ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২৯ মে ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ ঈদটাও উৎসবহীন গেল। চেনা ছবিটা দেখা গেল না এবার। করোনার ঘায়ে সব তছনছ। অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে ঈদ। তাই হাসিরাশি আনন্দ উধাও হয়ে গিয়েছিল। উদ্যাপন দৃশ্যমান হয়নি। ঈদের দিন সকালে ঢাকার জাতীয় ঈদগা ময়দান এমন শূন্য পড়ে ছিল যে, নিজের চোখকে অনেকে বিশ^াস করতে পারেননি। জামাত হয়েছে মসজিদের ভেতরে। মুসল্লিরা মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে তার পর বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। ঈদের নামাজ শেষে হ্যান্ডশেক কোলাকুলি কিছুই করতে পারেননি। শিশুপার্ক চিড়িয়াখানা জাদুঘর থিমপার্কসহ সব বিনোদনকেন্দ্র ছিল বন্ধ। ঈদের দিনে এমন দৃশ্য আর দেখা যায়নি। বাধ্য হয়েই সারাদিন ঘরে কাটিয়েছেন ঢাকাবাসী। ভাল কিছু রান্নার চেষ্টা হয়েছে বটে। নেমন্তন্ন খাওয়া বা খাওয়ানোর সুযোগ ছিল না। নতুন পাঞ্জাবি শাড়ি কিছু মানুষকে পরতে দেখা গেছে। বেশিরভাগই এসব পরিহার করেছেন। ঈদের দিন বিকেলে কেউ কেউ ছাদে উঠে ছবি তুলেছেন। ফেসবুকে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছেন। এর বাইরে মোবাইল ফোনে কথা বলা, ভিডিও কল। এসবের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। এভাবে অন্যরকম একলা কাটানো এক ঈদ। এমন ঈদ, বলাই বাহুল্য, আর আসেনি। একইদিন অর্থাৎ ২৫ মে ছিল দ্রোহ প্রেম ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ১২১তম নজরুল জয়ন্তী। কবির ভাষায় : ‘আমি যুগে যুগে আসি/আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু।’ পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো, ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর। সেই কবেকার কথা! অথচ এই এখনও বিস্ময়কর আলো হয়ে পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালীকে। ‘আসছে নবীনÑ জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!’ যাবতীয় অসুন্দর অশুভকে দূর করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েই হয়ত পৃথিবীতে এসেছিলেন নজরুল। ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ’র মাঝে দ্রোহ এবং প্রেমের অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল। মানুষে মানুষে ভেদাভেদকারীদের উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন: ‘মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া...।’ সেই ‘হুক্কাহুয়া’ ডাক এখনও কানে বাজে। জাত-পাত-ধর্মের নামে খুনাখুনী, হায়, শেষ হলো না! তাই প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের সুমহান বাণী নিয়ে পুনঃ পুনঃ সামনে এসে দাঁড়ান কবি। তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত, আজ নয় কা’ল ভাঙ্গবে সে ত,/ যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া...।’ মানুষের পক্ষে জয়গান করা কবি, গানের বুলবুলকে প্রতি বছর জন্মদিনে নানা আয়োজনে স্মরণ করা হয়। শ্রদ্ধা ভালবাসা জানানো হয়। কিন্তু এবার একেবারেই ভিন্ন পরিস্থিতি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সব থমকে আছে। তদুপরি কম বেশি ঈদের আনুষ্ঠানিকতাও ছিল। ফলে প্রিয় কবির জন্মদিন বরাবরের মতো ঘটা করে উদ্যাপন করা সম্ভব হয়নি। তাই বলে নজরুলকে ভুলে ছিলেন সবাই, না, এমনটি নয়। বরং বিকল্প ব্যবস্থায় তাঁকে শ্রদ্ধা ভালবাসা জানানো হয়েছে। শিল্পীরা ঘরে বসে অনেকগুলো লাইভ অনুষ্ঠনের আয়োজন করেন। সেসব অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান গায়ক গায়িকাদের গান করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ‘জাগো অমৃত পিয়াসী’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান নজরুল জয়ন্তীর দিন বিটিভিসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে একযোগে সম্প্রচারিত হয়। এভাবে গানে কবিতায় বাংলা সাহিত্য সঙ্গীতের বিস্ময়কর প্রতিভাকে স্মরণ করা হয়। ছোট ছোট আয়োজন থেকে চমৎকারভাবে নজরুলের দর্শন তুলে ধরা হয়। প্রকৃত ভক্তদের উদ্দেশে কবি লিখেছিলেন, ‘যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো।’ এবার যেন ঠিক তাই হলো। এদিকে, জৈষ্ঠ্যে এসে দাপট দেখিয়ে চলেছে কালবৈশাখী। গত ক’দিন ধরেই ভারি বৃষ্টি হচ্ছে ঢাকায়। বইছে ঝড়ো হাওয়া। সুপার সাইক্লোন আমফান শেষ হওয়ার পর থেকেই এ অবস্থা। বুধবারও দফায় দফায় বৃষ্টি হয়েছে। ঝড়ে টিকতে পারেনি অনেক পুরনো গাছপালাও। উপড়ে পড়তে দেখা গেছে। করোনার কাল। প্রাণঘাতী কোভিড ১৯ ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ। মৃত্যু। কে কখন মরে যাচ্ছে, জানাও যাচ্ছে না সব সময়। শঙ্কার মধ্য দিয়ে এক একটি দিন কাটছে। এমন সময়ে ঝড়, ভারি বর্ষণ মানুষের নীরব কান্নার কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে!
×