ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এবারের ঈদে বগুড়ার ঐতিহ্যের চিকন সেমাই বাণিজ্যে ধস

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ১৮ মে ২০২০

এবারের ঈদে বগুড়ার ঐতিহ্যের চিকন সেমাই বাণিজ্যে ধস

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ করোনার থাবায় এবারের রমজানের ঈদে বগুড়ার ঐতিহ্যের চিকন সেমাই বাণিজ্যে ধস নেমেছে। প্রতি বছর রমজান মাস শুরু হওয়ার দেড় মাস আগে বগুড়া সদর শাজাহানপুর গাবতলি উপজেলার গ্রামগুলোতে চিকন সেমাই তৈরি শুরু হয়। এবার বড় মাঝারি ছোট কোন কারখানা নির্ধারিত সময়ে সেমাই তৈরি করতে পারেনি। তবে ঈদের আগের এই সময়টায় তড়িঘড়ি করে মালিকরা কারখানা চালু করে সেমাই তৈরির কাজ করছে। বলছেন, সেমাই তৈরি শুরু হলেও বেচাকেনা একেবারে নিচের দিকে। যতটুকু পারা যায় ময়দা ও অন্যান্য উপকরণ কিনে বাজার ধরার চেষ্টা চলছে। মালিকরা জানাচ্ছেন, প্রথম দিকে কারখানা চালু নিয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। ময়দা কেনা এবং কারিগর পাওয়া সহজ ছিল না। এখন যা পাওয়া যাচ্ছে সেই পরিমাণ ময়দা ও শ্রম শক্তিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সেমাই তৈরি হচ্ছে। রমজানের ঈদের স্বাভাবিক উৎপাদনের পাঁচ শতাংশও হচ্ছে না। অর্থ লগ্নি করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মহাজন পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা টানাটানির মধ্যে আছে। সাধারণ মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী কেনার জন্য বাজারে আসছে। স্থানীয়ভাবে সেই চাহিদা পূরণ করা যাবে। তবে বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের মূল বড় বাণিজ্য হলো : রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় সরবরাহ। বিচ্ছিন্নভাবে উড়োজাহাজে বিদেশে পাঠানো। এবার এই দুইয়ের কোনটির সম্ভাবনা আর নেই। এই অবস্থায় চিকন সেমাই জেলার বাইরে পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও খাদ্য সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই তারপরও শেষ মুহূর্তে কতটা বাণিজ্য করা যাবে এই ভাবনাও আছে। বগুড়ার প্রায় প্রতিটি এলাকায় ‘সেমাই পল্লী’ গড়ে উঠেছে। শহরতলির সাবগ্রাম, বেজোড়া, শ্যাওলাগাতি, কালিসামাটি, ফুলবাড়ি, ফুলতলা এলাকাগুলোতে শ্রমিকরা সেহরির পর কাজ শুরু করে। একটানা কাজ চলে বিকেল পর্যন্ত। চিকন সেমাই বানাতে ফ্রেশ ময়দা দরকার। সামান্য ভেজাল থাকলে টানা সেমাই ছিঁড়ে যায়। ময়দা চিনে নেয়ারও কৌশল আছে। হেরফের হলে সেমাইয়ের মানের পরিবর্তন হয়। নারী শ্রমিক বেশি কাজ করে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ কেজি করে সেমাই উৎপাদিত হয়। প্রতিদিনের উৎপাদন ৮০ থেকে ১০০ মেট্রিক টন। এবারের ঈদের হিসাব অনেক নিচে নেমেছে। গত শতকের ষাটের দশকে বগুড়ার গ্রামের মেয়েদের হাতে তৈরি সূক্ষ্ম কারুকাজের চিকন সেমাই ছিল গরিবের ঈদের সেমাই। গত শতকের শেষে গরিব ধনীর ভেদাভেদ ভুলে সকলের ঘরে পৌঁছে যায় চিকন সেমাই। একুশ শতকের শুরুতে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। চিকন সেমাই বানানোর যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। দিনে দিনে আধুনিকায়ন হয়। চাহিদাও বাড়ে। চিকন সেমাই এখন উঁচু আসনে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ের গর্বিত পরিচয়ে পৌঁছেছে। গ্রামের হাট বাজার থেকে নগরী মহানগরীর শপিংমল হয়ে পাঁচ তারকাখচিত হোটেলে মেলে বগুড়ার চিকন সেমাই। ঈদের ‘গিফটের’ তালিকাভুক্তি হয়েছে। প্রতি কেজি সেমাই খুচরা বিক্রি হয় মান ভেদে ৩০ থেকে ৭০ টাকা দরে। বগুড়ার বাইরে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের যারা ঈদে বাড়িতে আসতে পারেন না তারা আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতজনের কাছে চিকন সেমাই পাঠানোর অনুরোধ জানায়। কুরিয়ার সার্ভিসসহ নানা মাধ্যমে চিকন সেমাই পাঠানোর হিড়িক পড়ে যায়। প্রবাসীদের কাছে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসে, বিদেশগামী যাত্রীদের মাধ্যমে চিকন সেমাই পাঠানো হয়। চিকন সেমাই বাণিজ্যের এগুলোর কোনটিই এবার নেই। ধস নেমেছে চিকন সেমাইয়ের।
×