হচ্ছে ঠিক তখন ঘোষণা আসে, ৩১ মে থেকে অফিস খুলবে, বাস-লঞ্চ-ট্রেন-বিমান চলবে। খুলবে পুঁজিবাজার। ব্যাংকে লেনদেন হবে আগের মতোই। দোকানপাট খোলা থাকবে বিকেল চারটা পর্যন্ত। এই ঘোষণার পরদিন শুক্রবার করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। বেশি পরীক্ষায় বেশি রোগী শনাক্তের পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। ভাইরাস সংক্রমণের দিক থেকে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে এভাবে সব খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী মনে করছেন অনেকেই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অর্থনীতি সচলের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এসব খোলা হবে। ১৫ জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে ততদিনে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অবস্থায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেননা দেশে ‘লকডাউন’ও ঠিকভাবে করা যায়নি, যে কারণে ভাইরাস এখন ৬৪ জেলায়ই ছড়িয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণ করা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত প্রথম রোগী বাংলাদেশে ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ। রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়াতে লেগেছিল প্রায় এক মাস। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এক মাসের মধ্যে ৪ মে রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, ততদিনে দোকানপাট, কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত এসেছিল। মে মাসে সর্বাধিক সংক্রমণ দেখা যায়। এর মধ্যেই ঈদযাত্রায় ছাড় দেয়া হলে তার প্রতিক্রিয়ায় এই মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, তাহলে তো ভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। বৃহস্পতিবার অফিস চালুর প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৩১ মার্চ থেকে সব সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারী অফিস নিজ ব্যবস্থাপনায় সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে। এক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত তরার জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জারি করা ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। গণপরিবহন চলার বিষয়ে আদেশে বলা হয়, সীমিত পরিসরে নির্দিষ্টসংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত বিধি নিশ্চিত করে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী নৌযান ও রেল চলাচল করতে পারে। তবে সব অবস্থায় মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জারি করা নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। চলাফেরায় বিধিনিষেধ আগের মতোই থাকছে। আগের মতোই রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। এই সময় জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। হাট-বাজার এবং দোকানপাটগুলোতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বেচাবিক্রি চলবে। সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত ও অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত বন্ধই থাকবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, মানুষের এখন প্রয়োজন সবকিছু স্বাভাবিক করার। সরকার সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে। সাধারণ ছুটি না বাড়িয়ে সব খোলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা এসেছে বিএনপি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের কাছ থেকে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একে আত্মঘাতী ‘মন্তব্য’ করে বলেন, ছুটির নামে তথাকথিত লকডাউন তুলে নেয়ার পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার কি প্রমাণ করতে চায়- করোনার থেকে তারা শক্তিশালী? জনজীবন সচল করার ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরানোর যুক্তিই দেখিয়ে আসছে সরকার। ঈদের আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ঝড়-ঝঞ্জা-মহামারী আসবে। সেগুলো মোকাবেলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে জীবন-জীবিকার মাঝে সাযুজ্য বিধানের যে প্রয়াস চলছে, তার থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। তিনি পরিবহন সেক্টরে সকলের সুরক্ষা নিশ্চিতে সমিতির নেতাদের পরিকল্পনা নেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, অর্থনৈতিক কর্মকা- মাসের পর মাস বন্ধ রেখে কোন দেশ টিকে থাকতে পারে না। উন্নত দেশগুলোতেও আস্তে আস্তে নানা কর্মকান্ড শুরু করা হয়েছে, মানুষ কাজে ফিরে গেছে। আমাদেরও ধীরে ধীরে সেই কাজটি করতে হবে। সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়ার ঘোষণাকে কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নে আইইডিসিআরের সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, এক সঙ্গে প্রায় সব খুলে দেয়া মানেই ছোঁয়াচে এই রোগ বিস্তারের সুযোগ করে দেয়া। তিনি বলেন, রোগের সংক্রমণ বাড়ছে; মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। স্কুল ছাড়া সবই তো খোলা হলো। আর বাকি কী রইল? ঢালাওভাবে ছুটি প্রত্যাহার করে দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজে যোগ দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। এটা তো আর সীমিত থাকবে না। