ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আল বিদা মাহে রমজান

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ১৯ মে ২০২০

আল বিদা মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ হেরা গুহা আলোকিত করে পবিত্র কুরানুল কারীম নাজিলের পুণ্য স্মৃতিধন্য দশকে আজ এমন এক পুণ্যবান মনীষীকে সম্মানিত পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই যিনি কুরানুল কারীমের প্রচার প্রসারে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন এবং এ মহান কিতাবের বরকতে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি হলেন হযরত মুহম্মদ (স)’র অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী হযরত যায়িদ (রা)। মুসললিম উম্মাহ তাকে অনেকগুলো উপাধিতে ভূষিত করেছে। যেমন: হাবরুল উম্মাহ, কাতিবুল ওহী ইত্যাদি। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান। রাসুলুল্লাহ (স)’র মদিনায় হিযরতের সময় যায়িদ এগারো বছরের বালক মাত্র। (আল ইশতিয়াব ১/৫৫১) মক্কা থেকে হযরত রাসুলে করীম (স)’র মুবাল্লিগ হযরত মুস’য়াব ইবন উমাইর (রা) যখন মদিনায় হিজরত করে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চলেছেন তখন কোন এক সময়ে অতি অল্প বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ (স) মদিনায় হিজরত করে আসলেন। তখন তিনি কুরানের সতেরোটি সুরার হাফেজ। লোকেরা তাকে রাসুলুল্লাহ (স)’র দরবারে নিয়ে গেল এবং এই বলে পরিচয় করিয়ে দিল যে, ছেলেটি নাজ্জার গোত্রের। এরই মধ্যে সে সতেরোটি সুরার পাঠ শেষ করেছে। রাসুল (স) তাঁর মুখ থেকে কুরান তিলাওয়াত শুনে খুব খুশি হলেন। বদর যুদ্ধের সময় তিনি তেরো বছরের এক বালক মাত্র। যুদ্ধে যাওয়ার বয়স তখনও হয়নি। তবুও আনসার ও মুহাজিরগণ যখন বদরের দিকে যাত্রা করলেন তখন এ বালকও যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরই মতো ছোটদের একটি দলের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স)’র সামনে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। যুদ্ধের বয়স না হওয়ার কারণে রাসুল (স) তাদের সান্ত¡না দিয়ে ফিরিয়ে দেন। হায়াতুস সাহাবা গ্রন্থে যায়িদ ইবন সাবিতের একটি বর্ণনা সঙ্কলিত হয়েছে। তা দ্বারা বোঝা যায়, তিনি উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হযরত যায়িদ ইবন সাবিত (রা)’র গোটা জীবন সৎকর্মের সমষ্টি। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (স)’র সেক্রেটারি। ওহী লিখতেন। হযরত রাসুলে কারীম (স)’র জীবনকাল পর্যন্ত হাড়, চামড়া, খেজুরের পাতা ও মুসলমান হাফেজদের স্মৃতিতে কুরান সংরক্ষিত ছিল। বহু সাহাবী কুরান মুখস্থ করেছিলেন। এ সকল হাফেজদের মধ্যে যায়িদও (রা) একজন। হযরত আবু বকরের শাসনামলে ইয়ামামার যুদ্ধে বেশ কিছু হাফিজে কুরান শাহাদাত বরণ করেন। তখন হযরত উমরসহ অনেকে লিখিতভাবে কুরান সংরক্ষণের জন্য খলিফাকে চাপ দিতে থাকেন। অনেক চিন্তাভাবনা করে হযরত আবু বকর (রা) যায়িদ ইবন সাবিতকে ডেকে বলেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান নওজোয়ান। তোমার প্রতি সবার আস্থা আছে। তুমি রাসুলুল্লাহ (স)’র জীবদ্দশায় ওহী লিখেছিলে। সুতরাং তুমিই এ কাজটি সম্পাদন কর। হযরত যায়িদ (রা) বলেন: আল্লাহর কসম! তাঁরা আমাকে কুরান সংগ্রহ করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা করার চেয়ে একটি পাহাড় সরানোর দায়িত্ব দিলে তা আমার কাছে অধিকতর সহজ হতো। তিনি খলীফাকে বললেন: আপনি এমন কাজ করতে চান যা রাসুল (স) করেননি। খলীফা বললেন: তা ঠিক। তবে ভাল কাজে অসুবিধা কি? তারপরও যায়িদ কাজটি করতে ইতস্তত করতে থাকেন। খলীফা বিভিন্নভাবে বোঝানোর পর তিনি রাজি হয়ে গেলেন। এ কাজে যায়িদকে সহযোগিতার জন্য খলীফা আবু বকর (রা) আরও একদল সাহাবাকে দিলেন। হযরত যায়িদ (রা) কর্তৃক সংগৃহীত ও লিখিত কুরান মাজিদের এ কপিটি খলীফা হযরত আবু বকর (রা) নিজের হিফাজতে রাখেন। তার ইন্তিকালের পর দ্বিতীয় খলীফা হযরত ‘উমর (রা.)’র হাত হয়ে তা তাঁরই কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা)’র হাতে পৌঁছে এবং সেখানে সংরক্ষিত হয়। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা)’র খিলাফতকালে বিভিন্ন অঞ্চলে যখন আল কুরানের পাঠে তারতম্য দেখা দেয় তিনি হযরত যায়িদ (রা)’র সংগৃহীত আল কুরানের কপিটি হযরত হাফসার (রা) নিকট থেকে চেয়ে নেন। তারপর পাঁচটি কপি নকল করেন। খলীফা উসমান (রা) এই কপিগুলি খিলাফতের পাঁচটি অঞ্চলে পাঠিয়ে দেন । ইসলামী হুকুমতের একটি অতি মর্যাদাপূর্ণ দফতর হলো বিচার বা কাজা’। খলীফা হযরত উমর (রা.) এর সূচনা করেন এবং হযরত যায়িদ ইবন সাবিতকে (রা) মদীনায় কাজী নিয়োগ করেন। তখনও বিচারকের জন্য পৃথক ‘আদালত ভবন বা বাড়ি নির্মাণ হয়নি। হযরত যায়িদ (রা)’র বাড়িই ছিল ‘দারুল কাজা ’ বা বিচারালয়। ঘরের মেঝেতে ফরাশ বিছানো থাকত। তিনি তার ওপর মাঝখানে বসতেন। রাজধানী মদীনা ও তার আশপাশের যবতীয় মামলাÑমোকদ্দমা হযরত যায়িদ (রা)’র এজলাসে উপস্থাপিত হতো। এমন কি তৎকালীন খলীফা খোদ ‘উমর (রা)’র বিরুদ্ধেও এখানে মামলা দায়ের হয়েছে এবং তার বিচারও চলেছে। হযরত যায়িদ (রা)’র মৃত্যু সন সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ আছে। ওয়াকিদীর মতে হিজরী ৪৫ সন। হযরত আবু হুরায়রা (রা) তাঁর মৃত্যুর দিন মন্তব্য করেন: আজ ‘হাবরুল উম্মাহ’ (উম্মাতের ধর্মীয় নেতা) চলে গেলেন। ( তাবাকাতুল মাশাহির ২/২২৫)। প্রখ্যাত তাবে’ঈ সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব বলেন: আমি যায়িদ ইবন সাবিত (রা)’র জানাজায় শরিক ছিলাম। যখন তাকে কবরে নামানো হলো, ইবন আব্বাস (রা) বললেন: তোমরা যারা ইলম কিভাবে উঠে যায় তা জানতে চাও তারা জেনে নাও, এভাবে ইলম উঠে যায়। আজ বহু ইলম চলে গেল।
×