ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সীমিত নমুনা পরীক্ষায় প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হচ্ছে

করোনা মারাত্মক রূপ নিচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৫০, ২২ মে ২০২০

করোনা মারাত্মক রূপ নিচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ দেশের করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, উপসর্গহীন রোগী এবং সন্দেহজনক করোনা রোগীদের তথ্য গোপন করার প্রবণতা দেশের সর্বত্র করোনা সংক্রমণের প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এই সুযোগে করোনার নীরব সংক্রমণ ঘটছে। সীমিত নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র জানা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। বৃহস্পতিবারও দেশে একদিনে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের নতুন রেকর্ড হয়েছে। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না মানুষ। বাসার বাইরে হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেকগুণ। রাস্তাঘাট, অলি-গলি, বাজারসহ সর্বত্রই মানুষের ভিড়। শহরাঞ্চলে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে যানবাহনগুলোর জট। ন্যূনতম সুরক্ষার উপাদান মাস্ক না পরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে, ঠেলাঠেলি করে বাজার করছেন। কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয় আড্ডা দিচ্ছেন। এদিকে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, দেশে উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বেচ্ছায় বা কোন কারণে নমুনা পরীক্ষা করোনার আগে পর্যন্ত করোনামুক্ত ভেবে তারা সকলের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা অব্যাহত রেখে চলেছেন। আরেক ধরনের রোগী আছেন, যারা নানা পরিস্থিতির আতঙ্কে তথ্য গোপন করে যাচ্ছেন। শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি না হওয়া পর্যন্ত তারা নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী দেখান না। এধরনের রোগীরাও নিজেদের করোনামুক্ত ভেবে বাসার ভেতরে ও বাইরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ান। সন্দেহজনক করোনা রোগীর তথ্য গোপন ॥ তথ্য গোপন করে যাচ্ছেন অনেক সন্দেহজনক করোনা রোগী। নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে আগ্রহ দেখায় না। বিভিন্ন মিডিয়ায় কোভিড হাসপাতালগুলোর চিকিৎসসেবার অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। পাশাপাশি তাদের মধ্যে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, বাড়ি লকডাউন এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আতঙ্ক কাজ করে। তাই বাসায় অবস্থান করে নিজ নিজ উদ্যোগে চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন করোনা সন্দেহজনক রোগীরা। শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি না হওয়া পর্যন্ত তারা নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না এবং হাসপাতালেও যাচ্ছেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা মহামারী ভাইরাসরোধে সরকারের প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে দিতে পারে। তাদের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ জাতির জন্য নীরব ঘাটক হয়ে উঠতে পারে। যেসব রোগী তাদের লক্ষণ ও তথ্য গোপন করে চিকিৎসাসেবা নিতে আসছেন তাদের সংস্পর্শে আসায় অনেক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী মারাত্মক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়া নিয়ে তাদের যে ভয় তা দূরীকরণের পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা হবে, তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের মনোনিবেশ করা উচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ডাঃ অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, সামাজিকভাবে হেয় এবং বিচ্ছিন্নতার ভয়ে অনেকের মধ্যে করোনার লক্ষণ ও চিকিৎসার ইতিহাস গোপন করার একটি বিপজ্জনক প্রবণতা গড়ে উঠেছে। এই ব্যক্তিরা নিজের পাশাপাশি তাদের পরিবার, প্রতিবেশী এবং দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। করোনার লক্ষণ দেখা দিলে মানুষকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং পরীক্ষা করানো উচিত বলে জানান উপাচার্য। তিনি আরও বলেন, কলঙ্ক না মনে করে প্রত্যেকেরই করোনাকে অন্যান্য রোগের মতো রোগ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যদি কেউ স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ না করে তবে তারা এতে সংক্রমিত হতে পারেন। তবে তাদের এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। কারণ ৮০ শতাংশ মানুষ কেবল বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসরণ করে হাসপাতালে না গিয়েই সুস্থ হতে পারেন। অনেকেই মনে করেন যে করোনা পজেটিভ হলে তাদের তুলে নিয়ে আসোলেশন কেন্দ্রে রাখা হবে এবং তাদের বাড়ি লকডাউন করে দেয়া হবে। তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নেতিবাচক আচরণ করা হবে এবং তাদের বর্জন করা হবে। এজন্য তারা কোভিড -১৯ পরীক্ষায় আগ্রহী নন। এমনকি, তাদের মধ্যে কিছু চিকিৎসকের কাছে আসলেও তারা চিকিৎসার ইতিহাস এবং তাদের অবস্থান গোপন করেন। আমাদের এই সমস্যা সমাধান করা দরকার। তা না হলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ এই ব্যক্তিদের করোনা শনাক্ত হবে না এবং তাদের পরিবারের সদস্য ও