ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ পর্যন্ত ৩১ স্বর্ণজয়ী জাতীয় এ্যাথলেট সুমি আক্তারের দিনলিপি

স্বর্ণপদক জেতাই তার নেশা

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ২০ মে ২০২০

স্বর্ণপদক জেতাই তার নেশা

রুমেল খান ॥ ওজন মাত্র ৩৮ কেজি। উচ্চতাও বেশি নয়, ৫ ফুট। ছোটখাটো ও একেবারেই শুকনো গড়নের কৃষ্ণকলি কন্যাটির চেহারা দেখলেই মনে হবে, এ মেয়ে আর যাই হোক, কোন প্রতিযোগিতায় তা¤্রপদকও জিততে পারবে না। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন, মেয়েটি সবসময় স্বর্ণই জেতে। আর কালেভদ্রে জেতে রূপা! যার নাম সুমি আক্তার। সুমির জন্ম মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার হানদুলিয়া গ্রামে, ১০ আগস্ট, ১৯৯৭। চাকরিসূত্রে নিবাস ঢাকার সিএমএইচ-এর জয়িতা বিল্ডিংয়ে। মজার ব্যাপারÑ কোন জুনিয়র পর্যায় নয়, একেবারে সরাসরি সিনিয়র পর্যায়েই এ্যাথলেটিক্স ক্যারিয়ার শুরু করেন সুমি! জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় এ পর্যন্ত তার অর্জিত মোট স্বর্ণের সংখ্যা ৩১টি (বিজেএমসির হয়ে ২টি, সেনাবাহিনীর হয়ে ২৯টি)। এছাড়া জিতেছেন ১০টি রৌপ্যপদকও। সুমি মোট ৫টি ইভেন্টে খেলেন। এগুলো হলো : ৪০০, ৮০০, ১৫০০ ও ৩০০০ মিটার দৌড় এবং ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলে। ২০১৯ সালের জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ৪টি স্বর্ণ ও ১টি রৌপ্যপদক জিতে আসরের সেরা এ্যাথলেট নির্বাচিত হয়েছিলেন। করোনা-ক্রান্তিকালে কেমন আছেন সুমি? ‘বাসা থেকে একদমই বের হওয়া মানা। অনুশীলন বন্ধ মাসখানেকেরও বেশি। তাই এখন ফিটনেস বলতে কিছুই নেই। তবে করোনার টেনশনে ওজন কিন্তু বাড়েনি! ওজন নিয়ন্ত্রণেই আছে।’ জনকণ্ঠকে জানান সুমি। সুমি যে ১৪ তলার যে বিল্ডিংয়ে থাকেন, সেটা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এখানকার নিয়মকানুন খুবই কড়াকড়ি। এখানে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে গেলেও তাদের অনুমতি নিতে হয়। এক রুমের মেয়ে আরেক রুমে যেতে পারে না। অনেকটা জেলখানার মতোই। তবে পরিবেশটা অনেক সুন্দর। একঘেঁয়েমি লাগার কোন কারণ নেই। করোনা-সতকর্তা হিসেবে বাসায় নিয়মিতই সাবান দিয়ে হাত ধোন সুমি। তিনি থাকেন ১৩ তলায় (এক রুমে থাকেন দুজন করে)। তাদের ডাইনিং হচ্ছে নিচতলায়। সেখানে যাবার আগে সঙ্গে টিস্যু নিতে হয়। ওখানে একটা ঝর্ণা সিস্টেম আছে। ওখানে মিনিট দশেক কাটিয়ে তারপর ঢুকতে হয়। মোটকথা, এই কড়া নিয়মের জেরেই সুমিরা সবাই খুবই সুরক্ষিত ও সুস্থ আছেন। সুমির অবসর কাটে মোবাইলে ও বাসার সবার সঙ্গে গল্পগুজব করে। টিভি দেখার জন্য ১৩ তলায় ব্যবস্থা আছে। তবে করোনায় সংক্রমণের ভয়ে সেখানে যান না তিনি! তাই করোনা সংক্রান্ত অনেক তথ্যই জানেন না। অন্যদের কাছ থেকে ভাসা ভাসা যতটা খবর পান, ততটাই জানেন। ভারতে গোমূত্র পান করলে, বাংলাদেশে থানকুনি পাতা খেলে ও নারকেল গাছের গোড়ায় জল ঢাললে করোনা হবে নাÑ অনেকের এমন কর্মকা-কে পুরোটাই ‘কুসংস্কার’ বলে মনে করেন সুমি। অঘোষিত লকডাউনের ফলে নিম্ন আয়ের মানুষরা চরম খাদ্যসংকটে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে সুমির ভাষ্য, ‘যতদূর জানি সরকার তাদের যথেষ্ট সাহায্য করছে। কিন্তু আবার শুনেছি কিছু জনপ্রতিনিধি এসব ত্রাণ-সাহায্য আত্মসাৎ করছে। যদি এমনটা হয়, তাহলে এটা ভীষণ অন্যায়। তারা যদি সত্যিই এমনটা করে থাকে, তাহলে তাদের অবশ্যই কঠোর শস্তি হওয়া উচিত।’ অনেক ক্ষেত্রেই হাসপাতালে গেলে ডাক্তাররা রোগী দেখতে চান না, এ প্রসঙ্গে সুমির অভিমত, ‘এগুলো ঠিক হচ্ছে না। তবে ঠা-া-জ¦র হলেই করোনা হয়েছে, এমনটা ভাবাও ঠিক নয়। সেক্ষেত্রে আগে নিশ্চিত হতে হবে ব্যাপারটা। আর ডাক্তারদের অবশ্যই রোগীদের প্রতি আরও মানবিক হতে হবে। কেননা চিকিৎসা পাবার অধিকার সবারই আছে।’ দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে সুমি সবার ছোট। বাবা কৃষক আবদুল খালেক। মা গৃহিণী হামেলা খাতুন। সুমি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি। তাদের পদের নাম ল্যান্স কর্পোরাল। আগে ছিলেন বিজেএমসিতে। সেখানে সুমির পারফরম্যান্স দেখে এ্যাথলেট কোচ ও সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার মোহাম্মদ ফারুক সুমিকে সেনাবাহিনীতে চাকরি করার প্রস্তাব করেন। এভাবেই সেনাবাহিনীতে আসা সুমির। তার প্রিয় এ্যাথলেট ভারতের হিমা দাস (৪০০ মিটার)। সুমি ২০১৯ এসএ গেমসে অংশ নিয়ে ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতে জিতেছিলেন দলীয় তা¤্রপদক। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার দুলনা বিএম উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুলে সুমি পড়তেন, সে স্কুলের সালাউদ্দিন স্যারের উৎসাহেই এ্যাথলেটিক্স খেলা শুরু তার। জেলা পর্যায়ের এ্যাথলেটিক্স দিয়েই শুরু। এবং শুরু থেকেই চোখ ধাঁধানো সাফল্য। তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন সুমি। এখন পড়েন ¯œাতকে পড়েন (উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে)। তারপর বিজেএমসিতে যোগ দেন সুমি। তারপর সেনাবাহিনীতে। সেখানে কোচ ফারুকের পরামর্শে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট বাদ দিয়ে দূরপাল্লার দৌড় খেলতে শুরু করেন সুমি। এরপর থেকেই লাগাতার প্রতিটি জাতীয় আসরে অংশ নিয়ে চারটি করে স্বর্ণ জিতে আসছেন (২০১৫ থেকে)। গত বছরের জানুয়ারির কথা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জাতীয় এ্যাথলেটিক্সের সর্বশেষ ইভেন্টটি ছিল মহিলাদের ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার দৌড়। এই ইভেন্টে শুরু থেকেই ভাল পজিশনে থেকেও সুমির সেনাবাহিনী দ্বিতীয় হয়ে স্বর্ণপদক হারায় (স্বর্ণ জেতে নৌবাহিনী)। স্বর্ণ জিতলে সুমির স্বর্ণসংখ্যা দাঁড়াত ৫-এ। সেটা না হওয়াতে ক্ষণিকের জন্য সুমির মনটা আক্রান্ত হয়েছিল বিষণœতায়। কিন্তু পরক্ষণেই যখন জানতে পারেন তার দল সেনাবাহিনী এই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তখন মুহূর্তেই সব কষ্ট দূর হয়ে যায় তার। কারণ গত সামার চ্যাম্পিয়নশিপে এই নৌবাহিনীর কাছেই হেরে রানার্সআপ হয়েছিল সেনাবাহিনী। আগে অবশ্য শুধু ৮০০ মিটার দৌড়েই অংশ নিতেন সুমি। এরপর থেকেই লাগাতার প্রতিটি আসরে অংশ নিয়ে চারটি করে গোল্ড জিতে আসছেন। সামার এবং ন্যাশনাল প্রতিযোগিতা মিলে ২৩ বছর বয়সী সুমির মোট স্বর্ণসংখ্যা কপালে চোখ উঠিয়ে দেয়ার মতো, ৩১টি! দরিদ্র কৃষক বাবার মেয়ে সুমি। সুমি সবার ছোট। বড় ভাই বিবাহিত। বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তিনিই সংসার চালান। সুমি ভাগ্যবতী এজন্য, শুরু থেকেই তার খেলাধুলা নিয়ে কোন বাধা দেননি বাবা-মা, বরং উৎসাহ দিয়েছেন। ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘আমার ক্যারিয়ারের ২০ স্বর্ণপদকের একটিও রেকর্ড টাইমিং গড়ে আসেনি। এজন্য আমি চাই আমার প্রিয় ইভেন্ট ৪০০ মিটারে রেকর্ড টাইমিং গড়ে স্বর্ণ জেতার।’ ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং ভারতে গিয়ে মোট চারবার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন সুমি। ওখানে তার সেরা সাফল্য হলো ৪০০ মিটারে চতুর্থ হওয়া। সেনাবাহিনীতে অনুশীলনের জন্য ভাল সুযোগ-সুবিধা আছে বলে জানান সুমি, ‘এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেও এসে আমরা অনুশীলন করতে পারি। ফেডারেশন যদি আমাদের দীর্ঘমেয়াদী ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ দেয়, তাহলে নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমি ভাল ফল করতে পারবো।’ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এ্যাথলেটিক ট্র্যাক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুমি, ‘রানিং শু পড়ে যখন দৌড়ের সময় স্পিড বাড়াই, তখন ছেঁড়া ট্যাকে শু আটকে যায়। এতে বড় ধরনের ইনজুরিতে পড়তে পারি। আশা করি পরেরবার খেলতে আসলে ভাল-উন্নত ট্র্যাক যেন দেখতে পাই।’ নারী কিংবা পুরুষ। দেশের অধিকাংশ এ্যাথলেটই আসেন নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। ফলে জন্ম থেকেই তাদের বেশিরভাগই ভোগেন পুষ্টিহীনতায়। যে কারণে এই ইভেন্টে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেলে না উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য। তাই সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ্যাথলেটদের পুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে একটি আলাদা পরিকল্পনার দাবি খেলোয়াড়দের ও বিশ্লেষকদের। সেই সঙ্গে ফেডারেশনকে সুমি পরামর্শ দিলেন একজন স্থায়ী পুষ্টিবিদ নিয়োগে। অলিম্পিক, এশিয়াড কিংবা এসএ গেমসের এ্যাথলেটিক্স ইভেন্টে পদকজয়ের স্বপ্ন ভুলে যান। মাত্র ৩৮ কেজি ওজনের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ্যাথলেট সুমি আক্তারকে দেখুন। ২০ স্বর্ণজয়ী দেশসেরা এই এ্যাথলেট ভুগছেন মারাত্মক পুষ্টিহীনতায়। জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণজয়ে তৃপ্ত এসব এ্যাথলেটের শ্যেন দৃষ্টি আন্তর্জাতিক আসরেও ভালো করার। তবে সেক্ষেত্র বড় বাধার নাম ফিটনেস সমস্যা। আর যার মূলে রয়েছে এই পুষ্টিহীনতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের এ্যাথলেটদের প্রায় ৮৫ ভাগই ভোগেন পুষ্টিহীনতায়। যার জন্য মেলে না কাক্সিক্ষত সাফল্য। এ সমস্যার উত্তরণে ফেডারেশনের পাশাপাশি কাজ করার তাগিদ দিলেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেও। আলাদা করে নিয়োগ দিতে হবে একজন পুষ্টিবিদও। এখান দেখার বিষয়, আগামীতে নিজের অপুষ্টিহীনতা ঘুঁচিয়ে কতটা সাফল্য পান সুমি।
×