ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় অভিভাবকের বিদায়

প্রকাশিত: ২১:২২, ১৬ মে ২০২০

জাতীয় অভিভাবকের বিদায়

বড় অসময়ে চলে গেলেন জাতির বিবেকসম বহুমাত্রিক বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। রুচিস্নিগ্ধ উদারনৈতিক আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি, ছিলেন সমাজের চেতনার বাতিঘর। মেধা ও মননে সময়ের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। দেশের অসামান্য অভিভাবককে হারিয়ে শোকস্তব্ধ গোটা জাতি। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়ার দিনগুলোতে আনিসুজ্জামানকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রয়াত শিক্ষকের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী তার শোকবার্তায় বলেন, ‘আমি ছিলাম স্যারের টিউটোরিয়াল গ্রুপের শিক্ষার্থী।’ আনিসুজ্জামানের উদারতা, রুচি, সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতা বিচিত্র মত ও পথের মানুষকে তার বন্ধু ও শুভার্থী করে তুলেছিল। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাভুবনকে। জ্ঞানের চর্চায় আলোকিত করেছেন শিক্ষার ক্ষেত্র। সাংস্কৃতিক পরিম-লের বিকাশে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তার কৈশোরকালের বন্ধু আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তুলে ধরতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের পর দেশ যখন প্রায় বুদ্ধিজীবী হারা, তখন যে কয়জন বুদ্ধিজীবী বুদ্ধি ও বিবেকের সততা রক্ষা করে জাতিকে পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে আনিসুজ্জামান ছিলেন পুরোভাগে। আনিসুজ্জামানের তারুণ্যের উন্মেষ পূর্ব বাংলার মানুষের নবতর আত্মপরিচয় ঘোষণার ঐতিহাসিক সূচনালগ্নে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ে। এরপর তার জীবন মিলেমিশে গিয়েছিল বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাসের সঙ্গে। আনিসুজ্জামান অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বটে কিন্তু প্রকৃত নেশা ছিল তার লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে। তার রচিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্যক্ষেত্রে, সাংগঠনিকক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। এছাড়াও তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট সম্মাননা পান। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন এবং পরে ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান ইংরেজীতে প্রণয়নের পর তার দ্রুতগতির বাংলা রূপান্তরের কাজ শেষ করেন এই মনস্বী পন্ডিত ব্যক্তিত্ব। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিপন্থী মানবিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অসামান্য অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্যে বিশেষ আক্ষেপ ও বেদনার বিষয় যে বিদায়ক্ষণে তার নশ্বর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশ ও সম্মান জ্ঞাপনের সুযোগ পাওয়া গেল না। প্রস্থানকালে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন বলে শ্রদ্ধার সব কর্মসূচী বাতিল করা হয়। এটি বড় বেদনার মতো বেজেছে প্রত্যেকের হৃদয়ে। তার অন্তিম সময়ে যারা সারাক্ষণ তাঁকে ঘিরে ছিলেন সেইসব ঘনিষ্ঠ নিকটজনদের কুশল বিষয়ে মানুষের উৎকণ্ঠা থাকা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাঁদের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা ও আন্তরিক শুভকামনা।
×