ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ষস্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই ষরাজধানীতে বাস ছাড়া সবই চলছে, যানজট ষপণ্যবাহী পরিবহনে নেয়া হচ্ছে যাত্রী ষপরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার পরামর্শ

মানুষ ও যানবাহনের স্রোত ॥ সব কিছুই যেন স্বাভাবিক

প্রকাশিত: ২২:২২, ১৮ মে ২০২০

মানুষ ও যানবাহনের স্রোত ॥ সব কিছুই যেন স্বাভাবিক

রাজন ভট্টাচার্য ॥ একদিকে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা। অন্যদিকে গণপরিবহন বন্ধের মধ্যেও সরগরম সড়ক মহাসড়ক থেকে শুরু করে ফেরিঘাট। প্রতিদিন বাড়ছে ঢাকামুখী মানুষের ঢল। ঈদকে সামনে রেখে জীবনের তাগিদে অনেকে কর্মের সন্ধানে-অনেকে কর্মস্থলে যোগ দিতে নানা ঝক্কি মাথায় নিয়ে আসছেন ঢাকায়। সবকটি ফেরিঘাটে গেল প্রায় এক সপ্তাহ মানুষ আর মানুষ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু রাজধানী শহর দেখলে মনে করার কারণ নেই, দেশে করোনা বলে ভয়ঙ্কর কোন রোগ ব্যাধি আছে! এটা সত্যিই। বাস্তবও বটে। অথচ গেল এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার বেড়েছে ১৫ ভাগ। তাই প্রশ্ন হলো বেশি আক্রান্ত আর মৃত্যুর মধ্যে রাস্তা ঘাটের স্বাভাবিক পরিস্থিতি আমাদের কোন পথে নিয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে ১০ মে থেকে শপিংমল, মার্কেট খুলে দেয়ার কারণে প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে সবকিছু উপেক্ষা করে মানুষ ১০ মে থেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। তাই অন্যান্য দেশে তিনমাস করোনা চলার পর দেখা গেছে সংক্রমণ কমেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে এখন সংক্রমণের কোন পর্যায় চলছে তো বোঝা কঠিন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সবার ধারণা ছিল মে মাসের শুরু থেকে যে পর্যায় শুরু হয়েছিল- সেটাই সর্বোচ্চ। এখন মনে হচ্ছে আমরা সর্বোচ্চ ধারার দিকে যাচ্ছি। যা কোথায় গিয়ে শেষ হতে পারে বোঝা কঠিন। এই প্রেক্ষাপটে সেক্টরভিক্তিত লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করার পাশাপাশি যানবাহন ও মানুষের অবাধ চলাচল যে কোন মূল্যে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে জীবন জীবিকা স্বাভাবিক রাখতে রাষ্ট্রের প্রণোদনা বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংক্রমণের হার টানা ১৫ দিন যদি নিম্নগামী হয় তাহলে বোঝা যাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে। সেক্ষেত্রে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসতে হবে। তবে এটা তখনই সম্ভব হবে যদি পরিবহন ও মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা যায়। গেল ডিসেম্বরের শেষদিকে চীন থেকে শুরু কোভিড-১৯ এখন গোটা বিশ^কে চোখ রাঙাচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যু আর আক্রান্তের ঢল। বৈশি^ক এই মহামারী থামাতে দেশে দেশে নেয়া হয়েছে নানামুখী ব্যবস্থা। সে তুলনায় আমাদের দেশে কঠোর ব্যবস্থার মধ্যে কারফিউ, জরুরী অবস্থা বা পুরোপুরি লকডাউন কোনটাই হয়নি। গত আট মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ২৬৮ জনে। মৃত্যু হয়েছে ৩২৮জনের। রবিবারও দেশে সর্বোচ্চ এক হাজার ২৭৩ জন আক্রান্ত হয়েছ। মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। এই যখন অবস্থা তখন করোনা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক নিষেধাজ্ঞা শিথিল বা কোন কোন ক্ষেত্রে তুলে নেয়ায় সঙ্কটের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম নৌরুট মাদারীপুর জেলার শিবচরের কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জন্য ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই নৌরুটটিই সহজতর। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে এ নৌরুটে গত মার্চ মাসের ২৪ তারিখ থেকে লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে জরুরী প্রয়োজনে ফেরি চালু রেখেছে কর্তৃপক্ষ। গত কয়েকদিন ধরেই ঘাট এলাকায় ঢাকামুখী মানুষের স্রোত। রবিবার সকাল থেকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সব মিলিয়ে শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় থ্রি হুইলারে চেপে যাত্রীরা কাঁঠালবাড়ি ঘাটে আসছেন। ফেরিতে উঠতে যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতার মনোভাব। করোনাভাইরাস নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে কোন উদ্বেগ বা সচেতনতা নেই। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক আব্দুল আলীম জানান, যাত্রী চাপ বেশি থাকায় নৌরুটে ১৪টি ফেরি চলাচল করছে। সকাল থেকেই যাত্রীদের প্রচন্ড চাপ। কয়েকদিন ধরেই যাত্রীদের ভিড় রয়েছে ঘাটে। ব্যক্তিগত পরিবহনও পার হচ্ছে। ফেরি চলাচলে কোন সমস্যা নেই। একই চিত্র দেখা গেছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটসহ অন্য ফেরিঘাটেও। তেমনি ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট-খুলনা মহাসড়কে দেখা গেছে পণ্যবাহী পরিবহনে দেদার যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় এই চিত্র বেশি দেখা যায়। ছোট ছোট পিকআপে ত্রিপল টানিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে মানুষ নেয়া হচ্ছে। মূলত মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই এই কৌশল নিয়েছে যাত্রীসহ পরিবহন চালকরা। কয়েকদিন আগেও রাজধানী ঢাকার সড়ক ছিল যানবাহনশূন্য। কিন্তু এখন ঢাকা যেন তার স্বরূপে ফিরে গেছে। সড়কে বাড়ছে যানবাহনের চলাচল এবং সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ফুটপাথে বসেছে দোকান। নির্দিষ্ট সময়ের বেশি পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে সব ধরনের দোকানপাট। যানবাহন বেশি বাড়ায় কোথাও কোথাও যানজট পর্যন্ত হচ্ছে। গণপরিবহন না চললেও ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিক্সাসহ অন্য সব যানবাহন অবাধে চলাচল করছে। কোন রকম জবাবদিহিতা নেই। তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কমেছে। পুলিশ বলছে, সরকার বিধিনিষেধ শিথিল করায় যানবাহন চলাচল বেড়েছে। এতে আগের মতো চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। রবিবার দুপুরে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় যানজট তৈরি হয়। প্রায় ২০ মিনিট প্রতিটি গাড়িকে সিগন্যালে অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিমানবন্দর সিগন্যালও যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল দিনভর। রাজধানীর গুলশান এ্যাভিনিউ সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বেড়েছে। এ জন্য সিগন্যালে তৈরি হয়েছে যানজট। একইভাবে রামপুরা বাড্ডা সড়কেও যানবাহন চলাচল বাড়ায় যানজট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংক্রামক রোগ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর অন্যতম উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সংক্রমণের হার ধীরে-ধীরে বাড়ছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কলকারখানা এবং দোকানপাট খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে যে শৈথিল্য দেখা গেছে সে কারণে হয়তো সংক্রমণের হার কিছুটা বেড়েছে। এটার ফল দেখতে আমাদের হয়তো সামনের সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। আমরা ঈদের নামে যেন কোন শৈথিল্য না দেখাই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিদিন যাতে ১৫ হাজার টেস্ট করা যায়, সে লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। এ মাসের মধ্যেই প্রতিদিন ১০ হাজার টেস্টের লক্ষ্য পূরণ করতে চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারপরও জনসংখ্যার তুলনায় টেস্টের এ সংখ্যা নগণ্য। প্রায় আড়াই মাসেও দিনে ১০ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অন্যতম উপদেষ্টা আবু জামিল ফয়সাল বলেন, গত পাঁচ দিনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এটা স্থিতিশীল আছে। এখন এটা কি বেড়ে যাবে? বাড়তেও পারে। পার্সেন্টেজটা দিয়ে খুব বেশি কিছু নির্ধারণ করা যাবে না। সংক্রমণের বর্তমান ধারা বজায় থাকলে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছুটা হলেও চেষ্টা করা যাবে, অন্যথায় পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, যদি এই সপ্তাহে আর একটা লাফ না দেয়, তাহলে শহরাঞ্চলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও একটু বেশি সময় পাওয়া যাবে।
×