ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নিম্নমানের কাজের বিল পাশ না করাই তার মৃত্যুর মূল কারণ

মোটা অঙ্কের ঘুষ অফার করা হয়েছিল দেলোয়ারকে

প্রকাশিত: ২১:৪১, ১৬ মে ২০২০

মোটা অঙ্কের ঘুষ অফার করা হয়েছিল দেলোয়ারকে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঘুষ নিলে সরকার ধরে, আর ঘুষ না নিলে ঠিকাদাররা মারার জন্য রাস্তায় লাঠি নিয়ে বসে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে চাকরি করা যায় না। তাই ছয় মাস আগে একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন। এক ভাতিজাকে নিয়ে চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করার চেষ্টা করছিলেন। এজন্য নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। ব্যবসা শুরুর আগ পর্যন্ত চাকরি করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ব্যবসা শুরুর আগেই খুনীদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো তাকে। ঈদের আগে বিল ছাড়িয়ে নিতে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ হিসেবে অফার করা হয়েছিল তাকে। নিম্নমানের কাজের কারণে সেই বিল আটকে রাখাই তার মৃত্যুর মূল কারণ। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার বা আটক বা চিহ্নিত করা যায়নি বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে। নিহত প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের বড় ভাই নূর নবী দীপ্তি জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যক্তি জীবনে সৎ থাকার কারণে তার ভাইকে অনেক হেনস্তা হতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে থাকার সময়ও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ওএসডি করা হয়েছিল। সর্বশেষ গাজীপুরের কালিয়াকৈর সার্কেলের অঞ্চল-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। মাস ছয়েক আগে দেলোয়ার পরিবারের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছিল, ‘এভাবে চাকরি করা যায় না। কারণ ঘুষ নিলে সরকার ধরে, আর ঘুষ না নিলে ঠিকাদাররা মারার জন্য রাস্তায় লাঠি নিয়ে বসে থাকে। এভাবে ভয় নিয়ে চাকরি করা যায় না। তাই ভেবেছি, ভালভাবে জীবন যাপন করার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করব।’ এজন্য এক ভাতিজার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে যাচ্ছিল। চীনের সঙ্গে ব্যবসা করার কথা ছিল। এজন্য নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। ব্যবসা শুরুর আগ পর্যন্তই চাকরি করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার আগেই সব শেষ। হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ছাড়াও দেলোয়ারের তিন ছেলের লেখাপড়ার খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচের দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১৯৮৬-৮৭ ব্যাচের এ্যালামনাই শিক্ষার্থীদের সংগঠন ফোরাম-৮৬। দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, ঈদের আগে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ হিসেবে অফার করা হয়েছিল। বিনিময়ে বিল পাস করিয়ে দেয়ার জন্য চাপাচাপি করা হচ্ছিল। যেসব কাজের বিল পাস করিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল, সেই কাজগুলো খুবই নিম্নমানের। এজন্য তিনি বিল পাস করতে পারছেন না বলে জানিয়েছিলেন। এ ধরনের বিল পাস করলে সরকারের কাছে এবং উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তার জবাবদিহি করতে হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এজন্য বিলগুলো তিনি পাস করতে পারছেন না। তবে ওপর থেকে যদি পাস করিয়ে নিতে পারে, সেক্ষেত্রে তার কোন আপত্তি নাই। কারণ উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাহলে তাকে আর জবাবদিহি করতে হবে না। কিন্তু সরকারী কাজে এমন হওয়ার সুযোগ নেই। ধাপে ধাপে বিল পাস হয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে যায়। তার কাছেই বিলের ফাইল আটকা পড়ে থাকে। তারই জেরে প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া কম টাকার কাজ বেশি টাকা খরচ দেখানোসহ টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়াদির