তাদের সংস্পর্শে আসা অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে থাকবে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, চিকিৎসার ইতিহাস এবং করোনাভাইরাসজনিত লক্ষণ গোপন করায় ওইসব রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে কিছু চিকিৎসক ও নার্স সংক্রমিত হয়েছেন। মানুষজনকে বুঝতে হবে যে তারা যদি ভুল তথ্য দিতে থাকেন তবে চিকিৎসকরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন এবং তাদের প্রতি আস্থা হারাবেন। রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের সঠিক তথ্য এবং চিকিৎসার ইতিহাস জানতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ডাঃ বেনজির আহমেদ বলেন, ম্যানেজমেন্টটাই এমনভাবে করতে হবে যেন মানুষ তথ্য গোপন না করে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো দরকার ছিল, যার যা সমস্যা তার সমাধান তারা পাবেন, তাহলে রোগী তথ্য গোপন করতেন না। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকে এখন এমনভাবে সাজাতে হবে যেন যার যে চিকিৎসা দরকার সেটুকু তারা পান, যাতে করে তাকে মিথ্যা না বলতে হয়। তাই আগে যেসব ‘অপকর্মগুলো’ করা হয়েছে, সেখান থেকে অতিসত্বর সরে আসতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, মানুষকে যদি সব চিকিৎসা না দেয়া হয়, তাহলে মানুষ মিথ্যাই বলবে এবং কেউ কেউ শুধু সেবা না পাওয়ার কারণে মারা যাবে। উপসর্গহীন করোনা রোগী ॥ করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জটিল করে তুলছে উপসর্গহীন করোনা রোগী। মোট শনাক্তের প্রায় এক-চতুর্থাংশ রোগীর মধ্যে দৃশ্যমান উপসর্গ নেই বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় কম নমুনা পরীক্ষার কারণে দেশের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র অজানা রয়ে গেছে। এর মধ্যে উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে দেশের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। উপসর্গহীন রোগীরা করোনামুক্ত ভেবে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়িয়ে দেদার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটাবে, যা এক ধরনের নীরব ঘাতক। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে উপসর্গ থাকা রোগীর চেয়ে উপসর্গহীন করোনা রোগীর অবাধ বিচরণ খুবই ভয়ানক ও আতঙ্কের। আমরা ধরে নিতেই পারি যে, যত মানুষ করোনা পজেটিভ বলে চিহ্নিত হচ্ছেন, তার অন্তত ১০ গুণ মানুষ কিন্তু উপসর্গহীন অবস্থায় ভাইরাসটা বহন করছেন এবং অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র। কারণ উপসর্গহীন রোগীকে পরীক্ষা করানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ওই রোগী নিজেও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। উপসর্গ না থাকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজনের শরীর একেক রকম আচরণ করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে সংক্রমণের পরেও কারও হয়তো উপসর্গ দেখা গেল না। অথচ অন্য কাউকে তিনিই সংক্রমিত করলেন এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি হয়তো মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাসায় অবস্থান এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমেই উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, অনেক দিন ধরেই কিছুসংখ্যক উপসর্গহীন করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত এই সংখ্যা মোট আক্রান্তের এক-চতুর্থাংশ হতে পারে। এমন রোগীর সংখ্যা বড় কথা নয়, করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জটিল করে তুলবে উপসর্গহীন করোনা রোগী। এক্ষেত্রে বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সরকার প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ মেনে চলতে হবে। বাসায় অবস্থান করলে এবং বাইরের যেকোন ব্যক্তির কাছ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। একই পরামর্শ দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ টিটু মিয়া জানান, শনাক্তকৃত করোনা রোগীদের অনেকের শরীরেই উপসর্গ মিলছে না। শনাক্তকৃত রোগীর কন্টাক্ট ট্রেসিং করতে গিয়ে সন্দেহজনকভাবে উপসর্গহীন ব্যক্তিকে পরীক্ষায় আওতায় আনা হয়। অন্যথায় স্বাভাবিক সুস্থ ব্যক্তিকে পরীক্ষায় আওতায় আনার প্রয়োজনবোধ করা হয় না। ফলে উপসর্গহীন করোনা রোগী বিরামহীনভাবে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটায়, যা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেও বুঝতে পারেন না। এমন করোনা রোগী নিঃসন্দেহে করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রম ব্যাহত করবে। সীমিত নমুনা পরীক্ষা ॥ করোনার নমুনা পরীক্ষার হার প্রত্যাশিত জায়গায় নিয়ে যেতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমানে শনাক্তকৃত রোগীর ৯ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করতে পারছে বাংলাদেশ। কিন্তু বিশে^র করোনা আক্রান্ত অন্যান্য দেশসমূহ শনাক্তকৃত রোগীর তুলনায় অনেকগুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশে পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ১৩ থেকে ১৬ শতাংশ, যা বিশে^র করোনা আক্রান্ত প্রায় ১৮০টি দেশের চেয়ে বেশি। ১৯ মে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ডোমিটার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে করোনার পরিস্থিতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।
×