ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আল বিদা মাহে রমজান

প্রকাশিত: ২১:৫২, ২৩ মে ২০২০

আল বিদা মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর রোজা ভাঙ্গার উৎসব এখন আমাদের দ্বারপ্রান্তে। মুসলিম প্রধান এদেশে শহর গ্রামগঞ্জ সর্বত্রই ঈদ আনন্দের ঢেউ। অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও এ আনন্দোৎসবে শরিক। কারণ, ঈদ-উল-ফিতর ধর্মীয় অঙ্গন ছাড়িয়ে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে আমাদের প্রতিবেশী অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর। বাঙালী জাতির কৃষ্টি, কালচার, সংস্কৃতিতে ঈদ-উল-ফিতরের আর্থ-সামাজিক অবদান আবহমান কালের। ঈদের শুভেচ্ছা ও ভাব বিনিময়, কেনাকাটা আর আপ্যায়নে জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সকলেই যেন একাকার। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী আর পুরুষ, ধনীর বালাখানা ও গরিবের পণ্যকুটির কোথায় নেই এই ঈদের সুঘ্রাণ! কারো আঁখি জলে কারো কারো ঝাড়ে কিরে জ্বলিবে দ্বীপ? দু’জনার হবে বুলন্দ নসিব, লাখে লাখে হবে বদ নসিব এ নহে বিধান ইসলামের ঈদ-উল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান।’ এ বছরের ঈদ এসেছে এক অপরিচিত পরিবেশে। করোনাভাইরাসে জর্জরিত তামাম পৃথিবী, দিকবিভ্রান্ত গোটা মানবজাতি। ব্যাহত স্বাভাবিক জীবন ও যাবতীয় সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা। চতুর্দিকে ঈদ আনন্দে নিরানন্দের ছাপ। শাশ্বত এই ঈদ নিষ্পাপতা ও নিষ্কলুষতায় এক স্বতন্ত্র আবহে প্রবর্তিত ও আবর্তিত। ঈদ আনন্দ প্রবর্তনের শুরুতেই গর্ব ও আত্মতৃপ্তির সঙ্গে ইসলামের মহান প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- লিকুলি ক্বাওমিন ঈদ-উল-ওয়া হাযা ঈদুনাÑ প্রত্যেক জাতির কোন না কোন আনন্দ উল্লাসের দিবস থাকে, আর এ হলো আমাদের নিষ্কলুষ আনন্দধারা।’ মহানবী ৬২২ খ্রিস্টাব্দে সবেমাত্র হিজরত করে মদীনায় আসলেন। তিনি দেখলেন, নওরোজ ও মেহেরজান নামক দুটি উৎসবে ইয়াসরিবের নারী-পুরুষ উন্মাতাল। এ উৎসবে অশ্লীলতা ও বাড়াবাড়িরও কমতি ছিল না। মহানবী (স) ভাবলেন মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কোন নির্মল আনন্দ উৎসবের দিবস থাকা প্রয়োজন। যা দ্বারা তারা মনের টানে আর অশ্লীলতার দিকে পা না বাড়ায় এবং ঘরে ঘরে একটা বিনোদনের ধারাবাহিকতা জন্মলাভ করে। তাই তিনি পরবর্তী বছর অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরিতে ঘোষণা করলেন এবং প্রবর্তন করলেন দুটি উৎসবের বদলায় নয়া দুটি উৎসবের। একটি হলো পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর আর একটি হলো ঈদ-উল-আজহা- মাসব্যাপী সিয়াম সমাপনী উৎসব আর পশু কোরবানির মাধ্যমে পরম আত্মত্যাগের মহোৎসব। ঈদের আনন্দকে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ঈদগাহে নারী-পুরুষ সকলকে সমবেত হতে উৎসাহ দিলেন হযরত। আজ শুধু ইবাদত নয়, আবার শুধু আনন্দও নয়; মসজিদের আঙ্গিনা ছেড়ে ইবাদত আনন্দের সংমিশ্রণে যা সংঘটিত হবে তা পবিত্র ঈদগাহে। তিনি ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যেতেন, আর কুশল বিনিময় করতে করতে অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরতেন। আর খোদা তায়ালার নামে সমস্বরে তাওহীদের জয়ধ্বনি করতেন: তাকবীর- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার.......।’ এ বছর সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্য অনেক বিষয়ই সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ল। এদিন তিনি রোজা রাখা, মুখ ভার করা হারাম ঘোষণা করেছেন। কারণ, এ দিন কোন পেরেশানি ও বেদনা নয়, রোজার নামে ইবাদতও নয়, এদিন বিশ্ব আপ্যায়ন দিবস। পরওয়ার দিগারের পক্ষ থেকে সমাজের সর্বত্র খাওয়া দাওয়ার শামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে। সবার দুয়ার এদিন উন্মুক্ত! তিনি ঘোষণা করেছেন এদিন দিবসের সূচনা হবে বিসমিল্লাহতেই মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য পানাহার ও আপ্যায়িত করার মাধ্যমে। নবীজী এদিন অকাতরে দান সদকা করতেন। ভুলতেন না দ্বীন দুখী শহীদ পরিবারগুলোকে। আমাদেরও তার সুন্নাহ অনুসরণে উদার হস্তে যাকাত-ফিতরা, দান-সদকায় অংশ গ্রহণের তাগিদ রয়েছে। পবিত্র ইসলামের এই নীতি কথাটি অতি সুন্দরভাবে ধারণ করেছেন কবি নজরুল তার কবিতায়- সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ/ চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা; মোদের হিস্সা আদায় করতে ঈদে/দিলে হুকুম আল্লাহ তা’য়ালা। দ্বার খোলো সাততলা বাড়ীওয়ালা, দেখ কারা দান চাহে/ মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেব ঈদগাহে-।’ আমাদের সকলকে সে মন মানসিকতায় দেশ জাতির জন্য কাজ করতে হবে। সারাটি বছর তৈরি থাকতে হবে দুখী মানুষের আঁখিজল মুছে তাদের চোখেমুখে হাসি ফোটানোর। তাহলেই এই ঈদ মৌসুমের আনন্দ সত্যিকারের আনন্দ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্ব জুড়ি মুসলিমের গৃহে গৃহে আজি/ শুধু হাসি শুধু কলরব, শত্রু আজি শত্রু নাই, মিত্ররূপে সাজি/সাধিতেছে এক মহোৎসব/ আপনারে অপরেরে এসো টেনে লই/ সমাজের কাজে দিতে প্রাণ, / সকলেরই এক স্বার্থ এক লক্ষ্য হলে/ সহায় হবেন রহমান।’ ঈদপূর্ব রজনীতে আমরা যেন আল্লাহকে ডাকি, রাত জেগে ইবাদত ইস্তিগফার করি। ঈদের দিন ভোর থেকে জামাত পর্যন্ত অনেকগুলো সুন্নাত আমল রয়েছে যেমন মিষ্টিমুখের মাধ্যমে দিনের সূচনা করা, ফিতরা দান, গোসল করা, তাকবির পড়ে ঈদ জামাতে যাতায়াত করা ইত্যাদি। আমরা ঈদ আনন্দের পাশাপাশি ইবাদতের সুযোগ যেন হাত ছাড়া না করি। সবাইকে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের আগাম শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক, আসসালাম! পরিশেষে দুআ, আল্লাহ আমাদের করোনা’র অভিশাপ থেকে হেফাজত করুন। আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারস ... হে আল্লাহ অবশ্যই আমি তোমার নিকট পানাহ চাই স্বেতী, উন্মাদনা, কুষ্ঠরোগ এবং সকল প্রকার কঠিন ব্যাধি থেকে।’ - (আবু দাউদ, তিরমিজি শরীফ)।
×