ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানহীন ওষুধ দিয়েই টাকা নিয়ে যাচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান

মশার ওষুধের টেন্ডার চক্র ভাঙ্গা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ২৩ মে ২০২০

মশার ওষুধের টেন্ডার চক্র ভাঙ্গা যাচ্ছে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মশা নিধনের ওষুধ শূন্য হয়ে পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। গত কয়েকদিন ধরে সংস্থাটিতে উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ নেই। তবে বিদেশ থেকে ম্যালাথিউন ওষুধ আমদানি করা হলেও সেই ওষুধ ফরমুলেশন করতে না পারায় ব্যবহার উপযোগী কোনও ওষুধ নেই সংস্থাটির ভা-ার বিভাগে। তবে ওষুধ ফরমুলেশনের জন্য দুই দফা টেন্ডার আহ্বান করলেও এখনও তা চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে ডেঙ্গু মৌসুমে ডিএসসিসির এমন অবহেলায় এবারও এডিস মশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, গতবছর ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের পর বিদেশ থেকে সরাসরি ওষুধ আমদানি করার অনুমতি দেয়া হয় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে। এরপর ভারত থেকে ম্যালাথিউন ৫ শতাংশ আমদানি করে ডিএসসিসি। কিন্তু আমদানিকৃত ওষুধটি সরাসরি ব্যবহার উপযোগী নয়। এর সঙ্গে ৯৫ শতাংশ ডিজেল ও ২৫ থেকে ৫০ এমএল সাইট্রোনেলা মিশ্রিত করে নগরীতে ছেটাতে হয়। এজন্য ডিজেল এবং ওষুধের ফরমুলেশন সঠিক হতে হয়। আর এই কাজটি করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব কোনও প্রযুক্তি নেই। এজন্য দ্বিতীয় পক্ষ দিয়ে কাজ করতে হয় নগর ভবনকে। আর এই কাজটি সম্পন্ন করতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ৬ লাখ ৪০ হাজার লিটার এ্যাডাল্টি সাইটিং ওষুধের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে ডিএসসিসি। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় দ্য লিমিট এ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি লিটার ওষুধের ফরমুলেশন করতে দর দেয় ১৭২ টাকা। কিন্তু গতবছর মানহীন ওষুধ সরবরাহের অভিযোগ থাকায় প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়নি। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি পতি লিটারের জন্য দর দেয় ১৮৫ টাকা। আর তৃতীয় অবস্থানে ছিল জাহিন কনস্ট্রাকশন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি লিটারের দর দেয় ১৯৫ টাকা। কিন্তু প্রথম অবস্থায় কোনও প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ না দিয়ে ফের টেন্ডার আহ্বান করে ডিএসসিসি। পুনর্টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি সর্বনিম্ন দর দেয় ১৫৫ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মেসার্স দ্য লিমিট এ্যাগ্রো প্রোডাক্ট দর দিয়েছে ১৬৩ টাকা। তৃতীয় অবস্থান থাকা মেসার্স নোকন লিমিটেড দর দেয় ১৮৩ টাকা। আর মেসার্স মার্শাল এ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড চতুর্থ অবস্থান থেকে দর দেয় ১৮৯ টাকা। এদিকে টেন্ডার কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় ওষুধ সঙ্কটে পড়ে ডিএসসিসি। এ সময় সঙ্কট মেটাতে প্রথম ধাপে সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়া মেসার্স মার্শাল এ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে এক লাখ লিটার ওষুধ দেয়ার জন্য মৌখিকভাবে অনুরোধ করে ডিএসসিসি। প্রথম দফায় প্রতিষ্ঠানটি ডিএসসিসিকে ৬০ হাজার লিটার ওষুধ ফর্মুলেশন করে দেয়। তবে এই ওষুধের গুণগতমান পরীক্ষা করার জন্য খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পাঠানো হলে তাতে মান উত্তীর্ণ হয়নি। ফলে বাকি ওষুধ আর নেয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটি থেকে। এদিকে দ্বিতীয় দফায় সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেয়ার জন্য সংস্থার তৎকালীন দায়িত্বে থাকা মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের দফতরে পাঠানো হয়। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে গতবছর ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দ্য লিমিট এ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এমন অভিযোগে সেই ফাইল সই করেননি তিনি। তবে বিষয়টি নিয়ে গত ১৫ মে মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, কিভাবে কখন কার থেকে ওষুধ নেয়া হচ্ছে তা আমাকে জানানো হয়নি। টেন্ডারের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে একটি চক্র চড়িয়ে পড়ে। পরে অনুসন্ধান করে দেখি গত বছর যারা ওষুধ সরবরাহ করেছে; যাদের ওষুধ নিয়ে মানহীনতার অভিযোগ উঠেছিল। এ বছরও তারা ওষুধ সরবরাহের কার্যাদেশ পাচ্ছে। পরে আমি সেটা রিটেন্ডার করি। এতে যে প্রতিষ্ঠানটি এসেছে সেটিও একই চক্রের প্রতিষ্ঠান। তাই আমি অনুমোদন দেইনি। এখন বর্তমান প্রশাসন দেখবে তারা কী করবে। ভান্ডার সূত্র আরও জানায়, এভাবে টেন্ডার কার্যক্রম চলতে চলতে ছয়মাস চলে গেছে। এরই মধ্যে ডিএসসিসির ভান্ডারে ব্যবহার উপযোগ ওষুধ শেষ হয়ে যায়। ফলে নগরীতে উড়ন্ত মশা নিধনে এখন ফগিং করা হচ্ছে না। ফলে মশার উৎপাত বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ১৫ মে পর্যন্ত ৩০১ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। দক্ষিণ সিটির একাধিক মশক সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফগিং করার জন্য ভান্ডার বিভাগ থেকে কোনও ওষুধ দেয়া হচ্ছে না। যেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেখানে ডিজেলের সঙ্গে কয়েক ফোটা ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওই ওষুধ ব্যবহার উপযোগী নয়। কখনও কখনও আমরা মানুষকে বুঝ দেয়ার জন্য শুধু ডিজেল ছিটিয়ে ধোঁয়া দিয়ে আসি। যাতে মানুষ দেখে আমরা মাঠে আছি। কিন্তু আমাদের কাছে কোনও ওষুধ নেই। ভান্ডার বিভাগ ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, সামনে আমাদের ডেঙ্গু সিজন শুরু হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো বিষয়টি আমরা আগে থেকেই জানলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। এজন্য টেন্ডার প্রক্রিয়াটি কীটনাশক মজুদ থাকা অবস্থায় করা উচিত ছিল। এক বছর আগ থেকেই মজুদ করলে সমস্যা হতো না। এটা আসলে ক্রয় প্রক্রিয়ার বিষয়। সরকারের ক্রয়নীতিতে নানা রকম নিয়ম আছে। নিয়মের ফাঁদের আমরা অনেক সময় আটকা পড়ে যাই। তবে এই প্রক্রিয়াটা শেষ করা উচিত। সিটি কর্পোরেশন চাইলে সরকার থেকে অনুমোদন নিতে পারে। আর যাদের কাছ থেকে ওষুধ ক্রয় করা হচ্ছে তাদের থেকে একসঙ্গে রেডি ফর ইউজ বা ফর্মুলেশনসহ ওষুধ নেয়া যেতে পারে। তাহলে সমস্যা হবে না। আলাদা চার্জও অনেক কমে আসত। তিনি আরও বলেন, পর্যাপ্ত ওষুধ না ছেটানোর কারণে অলরেডি ঢাকা শহরে এডিস ও কিউল্যাক্স মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে। আর ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা গতবছরের এই সময়ের ছেয়েও অনেক বেশি। এই সময়ে ওষুধ না থাকাটা সিটি কর্পোরেশনের চরম অবহেলা বলে আমি মনে করি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম (উপসচিব) কোনও কথা বলতে রাজি হননি। আর সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মোঃ এমদাদুল হক বলেন, আমরা পর্যাপ্ত মশার ওষুধ আমদানি করেছি। নগর ভবনে আমার ৬ মাস হয়েছে। এ সম্পর্কে আমার চেয়েও আপনি বেশি জানেন। এখন এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
×