ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় গ্যালারি বন্ধ, তরুণ শিল্পীরা অর্থকষ্টে

প্রকাশিত: ২১:৩০, ২৩ মে ২০২০

করোনায় গ্যালারি বন্ধ, তরুণ শিল্পীরা অর্থকষ্টে

মনোয়ার হোসেন ॥ জীবনের সঙ্গে জীবিকায় আঘাত হেনেছে করোনাভাইরাস। সেই অভিঘাতে অনেক কিছুর মতোই থমকে গেছে শিল্প-সংস্কৃতিচর্চা। সেই সুবাদে চিত্রকলা বা চারুশিল্পেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর গ্যালারি বা প্রদর্শনালয়গুলো। এসব গ্যালারি বন্ধ থাকায় ঝুলছে না সেখানে কোন চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম। নেই শিল্পকর্মের বিকিকিনি। তরুণ এবং ফ্রি-ল্যান্স শিল্পীদের আয়ের একটি অন্যতম উৎস প্রদর্শনীর মাধ্যমে ছবি বিক্রি। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের বাইরে বর্তমানে এই শিল্পীদের বড় একটি অংশ গভীর আর্থিক সঙ্কটে দিনযাপন করছেন। উল্টোদিকে ফেব্রুয়ারি পর থেকে অঘোষিত লকডাউনের কারণে খুলতে না পারায় গ্যালারিগুলোকেও গুনতে হচ্ছে লোকসান। দ্রুত পরিস্থিতির উন্নত না হলে বিদ্যমান শিল্পের বাজারটি পড়বে হুমকির মুখে। এতো গেল প্রদর্শনালয়ের সার্বিক অবস্থা এব গ্যালারিকেন্দ্রিক শিল্পীদের জীবিকার কথা। এর বাইরে অনেক তরুণ শিল্পী বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে রোজগার করতেন। সেই আয় এখন বন্ধ। কেউ পাড়া-মহল্লায় ছোটখাট আর্ট স্কুল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। শাড়িসহ বিভিন্ন পোশাকে আল্পনা এঁকেও চলত অনেকের সংসার। বিভিন্ন ছোটখাট চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব পালন করে কিংবা ওয়ার্কশপ পরিচাল সম্মানী পেতেন অনেক তরুণ শিল্পী। শিল্পকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে চলত এসব শিল্পীর জীবন। এখন ছন্দপতন ঘটেছে চারুশিল্প নির্ভর সেই জীবনে। স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী টাইগার নাজির। পাবলিক লাইব্রেরি সামনে তিনি একটি ওপেন আর্ট শপ চালাতেন। চিত্রকর্মের পাশাপাশি চিত্রকর্ম নির্ভর নানা পণ্য বিক্রিই তার আয়ের অন্যতম উৎস। এই শিল্পী তৈরি চটের ব্যাগে বাঘের ছবি কিংবা গহনা, টি-শার্টসহ নানা পণ্যের ভালই কাটতি ছিল। বর্তমানে সেই ওপেন আর্ট শপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুর্দশায় পড়েছেন এই শিল্পী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, টিকে থাকার জন্য রাস্তার ধারে খোলা জায়গায় আর্ট শপটি চালাতাম। করোনার কারণে তিন মাস ধরে সেটি বন্ধ আছে। আয়- রোজগার বলে কিছু নেই। আমার স্ত্রী একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। দুই মাস ধরে তারও বেতন হয় না। সব মিলিয়ে প্রচ- অর্থকষ্টে আছি। অথচ লজ্জায় কাউকে বলতে পারছি না। উল্টো নিজে ছবি এঁকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অন্যদের সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছি। শিল্পীদের সংগঠন চারুশিল্পী সংসদ থেকেও সহায়তা পাইনি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের শিল্পীদের সহায়তা তহবিল অর্থ পাওয়ার আশায় আবেদনপত্র পূরণ করলেও এখনও কোন টাকা-পয়সা পাইনি। আমার মতো অনেক ফ্রি-ল্যান্স শিল্পীই এখন দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে। এ বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অনিসার হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্তের সংজ্ঞা অনেকরকম হয়। এমনিতেই এদেশে শিল্পের বাজার খুব বড় নয়। সর্বোচ্চ কুড়িজন শিল্পী শিল্পকর্ম ভাল দামে বিক্রি। তবে মহমারীতে আমাদের কিছু তরুণ ফ্রি-ল্যান্স আর্টিস্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই শিল্পীরা মূলত দিন এনে দিন খাওয়া পর্যায়ের। যারা বিভিন্ন ধরনের কন্ট্রাক্টে কাজ করত, এ্যাডফার্মে কাজ করত বা আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা করত তাদের এখন চাকরি ও বেতন দুটাই এখন অনিশ্চিত। আমরা যে ধরনের সাহায্য দেই সেটা দিয়ে তাদের চাহিদা পূরণ হবে না। ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করে বাঁচার সময় এখন। কোন মানুষ যেন ভাতের অভাবে না মরে সেটা দেখতে হবে সবার আগে। বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের সভাপতি শিল্পী জামাল আহমেদ বলেন, মহামারীতে অসচ্ছল হওয়া শিল্পীদের সহযোগিতার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এই শিল্পীদের একটি তালিকাও তৈরি হয়েছে। আমি নিজেও ১৫টি ছোট ছবি দিয়েছি বিক্রির জন্য। ছবি বিক্রির অর্থ দিয়ে তহবিল গড়ে সহায়তা প্রদান করা হবে। কার্যত ফেব্রুয়ারি পর থেকেই দেশের গ্যালারিগুলো বন্ধ। লকডাউন উঠে গেলেও দেশে শিল্পের বাজার আগের গতি ফিরে পাওয়া নিয়ে আছে সংশয়। এ প্রসঙ্গে গ্যালারি কায়ার পরিচালক শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী বলেন, গত ফেব্রুয়ারির পর থেকেই রাজধানীর সকল গ্যালারি বন্ধ। গ্যালরি বন্ধ থাকায় নেই প্রদর্শনী। সে কারণে বন্ধ ছবি বিক্রি বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ফ্রি-ল্যান্স আর্টিস্টরা। একটা প্রদর্শনী হলেও সেখানকার ছবি বিক্রির অর্থ দিয়ে তাদের সংসার চলত। কিন্তু গ্যালারি বন্ধ থাকায় তারা এখন তীব্র সঙ্কটে রয়েছেন। এই শহরে বাড়ি ভাড়া, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে তাদের হিমশিম খেতে হবে। এই অবস্থা কতদিন চলবে কেউ বলতে পারছে না। অন্যদিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে দেশের শিল্প গ্যালারিগুলো। শুধু গ্যালারি নয় যে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে কাজ করেন তারাও অর্থিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। কারণ, তাদের ছবি বিক্রি বন্ধ রয়েছে পুরোপুরি। এদিকে প্রতিটি গ্যালারি চালাতে হলে একটি খরচ রয়েছে। প্রদর্শনী না হলে সেই ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হবে।
×