ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘরে অবস্থান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই রক্ষাকবচ

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ২৩ মে ২০২০

ঘরে অবস্থান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই রক্ষাকবচ

নিখিল মানখিন ॥ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। প্রতিদিনই করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের নতুন রেকর্ড গড়ছে। দেশের এমন করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারী নির্দেশনা পালনই রক্ষাকবচ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে সরকার। সংক্রমণের চতুর্থ ধাপ মহামারীর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে দেশের করোনা পরিস্থিতি। উপসর্গহীন রোগী এবং সন্দেহজনক করোনা রোগীর তথ্য গোপন করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় করোনার নীরব সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা করার আগ পর্যন্ত রোগী নিজেও করোনার উপস্থিতি বুঝতে পারছেন না। করোনার এমন পরিস্থিতিতে কোন ব্যক্তিই সন্দেহের বাইরে থাকছে না। এমন অবস্থায় সরকারী নির্দেশনা মেনে ‘ঘরে অবস্থান’ এবং ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় না রাখলে দেশের করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি একটি বৈশি^ক মহামারী। এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অসহায় হয়ে পড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আতঙ্কমুক্ত থাকতে পারে না। দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর করোনা প্রতিরোধে গ্রহণ করতে থাকে একের পর এক কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না মানুষ। বাসার বাইরে হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেকগুণ। রাস্তাঘাট, অলি-গলি, বাজারসহ সর্বত্রই মানুষের ভিড়। শহরাঞ্চলে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে যানবাহনগুলোর জট। ন্যূনতম সুরক্ষার উপাদান মাস্ক না পরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে, ঠেলাঠেলি করে বাজার করছেন। কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয় আড্ডা দিচ্ছেন। এদিকে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, দেশে উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বেচ্ছায় বা কোন কারণে নমুনা পরীক্ষা করোনার আগে পর্যন্ত করোনামুক্ত ভেবে তারা সকলের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা অব্যাহত রেখে চলেছেন। আরেক ধরনের রোগী আছেন, যারা নানা পরিস্থিতির আতঙ্কে তথ্য গোপন করে যাচ্ছেন। শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি না হওয়া পর্যন্ত তারা নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহ দেখান না। এ ধরনের রোগীরাও নিজেদের করোনামুক্ত ভেবে বাসার ভেতরে ও বাইরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ান। এভাবে মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, উপসর্গহীন রোগী এবং সন্দেহজনক করোনা রোগীদের তথ্য গোপন করার প্রবণতা দেশের করোনা পরিস্থিতিকে প্রবল ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের মানুষ সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘরে অবস্থান এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে করোনা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের করোনা পরিস্থিতি ॥ ২২ এপ্রিল একদিনে করোনায় মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে । গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২৪ জনের মৃত্যু এবং ১৬৯৪ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ৪৩২ এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৩০ হাজার ২০৫ জনে। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হওয়া ৫৮৮ জনসহ এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন মোট ৬ হাজার ১৯০ জন। পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার বিবেচনায় শুক্রবার প্রকাশিত নতুন রোগী শনাক্তের হার প্রায় ১৮ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২৭টিসহ এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৪১টি। নমুনা পরীক্ষার ল্যাবের সংখ্যা ৪টি বেড়ে দাঁড়াল ৪৭টি। ৬০ বছরের বেশি বয়সী রোগীর মৃত্যুহার বেশি ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এ পর্যন্ত করোনায় মারা যাওয়া রোগীদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬০ বছরের বেশি ৪২ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের ২৭ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ১৯ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৭ শতাংশ, ২১ থেকে ২৯ বছরের ৩ শতাংশ এবং ১০ বছরের নিচে বয়সীরা ২ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী রোগীর মধ্যে কেউ মারা যায়নি। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরাই বেশি আক্রান্ত ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরের বেশি ৪ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের ১৩ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ১৩ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ২৪ শতাংশ, ২১ থেকে ২৯ বছরের ২৬ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের ৪ শতাংশ এবং ১০ বছরের নিচে বয়সীরা ৩ শতাংশ। করোনায় মৃতের হার ৭১ শতাংশ পুরুষ এবং ২৭ শতাংশ নারী। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী নির্দেশনা মেনে ‘ঘরে অবস্থান’ এবং ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে পারলে এখনও দেশ করোনার মহামারী থেকে রক্ষা পেতে পারে। মহামারী পর্যায়ে চলে গেলে শত উদ্যোগ নিয়েও করোনার ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পাবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মতো বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়েও করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখেছে বিশ্বের অনেক দেশ। তবে আমাদের হাতে রয়েছে খুবই কম সময়। তিনি আরও বলেন, মানুষের আচরণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশবাসীর বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ বন্ধ না হলে সামনে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ মুর্হূত অপেক্ষা করছে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ বলেন, করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে সংস্পর্শের মাধ্যমে। আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের সংস্পর্শ এড়ানোই নতুন সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র উপায়। সংক্রমণ থামাতে অন্তত কম আক্রান্ত এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা খুবই কার্যকর। করোনা প্রতিরোধে সফলতা পেয়েছে এমন দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই নানা উদ্যোগ প্রহণ করেছে সরকার। ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ধেয়ে আসা করোনার মহামারী পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারছেন না দেশের অনেক মানুষ। ঘরে অবস্থান করার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতেই হবে। অন্যথায় দেশের করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবেই। জাতীয় রোগতত্ত্ব¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জনকণ্ঠকে জানান, এখন সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রান্তিকাল। দেশ সংক্রমণের তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরের দিকে যাচ্ছে, এটা বলা যায়। ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকার নির্দেশিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। ঘরে অবস্থান করতেই হবে। নিজেকে, নিজের পরিবারকে এবং দেশবাসীকে বাঁচাতে হলে তা করতেই হবে। সরকারী নির্দেশনা মানা না হলে সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডাঃ নাসিমা সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পরিবর্তন না ঘটলে করোনা সংক্রমণের হার বাড়তেই থাকবে। অতি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে বের হওয়া যাবে না। প্রয়োজনে বাইরে বের হলেও সুরক্ষা পোশাক পরতে হবে। আর জন সমাগমে যাওয়া যাবে না। আপনি যেখানেই যান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। উপসর্গহীন করোনা রোগীও শনাক্ত হচ্ছে। অনেকে উপসর্গসমূহ গোপন করে যাচ্ছেন, যা সুস্থ মানুষের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
×