ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নজরদারি উপেক্ষা করে ঈদযাত্রা

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২০ মে ২০২০

নজরদারি উপেক্ষা করে ঈদযাত্রা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ করোনার সর্বোচ্চ চোখ রাঙানির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি উপেক্ষা করে ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে। আগামী ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সঙ্গে গণপরিবহন লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। তাতে কি। নাড়ির টান বলে কথা! ঈদ আসন্ন। উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকা থেকে নানা কায়দায় দলে দলে ছুটছেন ঘরমুখো মানুষ। কখনও পণ্যবাহী পরিবহনে, আবার ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিভিন্ন যানবাহনে মানুষকে বাড়ির পথে ছুটতে দেখা গেছে। তেমনি ঢাকায় প্রবেশ করছেন বহু মানুষ। তবে যারা নিজস্ব যানবাহন নিয়ে ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করেছেন তাদের অনেককেই বিভিন্ন চেকপোস্টে পুলিশউ বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। বিনা কারণে যারা বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাদের কাউকে ফের ঢাকায় ফিরিয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘরমুখো মানুষের যাত্রা শুরুর কারণে মঙ্গলবারও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বাড়তি যানবাহনের চাপ, এমনকি কোথাও কোথাও বেশ যানজটও হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সঙ্কট যতই থাক, বাড়ি ফেরার জন্য কোনকিছুরই তোয়াক্কা করছে না মানুষ। ঢাকা থেকে যেমনি দলে দলে গ্রামে ফিরছে, তেমনি অবাধে ঢাকায়ও প্রবেশ করতেও দেখা গেছে। ফের যানজটে স্থবির ঢাকা। অবাধে চলছে সব ধরনের যানবাহনও। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঢাকার প্রবেশপথ কিংবা বের হওয়ার পথে পুলিশের তৎপরতাও কমেছে। কড়াকড়ি কম থাকায় মানুষ ইচ্ছেমতো শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গত এক মাসের মধ্যে মঙ্গলবার ঢাকায় নজিরবিহীন যানজট দেখা গেছে। রাজধানীর উত্তরা, বনানী, রামপুরা, মালিবাগ, গাবতলী, মিরপুর, ফার্মগেট, মহাখালী, আব্দুল্লাহপুর, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বাবু বাজার ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রচ- যানজট দেখা গেছে। ১০ মিনিটের রাস্তা এক ঘণ্টায়ও পার হতে পারেননি অনেকে। গাবতলীতে গিয়ে দেখা যায়, গাড়ির চাকা ধীর গতিতে চলছে। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লেগুনা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিক্সা ও মোটরবাইকের দখলে সড়ক। এসব যানবাহনে গাদাগাদি করে ঈদে বাড়ি ফিরছে রাজধানীর মানুষ। পুলিশের তৎপরতা শিথিল থাকায় স্বাভাবিক দিনের মতো যানজট। তবে কয়েক ঘণ্টা পরপর পুলিশকে সক্রিয়ও হতে দেখা গেছে। একই অবস্থা রাজধানীর বাবুবাজার থেকে মাওয়াগামী সড়কেও। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যে যেভাবে পারছে, সেভাবেই ঢাকা থেকে বের হচ্ছে। মূলত ঈদকে সামনে রেখে একেবারেই পুরনো চেহারায় ফিরেছে রাজধানী। শুধু গণপরিবহন ছাড়া সব গাড়ি চলছে। ফার্মগেট, মানিক মিয়া এভিনিউসহ বিভিন্ন এলাকায়ও দীর্ঘ যানজট দেখা গেছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্য আবির হাসান বলেন, এত গাড়ি, আমাদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গাবতলীতে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল সুফি মিয়া বলেন, আমরা তল্লাশি করছি। যাতে ঢাকা থেকে গাড়ি বাইরে না যায়। গাড়িচালক আহমেদ জসিম বলেন, গত এক মাসের মধ্যে এত যানজট ঢাকায় দেখিনি। মহাসড়কের চিত্র ॥ ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের তারটিয়া ও আশেকপুর বাইপাস এলাকায় দেখা গেছে ঘরমুখো মানুষের ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাড়ি যাওয়ার প্রতিযোগিতা। বাড়তি ভাড়া দিয়ে লেগুনা, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় চড়ে তারা ছুটছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। গণপরিবহন বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে আশেকপুর বাইপাস এলাকায় রীতিমতো বসেছে লেগুনা, সিএনজি আর ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার স্ট্যান্ড। এ স্ট্যান্ড থেকে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এলেঙ্গা ও ভূঞাপুর পর্যন্ত যাত্রী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও মির্জাপুর থেকে লেগুনা অথবা সিএনজিতেও এলেঙ্গা আর ভূঞাপুর পর্যন্ত যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। তবে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ইফতেখার রোকন বলেন, গণপরিবহন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঈদকে সামনে রেখে এ মহাসড়কে যাত্রী বেড়েছে। এ সুযোগে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস আর কেউ কেউ অসুস্থতার দোহাই দিয়ে এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে বাড়ি ফিরছেন। সন্দেহজনক কিছু গাড়ি প্রবেশে বাধা দেয়া হলেও বেশির ভাগ গাড়িই সেতু দিয়ে পার হচ্ছে। তবে নদী পথে কিভাবে যাত্রী পারাপার হচ্ছে সে বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। ভূঞাপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ রাশিদুল ইসলাম বলেন, নৌ চলাচল বন্ধে বঙ্গবন্ধু সেতু নৌ পুলিশ ফাঁড়ি আর গোবিন্দাসী পুলিশ ফাঁড়িকে তৎপর থাকতে বলা হয়েছে। এ পথে কোন ধরনের নৌ চলাচল করবে না বলেও জানান তিনি। ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট-খুলনা মহাসড়কে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রীদের যেতে দেখা গেছে। ঘুরিয়ে দেয়া হয় গাড়ি...॥ বজ্র আটুনি ফসকা গেরো। এরকম প্রবাদ প্রবচনের কথা কারও না জানার কথা নয়। করোনা রোধে মানুষের যাতায়াত থামাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর থাককলেও রাস্তায় মানুষের চলাচল থেমে নেই। যার যেখানে প্রয়োজন যাচ্ছেন। তবে নজরদারি! এ বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ রয়েই যাচ্ছে। রাজধানী থেকে বের হওয়া বা প্রবেশের চেষ্টা করলেই কিছু গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ বলছে, বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া ঘরমুখো মানুষের বেশির ভাগ যানবাহন ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। সকাল থেকে ঢাকায় প্রবেশের অন্যতম দুই পয়েন্ট নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং গাজীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এই চিত্রই ধরা পড়েছে। তবে এতসব আয়োজনের মধ্যে মানুষ ঠিকই ছুটে গেছে গন্তব্যের দিকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের গত কয়েক দিনের তুলনায় মঙ্গলবার ঢাকামুখী যানবাহনের চাপ অনেকটা কম ছিল। তবে ঢাকা থেকে প্রাইভেটকারসহ অন্যান্য বিপুল পরিমাণ যানবাহন বের হয়ে যায়। পুলিশ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনাঘাট ও সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় দুটি চেকপোস্ট বসিয়ে ব্যক্তিগত যানবাহন প্রাইভেটকার মাইক্রোবাস সিএনজি মোটরসাইকেল চরে যে সব যাত্রী ঢাকায় প্রবেশের চেষ্টা করছেন এবং যারা ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন সেসব গাড়ি জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম জানান, ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়ার এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ঢাকায় যাতে কোন যানবাহন প্রবেশ বা ঢাকা থেকে বের হতে না পারে সেই বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আটটি জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া যেসব গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করছে তাদের ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এদিকে ঢাকা-চট্টগাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড, শিমরাইল মোড়, কাঁচপুর, মদনপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বিপুল সংখ্যক লোকের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। ঈদকে সামনে রেখে এসব যাত্রীরা ঢাকা থেকে বের হওয়ার জন্য বিভিন্ন যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু মহাসড়কে গণপরিবহন না থাকার কারণে এসব যাত্রীরা ছোট ছোট যানবাহন মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি, রিক্সা ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার আনোয়ার হোসেন জানান, যাতে কোন যাত্রীবাহী পরিবহন রাজধানী ঢাকার দিকে প্রবেশ করে করোনাভাইরাস না ছড়ায় সেই কারণে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সালনা হাইওয়ে থানার ওসি জহিরুল ইসলাম খান জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। নিত্য পণ্যবাহী যানবাহন ছাড়া সব পরিবহন চেক করা হচ্ছে যাতে কোন যাত্রী চলাচল না করতে পারে। কালিয়াকৈর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আল মামুন জানান, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে যাতে নতুন করে কেউ আক্রান্ত না হয়, সে জন্য আমরা লোকজনকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতে দিচ্ছি না। এ ব্যবস্থার জন্যই আমাদের তল্লাশি। আমরা চাই সবাই ভাল থাকুন। আরিচা ঘাটে সতর্ক নজরদারি প্রশাসনের ॥ প্রশাসনের কড়া নজরদারির কারণে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে যানবাহনের চাপ সোমবারের তুলনায় মঙ্গলবার অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তারপরও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে যাত্রী ও গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সকাল ৯টা থেকে পুনরায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ রেখেছে ফেরি কর্তৃপক্ষ। এদিকে, শিমুলিয়া ঘাটে পদ্মা নদী পারাপারের অপেক্ষায় থাকা লোকজনকে বিশেষ বাসে করে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা এরিয়া অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) জিল্লুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার ভোর থেকে পাটুরিয়া ঘাটে ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ বাড়তে শুরু করে। পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক প্রাইভেটকারেরও ফেরি পারের অপেক্ষায় ছিল। সকাল ৭টা থেকে জরুরী পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের জন্য ২-৩টি ফেরি চালানো হয়। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরিঘাট এলাকায় যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। পরে সকাল ৯টার দিকে ফেরি চলাচল পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা হয়।
×