ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঈদ-উল-ফিতর ॥ আনন্দ বৈভব

প্রকাশিত: ১৯:৪৫, ২৩ মে ২০২০

ঈদ-উল-ফিতর ॥ আনন্দ বৈভব

মুসলিম বিশ্বে দুটি বড় আনন্দ উৎসব গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়- যার একটির নাম ঈদ-উল-ফিতর এবং অন্যটির নাম ঈদ-উল-আযহা। ঈদ-উল-ফিতর হচ্ছে সিয়াম ভাঙ্গার আনন্দ উৎসব এবং ঈদ-উল-আযহা হচ্ছে কোরবানির আনন্দ উৎসব। এই দুই ঈদেরই গুরুত্ব অপরিসীম। তবে আনন্দবৈভবের নিরিখে ঈদ-উল-ফিতর সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ-উৎসব আছে। আমাদের আনন্দ উৎসব এই ঈদ। আনন্দ উৎসব যা প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট নিয়মে ফিরে ফিরে আসে এবং যা নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর পালিত হয়। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা মুয়াজ্জমা হতে মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে এসে এখানে স্থাপন করলেন একটি মসজিদ এবং এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললেন একটি সুখী-সুন্দর সমাজ কাঠামো। তিনি মদিনায় এসে লক্ষ্য করলেন যে, এখানকার মানুষ প্রতি বছর অতি উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে দুটি উৎসব পালন করে যাতে কোন পবিত্রতার বালাই নেই, নেই কোন পরিচ্ছন্ন মননের ছোঁয়া। অশ্লীল আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, নিরর্থক আমোদ-ফুর্তির মধ্য দিয়ে প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে এ উৎসব দুটি নির্দিষ্ট সময়ে মদিনার মানুষ পালন করত। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস রাদিআল্লাহ তা’আলা আন্হু হতে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনাতে এসে দেখলেন যে, তাদের দুটি উৎসবের দিন রয়েছে। সেই দুই দিন তারা আমোদ-ফুর্তি, খেলাধুলা প্রভৃতি করত। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : এই দুই দিন কিসের জন্য? তারা বলল : এই দুই দিন অন্ধকার যুগে আমরা খেলাধুলা করতাম। এ কথা শুনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : আল্লাহ্্ এই দুই দিনের পরিবর্তে অধিকতর উত্তম দুটি দিন তোমাদের দিয়েছেন আর তা হচ্ছে ঈদ-উল-আযহা ও ঈদ-উল-ফিতর। জানা যায়, ইসলাম-পূর্ব যুগে যে দুটি আনন্দ উৎসব পালিত হতো তার একটির নাম ছিল নওরোজ ও অন্যটির নাম ছিল মেহেরজান। তদানীন্তন পারস্যে এই দুটি উৎসবের ব্যাপক প্রভাব ছিল বলে জানা যায়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে আসার প্রায় ১৭ মাস পরে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মুসলমানদের জন্য সিয়াম বা রোজার বিধান দিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : রমাদান মাস, যাতে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য দিশারী সত্য পথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের মধ্যে পার্থক্যকারী আল-কুরআন। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস প্রত্যক্ষ করবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ শাবান রমাদান মাসে সিয়াম পালন করার বিধান নাযিল হয়। এরই ১৪-১৫ দিন পর মাহে রমাদানুল মুবারকের আগমন হলে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে রমাদানের সিয়াম পালন করেন। সেই বছর রমাদানের চাঁদ মদিনা মনওয়ারায় এক অনন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার বাস্তব অনুশীলন অনুভবে সমুজ্জ্বল হয়ে উদিত হয়েছিল যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে আজও বিশাল মুসলিম দুনিয়ায় সমানভাবে রয়েছে। এর পূর্বেও সিয়াম পালনের রেওয়াজ মদিনায় ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল। তারা মুক্তির দিবস হিসেবে ১০ মহররম আশুরার সিয়াম পালন করত। মদিনায় হিজরত করে এসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আশুরার সিয়াম পালন করেছেন এবং তাঁর নির্দেশে সাহাবায়ে কেরামও আশুরায় এই সিয়াম পালন করেছেন। কিন্তু রমাদানের সিয়াম পালন করার বিধান নাযিল হলে আশুরার সিয়াম ঐচ্ছিক সিয়ামে পরিণত হয় আর রমাদানের সিয়াম বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। যে বছর প্রথম রমাদানের সিয়াম পালিত হয় সেই বছরের সেই রমাদানেই সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ গাযওয়ায়ে বদর। সেই রমাদান শেষেই সর্বপ্রথম মুসলমানদের নিজস্ব আনন্দ উৎসব ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয় মদিনা মনওয়ারায়। সিয়াম পালনের সেই প্রথম রমাদান মাসটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহে সমৃদ্ধ। সেই রমাদান মাসের শেষ দিন প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নতুন এক আনন্দ উৎসবের ঘোষণা দিলেন। সেটাই ছিল ঈদ-উল-ফিতরের ঘোষণা। ঈদ-উল-ফিতরের অর্থ সিয়াম ভাঙ্গার আনন্দ উৎসব। