ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরা ধ্বংসস্তূপ ॥ আমফানের তাণ্ডব

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২২ মে ২০২০

সাতক্ষীরা ধ্বংসস্তূপ ॥ আমফানের তাণ্ডব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিধ্বংসী রূপ নিয়ে বুধবার রাতব্যাপী তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আমফান। দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোকে পরিণত করেছে বিধ্বস্ত জনপদে। সৃষ্টি করেছে মানবিক সঙ্কটের। আবহাওয়া অফিসের হিসাব মতে, এটি বৃহস্পতিবার সকালে দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপের রূপ নিলেও এদিনও সারাদিনই এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঝড়ের তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। আমফানই একমাত্র ঘূর্ণিঝড় যার প্রভাব ছিল সারাদেশের ওপর। ঝড়ে আঘাত থেকে কোন জেলা বাদ পড়েনি। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলের জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি তা-বলীলা চালিয়েছে আমফান। এর প্রভাবে প্রাণহানি কম হলেও সম্পদে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এদিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের বৃহস্পতিবার থেকেই ঘর নির্মাণ, অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে আমফানের প্রভাবে প্রচণ্ড ঝড় ও বৃষ্টির কারণে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১৯ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। জোয়ারে অথৈ পানিতে ডুবে গেছে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। হাজার হাজার মানুষ পানি বন্দী হয়ে এখন মানবেতর জীবন-যাপনের হাতছানি। বাঁধ ভেঙ্গে ভেসে গেছে হাজার হাজার চিংড়ি ও মাছের ঘের। বাড়িঘর জনপদ ভাসছে এখন সমুদ্রের লোনা পানিতে। আবহাওয়া অফিস জানিয়ে সম্প্রতি অতীতে এতবড় ঘূর্ণিঝড় এই জনপদে আঘাত করেনি। এটি যখন বুধবার বিকেল ৫টায় সাতক্ষীরা ও সুন্দরবনের ওপর দিয়ে দেশের উপকূলে আঘাত হানে তখন এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার। শুধু উপকূলীয় এলাকা নয় দেশের অধিকাংশ জেলায় এটি ১শ’ কিলোমিটারের বেশি বেগে আঘাত হানে। এর আগে কোন সাগরের কোন ঝড় এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেনি। যা আমফানের ক্ষেত্রে হয়েছে। আমফানের প্রভাবে সারাদেশেই ঝড়ে ক্ষতি হয়েছে। তবে ঝড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এই জনপদে অনেক মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। আর উত্তরের জেলায় এই সময়ে প্রধান ফসল আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় সিকিভাগ আম ঝড়ের কারণে ঝরে পড়েছে। বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়েছে দেশের অধিকাংশ এলাকায়। রাস্তায় গাছপালা পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তবে উপকূলীয় এলাকার প্রায় ২৪ লাখ লোকজনকে দ্রুত আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার কারণে প্রাণহানি একেবারেই কম হয়েছে এবারের ঝড়ে। ফসলহানিসহ সম্পদের ক্ষতিই হয়েছে বেশি। আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রচ- গতিবেগে আমফান বুধবার সারা রাত তা-বলীলা চালিয়েছে। এটি বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার দিকে দুর্বল হয়ে নিম্নচাপের পরিণত হয়। ওই সময় আমফানের অবস্থান ছিল রাজশাহী পাবনা অঞ্চলের ওপর। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নাগাদের প্রভাবে উত্তরাঞ্চলে ঝড় বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। এটি আঘাত হানার পর ক্রমান্বয়ে যতই স্থলভাগের দিকে এগিয়ে ততই ঝড়ের মাত্রা বেড়েছে। এর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক তা-ব চালিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় সাতক্ষীরা এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঘূর্ণিঝড়টি। এরপর ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা, বাগেরহাট, মাদারীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া হয়ে উত্তর অঞ্চলের দিকে সরে যায়। সেখানে ঝড় বৃষ্টি ঘটায়। ফসলে ক্ষতি করে। জনকণ্ঠের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে জানা গেছে, এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়। জলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, চারটি উপজেলার ২৩টি পয়েন্ট দিয়ে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বহু চিংডি ঘের ও বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল তলিয়ে গেছে। কাঁচা ঘরবাডি ও গাছপালা ভেঙ্গে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এ জেলার আমেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা পড়ে সড়কে যোগাযোগ ব্যাপকভাবে বিঘিœত হয়েছে। সাতক্ষীরা ॥ ঘূর্ণিঝড় আমফানের তা-বে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার বিভিন্ন জনপদ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জেলার ২৩ পয়েন্টে ভেঙ্গেছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। শ্যামনগর-আশাশুনির অসংখ্য স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত পানি আর জলোচ্ছ্বাসে জনপদগুলো এখন ভাসমান দ্বীপে পরিণত হয়েছে। এই জনপদের প্রায় ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছপালা উপড়ে পড়ে আছে রাস্তা ও বাড়ির ওপর। সবজি, ধান ও আমসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের তা-বে গাছ চাপা পড়ে কামালনগরে করিমন নেছা (৪০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। বাকালে মারা গেছে শিক্ষক শামছুর রহমান (৬০)। এছাড়া আশাশুনির প্রতাপনগরের কুলতিয়া গ্রামে প্রতাপ ঘোষ (৫৫) নামের আরও এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানান, প্রাথমিক হিসাবে উপজেলায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার ঘরবাড়ি। আংশিক বিধ্বস্ত বাড়ির সংখ্যা ১১ হাজার। খুলনা ॥ ঝড়-বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (বেড়িবাঁধ) ভেঙ্গে ও বাঁধ উপচে পড়া লবণ পানিতে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মৎস্য, কৃষি, বন, বিদ্যুত ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে বিধ্বস্ত উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা বুধবার বিকেল ৪টার পর থেকে বিদ্যুতহীন অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আমফান খুলনার সর্বত্রই ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলায়। এর পর রয়েছে দাকোপ উপজেলা। এ ছাড়া পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও ক্ষতি হয়েছে। কয়রা উপজেলার মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত ১৪টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ঝড়ে এ জেলায় প্রায় ২ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যশোর ॥ জেলার উপর দিয়ে ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাওয়ার সময় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে আমফান। বিপুল পরিমাণ গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। জেলায় গাছ ও ঘরচাপা পড়ে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে চৌগাছায় গাছচাপায় মা ও মেয়ে নিহত এবং ছেলে আহত হয়েছে। এছাড়া শার্শায় পৃথক ঘটনায় তিনজন এবং বাঘারপাড়ায় একজন নিহত হয়েছে। সব উপজেলাতেই ক্ষতি হয়েছে সবিজ, আম ও লিচুর। ঝড়ে গাছচাপা পড়ে প্রাণহানি ছাড়াও সবজি, ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় বিপুল পরিমাণ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুতি নেয় আম ও লিচুর সিংহভাগই ঝড়ের তা-বে ঝরে পড়েছে। যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ জানান, ঘূর্ণিঝড় আমফানে গাছচাপা পড়ে জেলায় ছয়জন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সবজি, আম ও লিচুর ক্ষতি হয়েছে। তবে বোরো ধান ইতোমধ্যে কাটা হয়ে গেছে বিধায় ধানের ক্ষতি হয়নি। গৃহ বা ফসলের ক্ষতি নিরূপণের জন্য কাজ চলছে। বাগেরহাট ॥ আমফানের প্রভাবে জেলা বাগেরহাটে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৫ হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। ল-ভ- হয়ে গেছে প্রায় ৫শ’ কাঁচা ঘরবাড়ি। হাজার হাজার গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। বিদ্যুতের শতাধিক খুঁটি উপড়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জেলার শরণখোলা, মংলা, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, রামপাল ও সদর উপজেলায় কমপক্ষে ৮টি স্থানে নদীসংলগ্ন বাঁধ ভেঙ্গে ও জলোচ্ছ্বাসে পানি উপচে লোনা পানিতে দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়কের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। কোথাও কোথাও যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। খাবার পানির ডিপটিউবওয়েল পর্যন্ত অনেক স্থানে উপড়ে পড়েছে। পান বরজ, ভুট্টা-তরমুজ-বাঙ্গি খেত, আম, কলা বাগান, পাট ও গ্রীষ্মকালীন সবজিসহ উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে মাঠে থাকা কাঁচা-পাকা বোরো ধান ও আউশের বীজতলা। জেলার সকল নদ-নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ জানান, ‘আমফান’-এর আঘাতে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জেলায় কমপক্ষে ৩৫০টি বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে দুই শতাধিক বাড়িঘর, আর চার হাজার ৬৪৯টি বাড়িঘরের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিরোজপুর ॥ আমফানের প্রভাবে তিনজন নিহত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মৎস্য ঘের ও কৃষির সেক্টরের ক্ষতি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি। বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ে পানি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচাপাকা ২৫ কিলোমিটার রাস্তা। কাঁচাপাকা মিলিয়ে ২৩৪৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলেশ্বর নদের মাঝের চরে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয় ও ফসলের জমি প্লাবিত হয়েছে। জেলার মঠবাড়িয়ায় দুজন ও ইন্দুরকানীতে একজন নিহত হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল বারী জানান, সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ও জোয়ারে পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৬ হাজার ৭৫৫টি মাছের ঘের ও পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ৫ হাজার ৫৭৫ জন মৎস্য চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে পিরোজপুরে মৎস্য খাতে ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পিরোজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবু হেনা মোঃ জাফর জানান, জেলায় ৩৫৭ হেক্টর জমির বোরো ধান মাঠে রয়েছে। আমফানের প্রভাবে পানি বৃদ্ধির কারণে এ ধানের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি, কলা, পান, পেঁপে, মুগ ডাল, চিনাবাদাম, মরিচের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা হচ্ছে। ঝিনাইদহ ॥ ঝড়ে ঘরের ওপর গাছ চাপা পড়ে নাদেরা বেগম (৫০) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরও একজন। বুধবার রাতে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার সকালে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে সুপার সাইক্লোন আমফানে ঝিনাইদহে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার ৬টি উপজেলায় রাতভর তা-ব চালিয়েছে আমফান। ঝড়ে কলাগাছ, পাট খেত, পানের বরজসহ সবজি ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে। এছাড়াও নষ্ট হয়েছে আম ও লিচু। বৃষ্টির কারণে তলিয়ে গেছে পুকুর ঘাট। ঝড়ের কারণে ভেঙ্গে গেছে গাছ-পালা। ভেঙ্গেছে কাঁচা, পাকা-আধাপাকা বাড়ি ঘর। সিরাজগঞ্জ ॥ বুধবার রাতে ঝড়ের কবলে পড়ে দেলশাদ (৩৪) নামের এক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। সিরাজগঞ্জ-কাজিপুর সড়কের চিলগাছা নামক স্থানে গাছের ডাল ভেঙ্গে তার মাথায় পড়লে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এদিকে আমফানের জেলায় বুধবার রাত থেকে দমকা বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এতে জেলার আম, লিচুসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। অনেক জায়গায় গাছ-পালা পড়ে গেছে এতে বিদ্যুত ব্যবস্থারও বিপর্যয় ঘটেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সিরাজগঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১৫২৫ হেক্টর জমির সব্জি বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।ৎ কক্সবাজার ॥ প্রবলশক্তি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ কক্সবাজার উপকূলে আছড়ে না পড়লেও দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় সুপার সাইক্লোন আমফানের প্রভাবে সাগরের পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। জোয়ারের তীব্র গতিতে পানির ¯্রােত বেড়ে উত্তর ধুরুং এলাকা সাগরের সঙ্গে একাকার হয়ে পড়েছে। সুপার সাইক্লোন আমফানের প্রভাবে বৃহস্পতিবার সাগরের পানিতে জোয়ারভাটা হয়ে পড়ে উত্তর ধুরুং অঞ্চল। দিনরাতে দু’বার জোয়ারের অথৈ পানিতে ভাসছে কায়সারপাড়া ও চরধুরুং এলাকা। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে বহু বসতবাড়ি। অমবস্যার জোয়ারের পানির উচ্চতা দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। আমফানের প্রভাবে কুতুবদিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনেক ঘর-বাড়ি ও গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। চাঁদপুর ॥ চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের আম কুড়াতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড় আমফানের প্রভাবে প্রচ- ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙ্গে নিচে পড়ে জান্নাত বেগম (৪০) নামে নারীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার ২০ মে রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। নোয়াখালী ॥ ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেলার হাতিয়ায় ২৪০টি কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া দশ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও রাস্তা ভেঙ্গে গেছে। মাছের ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। শাক সবজিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অবশ্য ঝড়ে কোথায়ও প্রাণহানির কোন ঘটনা ঘটেনি। গলাচিপা ॥ পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নের খরিদা গ্রামে ঘূর্ণিঝড় আমফানে পাঁচ বছরের শিশু রাশাদ মারা গেছে। এদিকে, গলাচিপা উপজেলায় ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় ৪৬৮টি কাঁচা বাড়িঘর সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৬২৪টি ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। মংলা ॥ ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালা ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। প্লাবিত হয়েছে চিংড়ি ঘেরও। বদরগঞ্জ, রংপুর ॥ ঘূর্ণিঝড় আমফানের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়-বৃষ্টিতে গাছের পাতা সংগ্রহ করতে গিয়ে রংপুরের বদরগঞ্জে শাহানা বেগম (৪৫) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আমফানের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন- শাহাব উদ্দিন ॥ বরাবরের মতো এবারও বুক পেতে ঘূর্ণিঝড় আমফানের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ এ বনটি। ঘূর্ণিঝড়টির ফলে সুন্দরবনের গাছগাছালির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কেওড়া গাছের এবং সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বনবিভাগের অর্ধশত পুকুরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন। বৃহস্পতিবার বনমন্ত্রী ঢাকায় সরকারী বাসভবন থেকে ঘূর্ণিঝড় আমফান পরবর্তীকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে এ তথ্য দেন। বনমন্ত্রী জানান, প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী সুন্দরবন বন বিভাগের ১০টির অধিক কাঠের জেটি এবং ৩০টির অধিক স্টাফ ব্যারাকের টিনের চালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বনবিভাগের ৬০টির অধিক পুকুরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। সুন্দরবনের গাছগাছালির মধ্যে কেওড়া গাছ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মন্ত্রী জানান, সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ভেঙ্গে যাওয়া গাছপালা অপসারণ করা হবে না। সুন্দরবন নিজস্ব প্রাকৃতিক ক্ষমতা বলেই এটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামোগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। পুকুরগুলোর লবণাক্ত পানি অপসারণ করা হবে। ব্যবহার উপযোগী করা হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কিছু পুকুর পুনরায় খননের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে সশস্ত্রবাহিনী ॥ এদিকে ঘূর্ণিঝড় আমফান পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ শুরু করেছে সশস্ত্রবাহিনী। জরুরী উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে তারা। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, ঘূর্ণিঝড় আমফান পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সার্বিক ত্রাণ, উদ্ধার ও চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী ॥ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের নির্দেশনায় সেনা সদস্যরা আগে থেকেই ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম, ত্রাণ তৎপরতা ও চিকিৎসাসেবা প্রদানে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। বর্তমানে তারা ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত এলাকাসমূহে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর ১৪৬টি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দল স্বল্প সময়ে মোতায়েনের জন্যও প্রস্তুত রয়েছে। দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকাগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা দিতে সেনাবাহিনীর ৭৬টি মেডিক্যাল টিমও প্রস্তুত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কবলিত স্থানসমূহে খাদ্য সহায়তা হিসেবে সেনাবাহিনীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ১২ হাজার ৫০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ১৬টি ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট ও ১৪টি ওয়াটার বাউজার প্রস্তুত রয়েছে। একইসঙ্গে করোনা মোকাবেলায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর এক হাজার ২৭টি যানবাহনের সমন্বয়ে ৫৩১টি টহল ৬২ জেলায় বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় পাঠানো হয়েছে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এসব টহল দল এবং ইউনিটসমূহ প্রয়োজনে সহায়তা প্রদানের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। নৌবাহিনী ॥ উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ভোলা ও হাতিয়ায় দুর্গম এলাকায় ত্রাণ সহায়তায় নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম নৌ জেটি ত্যাগ করেছে। অন্যদিকে সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে ২২ সদস্যের একটি নৌবাহিনী কন্টিনজেন্ট এবং উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় সাত সদস্যের একটি ডাইভিং টিম কাজ করবে। নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ ৬০০ প্যাকেট নিয়ে ভোলা এবং ৬০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী নিয়ে হাতিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতি বিবেচনায় চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের অন্য জাহাজগুলো দুর্গত এলাকায় জরুরী উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য যাত্রা করবে। খুলনা নৌ অঞ্চল হতে বানৌজা কপোতাক্ষ ২০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী নিয়ে পটুয়াখালী এবং বানৌজা পদ্মা ৩৫০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে যাত্রা করবে। বিমানবাহিনী ॥ বিমানবাহিনীর একটি সি-১৩০ পরিবহন বিমান, একটি এমআই-১৭এসএইচ হেলিকপ্টার, একটি অগাস্টা-১১৯ হেলিকপ্টার এবং একটি বেল-২১২ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা, নোয়াখালী, ঝালকাঠি, কুয়াকাটা ও সুন্দরবন এলাকার ক্ষতি নিরূপণের উদ্দেশ্যে দ্রুততার সঙ্গে পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার ক্ষতির বাস্তব চিত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়। এছাড়াও ১১৯ জন বিমানবাহিনীর সদস্যের (চারজন কর্মকর্তা, ৮১ জন বিমানসেনা ও ৩৪ জন বেসামরিক সদস্য) একটি টিম আমফান পরবর্তী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে বিমানবাহিনীর নিজস্ব পরিবহনে সাতক্ষীরায় গেছে। উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় আমফান পরবর্তী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিমানবাহিনীর ছয়টি পরিবহন বিমান এবং ২৯টি হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
×