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে না পারলে; এভাবে ঢালাওভাবে চাকরি বাঁচার কথা বলে কাজে যোগ দিলে সেই ঝুঁকিই তো থেকে গেল। ঈদের সময়কালের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ গবেষক বলেন, ঈদের আগে মানুষ বের হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে সবাই বের হচ্ছে। অর্থনীতি সচলের চাপ থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে আমরাও বিশ্বাস করি (ছুটি না বাড়ানো) এখনও সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ আছে। এখন যদি মানুষের জীবনের বড় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় কিংবা জানমালের বড় বিপর্যয় নেমে আসে কী হবে? এক্ষেত্রে ধাপে ধাপে খোলা উচিত ছিল বলে মনে করেন মুশতাক। জরুরী কিছু বিভাগ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান খোলে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করা উচিত ছিল। ধাপে ধাপে খোলার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ঝুঁকির আশঙ্কা ॥ সব কিছু খুলে দেয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করা না হলে বড় ঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও। কমিটির বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কার কথা জানিয়ে তারা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় এই যে রোগ সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে রোগের হার বাড়ার আশঙ্কা থাকে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য বিধিবিধান সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিধি প্রয়োগ ছাড়া লকডাউন শিথিলে সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা। প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই আলোচনা করে কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে ॥ এদিকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই আলোচনা করে কাজের কর্মপদ্ধতি ঠিক করা উচিত। গণপরিবহন চলবে, কিন্তু কীভাবে দূরত্ব বজায় থাকবে। প্রতিটি জায়গায় তাদেরই দায়িত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য। কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের পাশাপাশি ঘরে ঘরে গিয়ে সেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যবিভাগের প্রতি পরামর্শ দেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের নেতা ডাঃ মুশতাক। তিনি বলেন, কেইস ডিটেকশন করতে হবে; আক্রান্তদের আলাদা করতে হবে এবং তাদের সারিয়ে তুলতে হবে। শহরে কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তুলতে হবে। আরও লোকবল নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে সেবা দিয়ে এবং শনাক্ত করে সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে। সামনে কঠিন সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখনই তো রোগের সংক্রমণ শেষ হয়ে যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা- রোগের সেবা দেয়ার পাশাপাশি সংক্রমণ যেন না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে।’ এদিকে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য বিধি-বিধানগুলো সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে তা শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনা থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান বলেন, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও অর্থনীতির সুরক্ষা ও মানুষের স্বার্থে সবকিছু স্বাভাবিক করা ছাড়া কোন উপায় নেই। তাই বেঁচে থাকার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি আয়ের প্রয়োজন আছে। আয় না থাকলে জীবন যাত্রা অচল হয়ে যাবে। সঙ্গত কারণেই সবাইকে সতর্ক হয়ে সামনের দিনগুলোতে চলতে হবে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালুর পরামর্শ দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু আমি মনে করি পরিবহন শ্রমিকদের মাস্কের মতো সাধারণ সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। ফলে বিশাল এই শ্রমিক জনগোষ্ঠী যখন রাস্তায় নামতে তখন তাদের পাশাপাশি যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক পরিবহন সেক্টরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সবকিছু স্বাভাবিক করা ছাড়া সরকারের সামনে হয়ত আর কোন পথ খোলা নেই। এজন্য সেক্টর ভিত্তিক কর্মকান্ড পরিচালনায় সঠিক গাইডলাইন প্রয়োজন। তাহলেই কেমন সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। সড়কপথের ১৪ দফা স্বাস্থ্যবিধি ॥ করোনা মোকাবেলায় সড়ক পথে গণপরিবহনে বেশকিছু নির্দেশনা মানতে হবে। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের এসব কারিগরি নির্দেশনা তথ্য অধিদফতরের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে। নির্দেশনাগুলো হচ্ছে : যাত্রীবাহী পরিবহন স্টেশনে জরুরী পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, নিরাপত্তা এবং জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি মানসম্মত করতে হবে, সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোভিড-১৯ এর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে এবং মাস্ক, গ্লাভস ও জীবাণুমুক্তকরণ দ্রব্যাদির পর্যাপ্ত মজুত থাকতে হবে। কর্মীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রতিদিন কর্মীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক অবস্থা নথিভুক্ত করা এবং যারা অসুস্থতা অনুভব করবে তাদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে হবে। বাস স্টেশনে আগত এবং নির্গত যাত্রীদের তাপমাত্রা মাপার জন্য স্টেশনের তাপমাত্রা নির্ধারক যন্ত্র স্থাপন করতে হবে। যথাযথ শর্তাবলি মেনে একটি জরুরী এলাকা স্থাপন করতে হবে; যেসব যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা ৩৭.৩ ডিগ্রী সেঃ বা ৯৯ ফাঃ এর উপরে থাকবে তাদের ওই জরুরী এলাকায় অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে এবং প্রয়োজনমতো চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। বায়ু নির্গমন পদ্ধতি যেন স্বাভাবিক থাকে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বাস চলাচলের সময়ে সর্বোচ্চ বায়ু চলাচল করতে দিতে হবে; যথাযথ তাপমাত্রায় বায়ু চলাচলের জন্য বাসের জানালা খুলে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। জনগণের জন্য ব্যবহার্য এবং জনসাধারণের চলাচলের স্থানগুলোকে পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্তকরণের হার বাড়াতে হবে। টয়লেটগুলোতে তরল সাবান (অথবা সাবান) থাকতে হবে, সম্ভব হলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং হাত জীবাণুনাশক যন্ত্র স্থাপন করা যেতে পারে। যাত্রীদের অপেক্ষা করার স্থান, বাস কম্পার্টমেন্ট ও অন্যান্য এলাকা যথাযথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রতিবার বাস ছেড়ে যাবার পূর্বে বাসের ভেতরে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। জনগণের জন্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন সিটগুলোকে প্রতিনিয়ত পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে, সিট কভারগুলোকে প্রতিনিয়ত ধোয়া, পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে। যাত্রীদের অপেক্ষা করার স্থানে, টিকেট কাউন্টার এবং সকল রুটের বাসগুলোতে মাস্ক, গ্লাভস ও জীবাণুমুক্ত করণ দ্রব্যাদির পর্যাপ্ত মজুত থাকতে হবে। সম্ভব হলে সকল বাসে এবং অবশ্যই লং রুটের সকল বাসে হাতে-ধরা থার্মোমিটার থাকতে হবে; যথাযথ স্থানে একটি জরুরী এলাকা স্থাপন করতে হবে যেখানে সন্দেহজনক উপসর্গগুলো যেমন জ্বর ও কাশি আছে এমন যাত্রীদের অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাবে। যাত্রীদের এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে, মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং হাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখতে হবে। যাত্রীদের অনলাইনে টিকেট ক্রয় করার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, সারিবদ্ধভাবে উঠার সময়ে এবং নেমে যাবার সময় যাত্রীদের পরস্পর হতে এক মিটারেরও বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। যাত্রীদের স্বাস্থ্য সচেতন করার জন্য রেডিও, ভিডিও ও পোস্টারের মাধ্যমে সচেতনতামূলক বক্তব্য প্রদান করতে হবে। যুক্তিসঙ্গতভাবে পরিবহনের ধারণক্ষমতা সজ্জিত করতে হবে এবং সীমিত আকারে টিকেট বিক্রয়ের মাধ্যমে যাত্রীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেসব বাস মাঝারি ও উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন এলাকা হতে ছেড়ে যাবে অথবা পৌঁছাবে অথবা ওই এলাকা দিয়ে যাবে সেসব ক্ষেত্রে যাত্রীদের আলাদা সিটে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বসতে হবে। যদি নিশ্চিত কোভিড-১৯ এর রোগী পাওয়া যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাইডলাইন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
×