ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় অশনি সঙ্কেত ॥ বন্ধ হতে পারে আরও কিছু সিনেমা হল

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২০ মে ২০২০

করোনায় অশনি সঙ্কেত ॥ বন্ধ হতে পারে আরও কিছু সিনেমা হল

মনোয়ার হোসেন ॥ দুই মাস ধরে বন্ধ আছে দেশের সকল প্রেক্ষাগৃহ। মহামারীর ক্রমবর্ধমানশীলতায় শারীরিক দূরত্ব মেনে হল চালু হওয়ার সময়টিও এখন অনিশ্চিত। করোনাভাইরাসের কারণে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ থাকার সময়সূচী দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমন বাস্তবতা সারাদেশের সিনেমা হলের জন্য অশনি সঙ্কেতে পরিণত হয়েছে। নিভে যেতে পারে আরও কিছু সিনেমা হলের আলো। কারণ, ছবি প্রদর্শনীর মাধ্যমে আয়ের সুযোগ বন্ধ হলেও আছে অনেক খরচ। আটকে আছে কর্মচারীদের বেতন। অনেক পুরনো প্রেক্ষাগৃহের মালিকও বেতন দিতে পারছেন না হলের গার্ড, ক্লিনার থেকে শুরু করে লাইট ম্যান, টিকেট বিক্রেতা, ম্যানেজারসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের। বেতন না পাওয়ায় দক্ষ কর্মচারীরা ছুটে গেলে ভবিষ্যতে হল চালাতে হিমশিম খেতে হবে অনেক মালিককে। অনেকের বকেয়া পড়েছে বিদ্যুত বিলও। এমন প্রেক্ষাপটে হল মালিকরা বলছেন, ঋণ করে কোনমতে এখনও হলগুলো চলছে। কিন্তু করোনার প্রভাব দীর্ঘ হলে বন্ধ হবে আরও কিছু প্রেক্ষাগৃহ। সেক্ষেত্রে সরকারী সহায়তা ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবে না এসব হলের। ঢাকাই ছবির সোনালি সময়ে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১২ শতাধিক। এখন সেটা ধূসর স্মৃতি। চলচ্চিত্রের মানহীনতায় প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ হওয়া দর্শকের উল্টোপিঠে ক্রমশ কমেছে হলের সংখ্যা। মৌসুমি হল বাদে বর্তমানে বছরজুড়ে সারাদেশে চালু থাকা সিনেমা হলের সংখ্যা প্রায় ৮০টি। এমনিতেই ধুঁকছিল অধিকাংশ হল। দুই ঈদের ব্যবসা দিয়ে কোনমতে সারাবছরের খরচের বড় একটি অংশ চালিয়ে নেয়া হতো। প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসার প্রতি ভালবাসার টানে অনেকে ভর্তুকি দিয়েও টিকিয়ে রেখেছেন প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু মহামাহারীর অভিঘাত মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়েছে এসব প্রেক্ষাগৃহের জন্য। কিছু হল বন্ধ হওয়ার মতো সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহের মালিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সেই সঙ্কটের কথা। রাজধানীর মতিঝিলের ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল মধুমিতা। পঞ্চাশ বছর পেরুনো এই প্রেক্ষাগৃহের কর্মচারীরা সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসের পুরো বেতন পেয়েছেন। মার্চ মাসের বেতন দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেই বেতন জুটবে না সবার ভাগ্যে। আর এপ্রিল মাসের বেতনের বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্তই হয়নি। এসব তথ্য জানিয়ে মধুমিতার স্বত্বাধিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ জনকণ্ঠকে বলেন, এখন তো অনেক দোকানপাট খুলে গেছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সীমিত পরিসরে হল খোলার অনুরোধ জানাই আমরা কয়েক প্রেক্ষাগৃহ মালিক। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। পরিস্থিতি বুঝলেও বাধ্য হয়েই এই অনুরোধ করেছিলাম। কারণ, প্রদর্শনী বন্ধ থাকায় আমরা কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। তার ওপর আছে নানা রকম বিল ও ট্যাক্স। চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করা হলেও বিদ্যুত বিল প্রদানের ক্ষেত্রে শিল্প-কারখানার মতো সুবিধা মেলে না। বিল দিতে হয় বাণিজ্যিক হারে। তাই হল চালিয়ে এখন আর মুনাফার চিন্তা করা যায় না। বরং গত পাঁচ বছর ধরে ভর্তুকি দিয়ে হল চালিয়ে যাচ্ছি। ছোট প্রেক্ষাগৃহের অবস্থা আরও করুণ। এ অবস্থায় করোনা পরিস্থিতি আরও দুই মাসের বেশি দীর্ঘায়িত হলে বন্ধ হয়ে যাবে কমপক্ষ আরও দশ-বারোটি সিনেমা হল। বড় হলগুলো টিকলেও ছোট প্রেক্ষাগৃহগুলোর অস্তিত্ব ধরে কঠিন হবে। যশোরের ময়ূরী সিনেমা হলের মালিক আশরাফুল বাবু বলেন, কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে ১১ জনের মধ্যে তিন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করতে হয়েছে। এভাবে চালানো মুশকিল। সিনেমার প্রদর্শনী না হলে বন্ধ হয়ে যায় আয়। কিন্তু থেমে থাকে না ব্যয়। বেতনসহ নানা বাণিজ্যিক হারে বিভিন্ন বিল ও ট্যাক্স ঠিকই দিতে হচ্ছে। অথচ দুই মাস ধরে আয়-রোজার বলে কিছু নেই। বৈশাখে প্রেক্ষাগৃহে একটা ব্যবসা হয়। এবার সেটা হলো না। রোজার ঈদও পেলাম না। আগামী কোরবানি ঈদে পাব কিনা সেটারও ঠিক নাই। সাধারণত ঈদে কিছু বড় বাজেটের ছবি আসে। এগুলোর মুনাফা দিয়ে সারাবছর হল চালানোর খরচ উঠে আসে। করোনার কারণে সেই সুযোগটিও এবার হাতছাড়া হলো। এখন যে পরিস্থিতি চলছে হল খুললেও সামনে দর্শক হলে আসবে কিনা সন্দেহ। আর দর্শক একবার হল বিমুখ হলে তাদের পুনরায় হলে ফেরানোও আরেক চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে লোকসান দিয়ে হল চালাচ্ছি। আয় না থাকায় কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারছি না। বেতনের জন্য এই দক্ষ কর্মচারীরা চলে গেলে হল চালানো অসম্ভব হয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হলে প্রেক্ষাগৃহটি বন্ধ করে দেব। উপায় না দেখে আমার মতো আরও অনেক মালিকই প্রেক্ষাগৃহ বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হবেন। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ না নিলে অনেকের হল ব্যবসার ইতি ঘটবে। সঙ্কটের উত্তরণে প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ উন্নয়নে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। বাংলা, হিন্দী কিংবা ইংরেজী যে ভাষারই হোক আমদানির মাধ্যমে ভাল ছবি হলে প্রদর্শনের সুযোগ করে দিতে হবে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় যেমন যুদ্ধ করা যায় না, তেমনি ভাল ছবি ছাড়া প্রেক্ষাগৃহের ব্যবসা হয় না। দুটা সুপারহিট দেশী ছবির সঙ্গে আমদানিকৃত পাঁচটি বিদেশী সুপারহিট ছবি চালাতে পারলে একটি বছর চলে যায়।
×