ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১২ অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্রের আটটিই মেয়াদোত্তীর্ণ ॥ তদন্ত কমিটি

ইউনাইটেডের আইসোলেশন সেন্টারে আগুনে পুড়ে ৫ করোনা রোগীর মৃত্যু

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ২৯ মে ২০২০

ইউনাইটেডের আইসোলেশন সেন্টারে আগুনে পুড়ে ৫ করোনা রোগীর মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে অবস্থিত দেশের খ্যাতিমান বেসরকারী হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত ইউনাইটেড হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, এমন একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণের যন্ত্র বিকল থাকার ঘটনাটি নতুন করে রহস্যের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে অদূরে থাকা মূলভবন ও আইসিইউতে না লেগে আগুন করোনা রোগীদের জন্য তৈরি করা আইসোলেশন সেন্টারে লাগার ঘটনায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আইসোলেশন সেন্টারটি দায়সারা গোছের করে তৈরি করা হয়েছিল বলে দাবি করেছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গুলশান মডেল থানায় দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কথা বলে একটি মামলা দায়ের করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটেছে বলে দাবি করেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করা হয়নি। রোগীর এক স্বজনের জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে ফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিস সেখানে যায়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এসি বিস্ফোরণে ঘটনাটি ঘটেছে। এমন ঘটনায় হাসপাতালটিতে থাকা রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের একটি হাসপাতালে নি¤œমানের এসি থাকা বা তার তদারকি না করার বিষয়টি চরম সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অগ্নিকা-ের স্থল ॥ গুলশান-২ এর ৭১ নম্বর সড়কের পূর্ব দিকের শেষ মাথায় দেশের খ্যাতিমান এই বহুতল হাসপাতালটির অবস্থান। এটি খুবই ব্যয় বহুল হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত। এজন্য সমাজের তুলনামূলক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই হাসপাতালটিতে সাধারণত হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। চলতি বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব বিরাজ করছে। হাসপাতালটি শেষ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে রাজি হয়। তাও স্বল্প পরিসরে। এজন্য চলছিল করোনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সন্দেহভাজন রোগীদের রাখার জন্য হাসপাতালের নিচ তলায় তাবু গেড়ে মাত্র পাঁচ শয্যার একটি আইলোসেশন সেন্টার খুলে ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সেই আইলোসেশন সেন্টারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট রাত ১০টার খানিকটা পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ততক্ষণে পুরো আইসোলেশন সেন্টার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে এমন ভয়াবহ অগ্নিকা-ে আইলোসেশনে থাকা পাঁচ রোগীর সবাই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদিও অদূরে থাকা হাসপাতালটির মূলভবন এবং পাশে থাকা আইসিইউতে কোন ধরনের ক্ষতি হয়নি। নিহতরা হচ্ছেন ॥ রিয়াজুল আলম (৪৫), খোদেজা বেগম (৭০), ভেরন অ্যান্থনী পল (৭৪), মনির হোসেন (৭৫) ও মাহাবুব এলাহী চৌধুরী (৫০)। তারা সবাই করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপতাালটির আইসোলেশনে ভর্তি হয়েছিল। যার মধ্যে রিয়াজুল আলমের করোনা পজিটিভ ছিল না। তারা নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই নমুনা রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। অথচ নমুনা রিপোর্ট পাওয়ার আগেই করোনা নয়, তাদের জীবন কেড়ে নিল ভয়াবহ আগুন। নিহতদের লাশ যার যার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মামলা দায়ের ॥ এ ঘটনায় বুধবার রাতেই গুলশান মডেল থানায় ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি মামলা দায়ে করে। মামলায় অগ্নিকা-ের ঘটনাটি দুর্ঘটনা বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এমন দুর্ঘটনার কে বা কারা দায়ী বা তাদের অবহেলায় এমন দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি ॥ হাসপাতালটির কমিউনিকেশন এ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডাঃ সাগুফা আনোয়ার বলেন, করোনা রোগীদের জন্য পাঁচ শয্যার একটি আইসোলেশন সেন্টার খোলা হয়েছিল মূল ভবনের বাইরে একটি একতলা ভবনে। সেখানে চার রোগী ভর্তি ছিলেন। রাতে হঠাৎ সেখানেই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে। আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য চেষ্টা করা হয়েছে। ওই সময় বৃষ্টি পড়ছিল। নিজস্ব ফায়ার ইকুইপমেন্ট দিয়ে আগুন নির্বাপণের চেষ্টাও করা হয়। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত আসার পর আগুন পুরোপুরি নির্বাপিত হয়। এতে হাসপাতালের নিচতলায় স্থাপিত আইসিইউ ইউনিটসহ মূল ভবনের কোন ক্ষতি হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি থাকা পাঁচজনের সবাই অগ্নিকা-ে নিহত হয়েছেন। