ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আফ্রিকানদের কেন কোভিড-১৯ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশ নিতে হবে

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ১৮ মে ২০২০

আফ্রিকানদের কেন কোভিড-১৯ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশ নিতে হবে

আফ্রিকার অধিবাসীদের ওপর করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বেশ কিছু ভীতিকর গল্প এখনি শোনা যাচ্ছে। যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন পরীক্ষায় আফ্রিকানদের অংশ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ আর এতে যুক্তি হলো এটি শুধু ধনী দেশগুলোর জন্য নয় বরং বিশ্বজুড়ে কাজ করবে এমন ভ্যাকসিন খুঁজে পাওয়ার যে চেষ্টা সেটিকে আরও জোরদার করবে। মার্চেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড. টেড্রোস ঘেব্রেয়েসাস কোভিড-১৯ এর কার্যকর চিকিৎসার সন্ধানে বৈশ্বিক 'সংহতি পরীক্ষার' কথা বলেছিলেন। কারণ সংস্থাটির মতে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন বা টিকাই মহামারি নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সবল করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষকে অসুস্থ হওয়া থেকে বিরত রাখবে। ভ্যাকসিন বা টিকা কিভাবে কাজ করবে: •ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বাড়াতে সাহায্য করবে •শরীরের মধ্যে ভাইরাসকে চেনা ও এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে শরীরকে শেখাবে •কয়েক দশক না লাগলেও একটি টিকা তৈরিতে সাধারণত কয়েক বছর সময় লাগে •কোভিড-১৯ টিকা মিললে তা চলমান লকডাউন তুলে নিতে ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি শিথিল করে আনবে যতটুকু জানা যায় দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে আর কেনিয়ায় একটি অনুমতির অপেক্ষায় আছে। যদিও বিষয়টি আবদ্ধ হয়ে আছে বিতর্কে। এবং আফ্রিকান চলমান বিতর্কে উঠে আসছে বর্ণবাদ ইস্যু। 'ঔপনিবেশিক মানসিকতা' এর সূত্রপাত হয় দুজন ফরাসী ডাক্তারের ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় পরীক্ষার আলোচনা থেকে যেখানে দেখা হচ্ছে যে যক্ষ্মার টিকা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর কি-না। একটি টিভি বিতর্কে তারা একমত হন যে এটা আফ্রিকায় পরীক্ষা করা উচিত। একজন বলেন, "এ পরীক্ষা কি আফ্রিকায় হওয়া উচিত না, যেখানে কোনো মাস্ক নেই, চিকিৎসা নেই"। তার এ মন্তব্যের যে সুর তাই বিতর্কের জন্ম দেয়। ড. টেড্রোস, যিনি একজন ইথিওপিয়ান, বলছেন, "আমরা এর তীব্র নিন্দা করি এবং নিশ্চিত করে বলতে চাই যে এটা হচ্ছেনা। ঔপনিবেশিক মানসিকতার অবসান হওয়া উচিত"। পরে আফ্রিকার সুপরিচিত ব্যক্তিত্বদের অনেকেই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন যার মধ্যে রয়েছে তারকা ফুটবলার দিদিয়ের দ্রগবা ও স্যামুয়েল ইতো। দ্রগবা টুইটে বলেছেন,"আফ্রিকার মানুষদের গিনিপিগ মনে করবেননা। এটা একেবারেই বিরক্তিকর"। যদিও প্রমাণ আছে যে ঔষধ কোম্পানিগুলো আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গার এ ধরণের পরীক্ষা করে যেখানে নৈতিকতা বা মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান কমই নিশ্চিত করা হয়। ক্ষতিপূরণ পরিশোধ নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য কানোতে ১৯৯৬ সালে একটি ঔষধের পরীক্ষা চালায় পিফিজার। পরে এক দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে বিখ্যাত এই ঔষধ কোম্পানিকে কিছু অভিভাবকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় যাদের সন্তানেরা মেনিনজাইটিস মহামারির