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১ শাওয়াল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইমামতিতে প্রথম ঈদ-উল-ফিতরের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ছয় তকবিরের সঙ্গে আদায় করেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তারপর থেকে প্রতি বছর রমাদান শেষে ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ রমাদান বদর যুদ্ধের বিজয়ের ১৩-১৪ দিন পর মদিনায় সর্বপ্রথম ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হয়েছিল আর ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২১ রমাদান মক্কা বিজয়ের ৮-৯ দিন পর মক্কা মুয়াজ্জমায় সর্বপ্রথম ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হয়েছিল। ঈদ-উল-ফিতরের সঙ্গে বিজয়ের যেন এক মহা যোগসূত্র রয়েছে। রমাদান মাসের এক মাস ধরে দিবাভাগে সবটুকু সময়ে অর্থাৎ সুবহ্সাদিকের পূর্ব হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকারের পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে নিজেকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বিরত রেখে সায়িম বা রোজাদার নফসের সঙ্গে রীতিমতো যে কঠিন যুদ্ধ চালিয়ে যায় তারই বিজয় অনুভব ভাস্বর হয়ে ওঠে ১ শাওয়াল ঈদ-উল-ফিতরের দিনে। একটি হাদিসে আছে যে, সশস্ত্র যুদ্ধ হচ্ছে ছোট যুদ্ধ আর নফ্সের সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে বড় যুদ্ধ। যে মানুষ নফ্সকে দমন করতে পারে, ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই কেবল প্রকৃত মানবতা গুণে গুণান্বিত হতে পারে। রমাদান মাসে সিয়াম পালনের মাধ্যমে সেই বিরাট সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়। যে কারণে রমাদানের সিয়াম পালন করার পর ঈদ-উল-ফিতরের আগমন এক বিশেষ অনন্যতা লাভ করেছে। হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, লোভ নয়, অহমিকা নয়, কাম নয়, ক্রোধ নয়, সংযমী জীবন, সংযম ও সহিষ্ণু জীবনই প্রকৃত মনুষ্য জীবন। তাই সব মানুষ মিলে এক মহামিলনের বিশ্ব গড়া অনুভব অনুরণিত হয় ঈদ-উল-ফিতরে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন : হে মানুষ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)। ঈদ-উল-ফিতরের এই চেতনার বাস্তব স্ফুরণ ঘটে। ঈদ-উল-ফিতরকে দানের আনন্দ উৎসবও বলা হয়। ঈদ-উল-ফিতরের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হচ্ছে- দরিদ্রদের সাহায্য করা। বিত্তবানদের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে বিত্তহীনদের মধ্যে ফিতরা বিতরণ করা। কি পরিমাণ ধন-সম্পদের অধিকারী হলে ফিতরা দিতে হবে তাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ঈদের দিন সকালেই ঈদের নামাজ আদায় করতে যাবার পূর্বেই ফিতরা প্রদান করা উত্তম। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন : ফিতরা সিয়ামকে কুকথা ও বাহুল্য বাক্য হতে পবিত্র করে এবং গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের আহার্য যোগায়। তিনি আরও বলেছেন : ফিতরা যারা দেয় তোমাদের সেসব ধনীকে আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র করবেন এবং তোমাদের মধ্যে যারা দরিদ্রদের দান করে আল্লাহ্ তাদের তার চেয়ে অনেক বেশি দান করবেন। ঈদ পরিচ্ছন্ন আনন্দের দিন। আল্লাহর মহান দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করার দিন। এই দিনে যাতে গরিব-দুঃখীরা ধনীদের সঙ্গে আনন্দের সমান ভাগিদার হতে পারে সে জন্য গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার দিন। যাকাত পাবার অধিকারী যারা, ফিতরা পাবার অধিকারী তারাই। ইসলাম ধনীদের ধন-সম্পদে দরিদ্রের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে দিয়েছে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে ন্যায্য অধিকার রয়েছে ভিক্ষুকের এবং বঞ্চিতের। (সূরা যারিয়াত : আয়াত ১৯)। রমাদানের এক মাস সিয়াম পালনের মাধ্যমে সায়িম ধৈর্য, দয়া, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সংযম এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের যে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে সেই প্রশিক্ষণকে জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের দৃঢ় শপথে বলীয়ান হওয়ার আনন্দ উৎসব হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতর। এই দিন আনন্দ করার এবং আনন্দ বিলাবার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত। এই দিন পারস্পরিক প্রাচুর্য কামনার লক্ষ্যে প্রত্যেকের মুখে প্রাণের গভীর থেকে ঈদ মুবারক উচ্চারিত হয় বার বার। ঈদ সব মানুষকে একই উঠোনে এনে দাঁড় করায় এবং সকলকে বুকে বুক মিলিয়ে, গলায় গলা মিলিয়ে এক আনন্দ সৌকর্য বিম-িত হৃদয় দেয়া-নেয়ার অনন্য অনুভব জাগিয়ে তোলে। ঈদ কেবল পার্থিব আনন্দ উৎসব নয়, এ কেবল পার্থিব আমোদ নয়, ঈদ ইবাদতেরও অন্তর্গত। ঈদ মানুষকে আত্মিক উৎকর্য ও পরিতৃপ্তির পথনির্দেশনা দেয় এবং আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের সুপ্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করে। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী অলীয়ে মাদারজাদ হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আল্লায়হি বলেছেন : প্রকৃত রোজাদারদের জন্য ঈদ পৃথিবীতে জান্নাতী সুখের নমুনা। ঈদ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলবার তাকিদে সমুজ্জ্বল। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ একটি জাতি-কুরআন মজিদে উল্লিখিত এই অনন্য চেতনার অনুরণন ও স্পন্দন ঈদ-উল-ফিতরে ভাস্বর হয়ে ওঠে। মানুষে মানুষে ঐক্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক সংযমী জীবনের চেতনাই ঈদ-উল-ফিতরের চেতনা এবং এখানেই নিহিত রয়েছে সিয়াম ভাঙ্গার এই উৎসবের প্রকৃত আনন্দবৈভব। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরিফ
×