ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কল্যাণমুখী বৃহত্তম বাজেট চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২০ মে ২০২০

কল্যাণমুখী বৃহত্তম বাজেট চূড়ান্ত

এম শাহজাহান ॥ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সর্ববৃহৎ কল্যাণমুখী বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। করোনাসহ যে কোন ভাইরাস সংক্রমিত রোগের চিকিৎসা সহজীকরণ এবং স্বল্প ব্যয়ের মধ্যে নিয়ে আসতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ করছে সরকার। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদনে ভর্তুকি, নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে নতুন বাজেটে। করোনার কারণে যারা চাকরি হারিয়েছেন কিংবা যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের দ্রুত কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া রফতানি আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, চলতি বিনিয়োগ আরও উৎপাদনমুখী করা, পদ্মা সেতুসহ দশ মেগা প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নেরও কৌশল থাকছে আগামী বাজেটে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাজেটে বিশেষ কর্মসূচী ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী ১১ জুন বৃহস্পতিবার মহান সংসদে বাজেটের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এবারও সর্বকালের সবচেয়ে বড় বাজেট দেয়া হচ্ছে। বাজেটের সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত আকার কিছুটা বাড়ানো বা কমানো হতে পারে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাইডলাইন অনুসরণ করে এবারের নতুন বাজেটে করোনা সঙ্কট উত্তরণ ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে বাজেট নিয়ে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে বাজেট প্রণয়নের নির্দেশনা প্রদান করেন। এদিকে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সর্বক্ষেত্রে কর ছাড় দেয়া হবে। সকল পর্যায়ের বাণিজ্যিক কর্মকা- সচল করতে একটি ব্যবসাবান্ধব বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেটের মূল উদ্দেশ্য জনকল্যাণ। করোনা পরিস্থিতিতে আগে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। এ কারণে এবার জীবনমুখী বাজেট দেবে সরকার। তিনি বলেন, করোনা সঙ্কট একটি বৈশ্বিক সমস্যার নাম। বাংলাদেশ এ সমস্যায় আক্রান্ত এবং এর একটি নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে। তবে বাজেটে যেসব কর্মসূচী নেয়া হবে আশা করছি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতি উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণোদনা প্যাকেজ একটি যুগান্তকারী ও সাহসী পদক্ষেপ। তিনি বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনায় এবারের বাজেট স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতে দ্বিগুণ বরাদ্দ ॥ জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশেষ কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে। করোনার মতো যে কোন ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ দ্বিগুণ করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, স্বাস্থ্য গবেষণায় জোর দেয়া, ভ্যাকসিন ও ওষুধ আবিষ্কারে গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানো হবে। প্রতিটি সরকারী জেনারেল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করার কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। এদিকে, চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০২০) বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের জন্য ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালন ব্যয় ১০ হাজার ৭ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ৯ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। তবে এবার করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এ খাতের উন্নয়ন ব্যয় দ্বিগুণ করা হবে। গত দশ বছরে সারাদেশে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা এবং এমবিবিএস কোর্সের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ৪৬টি থেকে এখন ১১১টিতে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে এমবিবিএস কোর্সের সংখ্যা ২ হাজার ৫০টি থেকে ১০ হাজার ৩০০ টি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) স্বাস্থ্য খাতের ৫৭টি প্রকল্প আছে। প্রকল্পগুলোর ৪৩টি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের। বাকিগুলো পরিবারকল্যাণ বিভাগের। মোট উন্নয়ন বরাদ্দ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেয়ায় স্বাস্থ্য বাজেটে উন্নয়নের ভাগ বেড়েছে। করোনা রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট ॥ করোনার ছোবল থেকে জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি রফতানি আয় বৃদ্ধি ও করোনা পরবর্তী বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ নজর দেয়া হবে। করোনা সঙ্কটের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। আশা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। এজন্য প্রণোদনার অর্থ দ্রুত ছাড়করণ, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা নিশ্চিত করা, উৎপাদিত পণ্যের দেশী-বিদেশী বাজার সৃষ্টি, রেমিটেন্স আহরণে প্রণোদনা অব্যাহত রাখার মতো কর্মসূচী রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর বিশ্বে এমন ভয়াবহ সঙ্কট আর দেখা যায়নি। এই সঙ্কটকে ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এত খারাপ সময় আর কখনই আসেনি। করোনার কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়ছে। এখন যেভাবেই হোক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ ॥ করোনার অর্থনেতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে কৃষি সেক্টরে বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ৬৭২ কোটি ১১ লাখ টাকা। ১৮৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নে এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে এ সেক্টরে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৮ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। ফলে আরএডিপির তুলনায় বরাদ্দ বাড়ছে এক হাজার ৭৫১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। কৃষি সেক্টরের নতুন এ বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায়ও বেশি। মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৬১৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এ হিসেবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ৮০৮ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ড. শামসুল আলম এ বাড়তি বরাদ্দকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজেটে অবশ্যই স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। কেননা একদিকে মানুষের জীবন বাঁচানো, অন্যদিকে বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
×