সময় ওই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো। ওই পরীক্ষার অংশ হিসেবে অ্যান্টিবডি প্রয়োগের পর এগারটি শিশু মারা যায় ও অনেক বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। এরপরই পরীক্ষার জন্য অভিভাবকদের সম্মতি নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। দু'দশক পরে এসে উগান্ডার গবেষক ক্যাথেরিন কিওবুতুঙ্গির মতো বিজ্ঞানীরা বলছেন অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে এবং প্রক্রিয়াটি এখন আরও স্বচ্ছ। "আপনি যদি ভ্যাকসিন তৈরির কাজে জড়িত বিজ্ঞানী হন তাহলে আপনি চাইবেননা যে কেউ মারা যাক"। তিনি বলেন এখন প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় পর্যায়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে এবং দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও আছে। আফ্রিকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে কাজ ভ্যাকসিন উন্নয়নে কাজ করেন রিচার্ড মিহিগো। তিনি বলছেন যে এখন টিকা তৈরির যে প্রক্রিয়া সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। গবেষকরা কোন ঔষধ বা টিকা তৈরির পর একই ধরণের ঔষধ বা টিকা মার্কেটিং বা উৎপাদনে জড়িত থাকতে পারেননা। 'ইনফোডেমিক' সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার জন্য তদের ওপর ক্ষতিকর ভ্যাকসিন প্রয়োগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রায়শই দেখা যায়। যেমন: সেনেগালে সাত শিশুর মৃত্যু নিয়ে একটি ভুয়া গল্প ছড়িয়ে পড়ে যে তাদের ওপর কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে। ঘটনাটি এপ্রিলের এবং তখন ওই ফরাসী ডাক্তারদের বিতর্কিত মন্তব্য এ গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অসত্য এই তথ্যকে 'ইনফোডেমিক' হিসেবে আখ্যায়িত করে। আর্থিক অপ্রতুলতার কয়েক দশক তবে অনেক বছর ধরে যেটি গুরুত্ব পায়নি সেটি হলো আফ্রিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ২০০১ সালে আফ্রিকার নেতারা তাদের বাজেরে পনের শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। অথচ ওই অঞ্চলের ৫৪টি দেশের মধ্যে মাত্র পাঁচটি এ লক্ষ্য অর্জন করেছে। আফ্রিকায় অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন কিন্তু বিজ্ঞানীরা প্রায়ই অন্যত্র চলে যান কারণ তাদের কাজের সুযোগ নেই- এর মানে হলো স্বাস্থ্যখাতে গবেষণার দিকে প্রায়ই কেনো দৃষ্টি দেয়া হয়না। 'লকডআউটে'র ঝুঁকি আফ্রিকায় বিশেষজ্ঞরা একমত যে কোভিড-১৯ এর টিকা হতে হবে সার্বজনীন। তারা বলেন আফ্রিকা মহাদেশ যদি পরীক্ষা থেকে দুরে থাকে তাতে এর দুরে থাকার ঐতিহ্যই কেবল অব্যাহত থাকবে। ড. কিওবুতুঙ্গি বলছেন, "এটা ঠিক না যে ধরুন পরীক্ষা হলো যুক্তরাজ্যে এবং পরে আফ্রিকায় নেয়া হলো। কারণ আমাদের ভিন্ন বাস্তবতা, ভিন্ন জেনেটিক বৈশিষ্ট্য যা টিকার কাজে প্রভাব ফেলতে পারে"। "আমাদের ভিন্ন স্ট্রেইন থাকতে পারে; আমাদের অন্য রোগের প্রোফাইলও আছে। যেমন বড় একটি জনগোষ্ঠী এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। তবে উদ্বেগ অন্য বিষয়ে আছে, যেমন ধরুন আফ্রিকায় টিকা শেষ হয়ে যাচ্ছে কারণ ধনী দেশগুলো ব্যাপকভাবে কিনছে, বলছিলেন তিনি। আফ্রিকান ইউনিয়ন নেতাদের কাছে দেয়া একটি চিঠিতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন তারা এমন একটি ভ্যাকসিন চান যা হবে প্যাটেন্ট ফ্রি, ব্যাপকভাবে তৈরি ও বিতরণ করা সম্ভব এবং যা হবে সবার জন্য ফ্রি। "কোথায় বাস করে বা কত আয় করে সে বিবেচনায় কাউকে টিকার লাইনের পেছনে ঠেলে দেয়া উচিত হবেনা," বলছিলেন তিনি। - আন্নে মাওয়াথি লেখক: আফ্রিকা হেলথ এডিটর, বিবিসি নিউজ
×