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হতে পারে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো আইসোলেশন সেন্টার পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি গঠন ॥ বুধবার রাতেই আগুনের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। তদন্তে আগুনের কারণ, হাসপাতালের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, দায়বদ্ধতা ও ব্যর্থতা (যদি থাকে) তা তুলে ধরা হবে। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধনকে। কমিটিকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ডিউটি অফিসার লিমা খানম। হাসপাতালটিতে সঠিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না ॥ বুধবার রাতেই ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাজ্জাত হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি হাসপাতালে যে ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা, তা নেই। ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলেও, তা ব্যবহার করতে পারেনি হাসাতাল কর্তৃপক্ষ। হয়তো ব্যবহার করার মতো জনবল ছিল না। এজন্য ফায়ার সার্ভিসের হাইড্রেন্ট দিয়েই অগ্নিনির্বাপণ করতে হয়েছে। অথচ হাসপাতালটিকে সচেতন করতে এবং কিভাবে আগুন নেভাতে হয় এজন্য অনেক আগেই অগ্নিনির্বাপণের মহড়াও দেয়া হয়েছে হাসপাতালটিতে। বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাজ্জাত হোসাইন জনকণ্ঠকে জানান, বুধবার পর্যন্ত চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিই করা হয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার ঘটনার বাস্তবতায় পরে সেটিকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে উন্নিত করা হয়। অগ্নিকা-ের ঘটনাটি অত্যন্ত মানবিক এবং গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কারণ যারা নিহত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ জনই হয়তো করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না। ইতোমধ্যেই একজন করোনা আক্রান্ত ছিলেন না জানা গেছে। নিহত বাকিরা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিনা, তা জানার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি অগ্নিকা-ের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। দায়সারা গোছের আইসোলেশন সেন্টার ॥ বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিসের গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে কমিটির প্রধান দেবাশীষ বর্ধন বলেন, দায়সারা গোছের করে গড়ে তোলা হয়েছিল আইসোলেশন ইউনিটটি। করোনা রোগী রাখার জন্য আলাদা আইসোলেশন করতে সরকারীভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এজন্যই তারা দায়সারা গোছের আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তুলেছিলেন। এ ধরনের আইসোলেশন সেন্টার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যে পাঁচজন মারা গেছেন তারা সানসেটের ঠিক নিচে ছিলেন। আর বাইরে একটা এক্সটেনশন আছে টিনশেডের। অস্থায়ীভাবে তৈরি ওই ইউনিটের পার্টিশনগুলো তৈরি করা হয়েছিল পার্টেক্স জাতীয় বোর্ড দিয়ে। যা অত্যন্ত দাহ্য। আগুন লাগার পর তা আস্তে আস্তে পুরোটায় লেগে গেছে। এ কারণে একজন রোগীও বের হতে পারেননি। আর করোনা রোগীর আশপাশে সাধারণত কেউ থাকেন না। ফলে তাদের সাহায্য করার মতো হয়তো তেমন কেউ ছিল না। ফলে তারা বের হতে পারেননি। ইলেক্ট্রিক কোন কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। হাসপাতালের ১২ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের আটটিই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ ॥ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তার সামনেই সিআইডির ফরেনসিক টিম হাসপাতালটির আইসোলেশন ইউনিট থেকে অগ্নিনির্বাপণের ১২টি যন্ত্র বের করে আনে। তাতে দেখা যায়, যার মধ্যে আটটিরই মেয়াদ নেই। এসব যন্ত্র আলামত হিসেবে জব্দ করেছে সিআইডির ফরেনসিক দল। আর আগুন লাগলে হাইড্রেন্ট (যা থেকে জরুরী পানি সরবরাহ করা যায়) সেটি কে চালাবে, কে কাজ করবে, কার দায়িত্বে ছিল এসব কিছুই সুনির্দিষ্ট করা ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদফতরও ঘটনাটি তদন্ত করছে ॥ অগ্নিকাণ্ডের হাসপাতালটির আইসোলেশনে থাকা পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডাঃ নাসিমা সুলতানা। জানা গেছে, সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক আইসোলেশন ইউনিট খোলার অনুমতি দেয়। আগুন নেভাতে নিজস্ব তৎপরতা ছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ॥ রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের পর কর্তৃপক্ষের কাউকে নিজস্ব আয়োজনে আগুন নেভাতে চেষ্টা চালাতে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। সেখানে চিকিৎসাধীন এক রোগীর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেন, আগুনের ভয়াবহতা তেমন ছিল না। প্রথম দিকে যখন আগুন লাগে তখন বৃষ্টিও হচ্ছিল। আগুনের ভয়াবহতা না থাকার পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাউকেই নিজস্ব আয়োজনে তা নেভানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভায়। হাসপাতালে যে পরিমাণ স্টাফ আছে, তারা মিলে চেষ্টা করলে হয়তো প্রাণহানির ঘটনা নাও ঘটতে পারত।
×