বিষয়টি তো আছেই। তিনি গাজীপুুরের কালিয়াকৈর সার্কেলে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই সততার কারণে ঠিকাদারদের চক্ষুশোলে পরিণত হয়েছিলেন। তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে, এটি অত্যন্ত পরিকল্পিত হত্যাকা-। ঘটনার দিন দেলোয়ার হোসেনকে নিতে আরএফএল কোম্পানির একটি গাড়ি দুপুর বারোটার দিকে তার মিরপুরের বাসার নিচে আসার কথা ছিল। সেই গাড়িতেই তার গাজীপুর যাওয়ার কথা ছিল। অথচ সকাল নয়টায় একটি প্রাইভেট মাইক্রোবাস আসে। চালকসহ চারজন সেই মাইক্রোবাসে ছিল। তাদের দুইজন একটি দুই দিকে বসা ছিল। একজন পেছনে বসা ছিল। তারা তাদের মোবাইল নষ্ট হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে থাকা একজন রিক্সাচালকের মোবাইল ফোন দিয়ে তাকে ফোন দেয়। বলে আরএফএলের গাড়িটি নষ্ট। এজন্য তারা আগে আগেই চলে এসেছেন। আর একটু সকাল সকাল অফিসে যেতে উর্ধতন কর্মকর্তারা অনুরোধ করেছেন বলে জানান। এমন কথায় সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তিনি নেমে গাড়িতে বসেন। গাড়িতে থাকা সবাই করোনাভাইরাসের কারণে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা পিপিই পরিধান করেছিল। তাদের দুইজন মাইক্রোবাসের সামনের দিকে তিন সিটের সারির দুই দিকে বসেছিল। আর একজন পেছনে বসেছিল। গাড়িটি সকাল দশটার দিকে দিয়াবাড়ি পর্যন্ত যায়। এরপরই তাকে পেছন থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে টেনে ফেলে দেয়া হয়। শ^াসরোধে হত্যার সময় ছটফট করায় মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাকে মারধর করা হয়। সকাল সাড়ে দশটার পর থেকেই তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ওইদিনই গত ১১ এপ্রিল বিকেলে উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর ব্রিজের পশ্চিম দিকের ৮ নম্বর সড়কের পাশের একটি ঝোপ থেকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (অঞ্চল-৪) নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের (৫০) লাশ উদ্ধার করে তুরাগ থানা পুলিশ। সূত্রটি বলছে, ওইদিন দুপুর বারোটার দিকে আরএফএল কোম্পানির যে গাড়িটির দেলোয়ার হোসেনকে নিতে আসার কথা ছিল, সেই গাড়িটি আর আসেনি। ওই গাড়িটির চালকের সন্ধান চলছে। ইতোমধ্যেই রিক্সাচালককে মোবাইল ফোনসহ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তুরাগ থানার ওসি নুরুল মোত্তাকিন জনকণ্ঠকে জানান, ওইদিন তার সঙ্গে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করা আরও দুই সহকারী প্রকৌশলীর একই গাড়িতে করে গাজীপুরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা যাননি। দুই প্রকৌশলীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা অসুস্থ থাকায় ওইদিন দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে যাননি বলে তারা দাবি করেছেন। প্রকৌশলী হত্যাকা-ের ঘটনায় তার স্ত্রী খোদেজা বেগম বাদী হয়ে রাজধানীর তুরাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অজ্ঞাত খুনীদের আসামি করা হয়েছে। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা তুরাগ থানার এসআই (উপ-পরিদর্শক) মোঃ শফিউল আলম জনকণ্ঠকে জানান, হত্যাকা-ের সুনির্দিষ্ট কোন কূল কিনারা হয়নি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ঠিকাদারি ব্যবসা, টেন্ডারসহ নানা বিষয় মাথায় রেখে হত্যাকান্ডের তদন্ত চলছে। হত্যাকা-টি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক ও বাহিনীটির গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল সারওয়ার- বিন-কাশেম জনকণ্ঠকে বলেন, টেন্ডার, ব্যক্তিগত শত্রুতাসহ নানা দিক বিবেচনা করে হত্যকান্ডের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মোঃ মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে জানান, কম টাকার কাজ বেশি টাকার কাজ হিসেবে পাইয়ে দেয়া, বিল পাস করানোর জন্য চাপাচাপিসহ নানা বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন ২০১৩ সাল থেকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে কর্মরত ছিলেন। তিনি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন। এলাকাটিতে বড় বড় প্রজেক্টের কাজ চলছে।
×