ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য সেবার দিশারি ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল

প্রকাশিত: ২১:০৫, ১৬ মে ২০২০

স্বাস্থ্য সেবার দিশারি ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল

আজ এক অন্যতর বিশ্বযুদ্ধ চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। সেখানে শত্রু একটিই— অদৃশ্যপ্রায় নোভেল করোনাভাইরাস। এই যুদ্ধের পুরোভাগে নিজেদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। আর এই স্বাস্থ্যকর্মীদের বৃহত্তর অংশই সেবিকা বা নার্স। ১২ মে ‘আন্তর্জাতিক নার্সিং দিবস’-এর উদ্‌যাপন আমাদের কাছে সুযোগ এনে দেয় তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান ও অভিবাদন জানানোর। নার্সিং-এর ইতিহাসটি বেশ প্রাচীন। তবু আধুনিক যুগে, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেও সেবিকাদের ভূমিকাটি যে যথাযথ ভাবে উজ্জ্বল ছিল না তা বলাই বাহুল্য। ১৮৪৩ সালে চার্লস ডিকেন্স ‘মার্টিন চিজেলুয়েট’ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন 'সারা গ্যাম্প' নামে তালিমহীন,অপটু ও তরলমতি এক সেবিকার চরিত্র। ব্যঙ্গচরিত্র হিসেবে তাতে কিছু অতিশয়োক্তি থাকলেও তা প্রায় সমসময়ের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্র। এই পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে, আধুনিক চিন্তাভাবনা সম্পৃক্ত করে যিনি এই সেবিকার বৃত্তিকে এনেছিলেন সম্মান, স্বীকৃতি ও প্রচারের আলোয়, তাঁর নাম ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। তিনি ছিলেন আধুনিক নার্সিং পদ্ধতির অগ্রদূত। তাঁর স্মৃতিসম্মানে তাঁরই জন্মদিনে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক নার্সিং দিবস’। কিছু মানুষ বুঝি সমসময়ের অন্ধকারকে ছিঁড়ে উজ্জ্বল আলোয় পথ দেখানোর জন্য জন্মান সময়ের আগেই। সেই সময়ের নারীদের সামনে রাখা রক্ষণশীলতার অচলায়তনকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সরাতে পেরেছিলেন নিজের মানসিক দৃঢ়তাকে সম্বল করে। জন্মেছিলেন ১৮২০ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শহরের নামেই তাঁর নাম। তাঁর বাবা মায়ের অভ্যস্ত যাপন ছিল উঁচুতলার সামাজিক বৃত্তে। সেই কট্টর যুগে এরকম সমাজে নারীর পরিচয় ছিল নিছক নারীত্বেই বা বলা যায় নারীত্বের অতিশয়তায়। ভবিতব্য ছিল নিজেকে প্রস্তুত করা উপযুক্ত পুরুষের সহধর্মিনী হওয়ার এবং তার পরে সন্তানের জননী হয়ে গার্হস্থ্যযাপনে। কোন সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে সেবিকার বৃত্তি নেওয়া তো ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু ভিন্ন পথে হেঁটে পীড়িতের সেবাই ছিল নাইটিঙ্গেলের ব্রত। ১৭ বছর বয়সে তিনি বাবা-মাকে জানান তিনি ‘দৈবাদেশ’ পেয়েছেন মানুষের সেবার জন্য। পারিবারিক ও সামাজিক সব বিরোধিতাকে জয় করে তিনি বেছে নিলেন সেবিকার জীবন। প্রথমে ১৮৫০ সালে শিক্ষানবিশির পাঠ নিলেন জার্মানিতে। ফিরে এসে লন্ডনে হ্যারো স্ট্রিটের এক মহিলা-হাসপাতালে অধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করলেন। আসলে এগোতে গিয়ে তাঁকে হাঁটতে হয়েছে সাবেকি প্রথার বিপরীতে। অঙ্ক ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। পরে ভালবাসবেন পরিসংখ্যানবিদ্যাকে। কম বয়স থেকেই তথ্য লিপিবদ্ধ করার দিকে ছিল ঝোঁক। তাই রকমারি লিখিত তালিকা করতেন তাঁর বিভিন্ন রকম ঝিনুক সংগ্রহের। বাবা-মায়ের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ান সহবত শেখার জন্য যেতে হয়েছিল ইউরোপে। সেখানেও তাঁর প্রিয় ছিল জনসংখ্যা, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানের বিশদ লিপিবদ্ধকরণ। পরে অঙ্কে বিশেষ শিক্ষা (প্রাইভেট টিউশন) নিয়েছিলেন, তাতে মায়ের সম্মতি না থাকলেও। অঙ্কে ও পরিসংখ্যানবিদ্যায় তাঁর ব্যুৎপত্তি ভবিষ্যতে রোগের আকৃতি, প্রকৃতি চার্ট দিয়ে সহজে বোঝার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। নাইটিঙ্গেলের একটি সাবলীলতা ছিল ক্ষমতাবান মানুষের বন্ধুত্ব অর্জনের। ১৮৪৭ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সিডনি হারবার্ট-এর সঙ্গে, যিনি ছিলেন সেক্রেটারি অব ওয়ার (একটি রাজনৈতিক পদ)। ১৮৫৩ সালে শুরু হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। সেখানের সেনা-হাসপাতালের দুর্দশার খবর জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছিল। হারবার্টের সহায়তায় নাইটিঙ্গেল সেখানে সেবিকা হিসাবে যোগদান করেন। ১৮৫৪ সালের নভেম্বর মাসে ৩৪ জন সহকারী সেবিকা নিয়ে তিনি ইস্তানবুলের স্কুটারি-র ব্যারাক হাসপাতালে পৌঁছন। সেখানে অসুস্থ ও আহত সৈনিকদের নিরাময়ের ক্ষেত্রে পেলেন অভূতপূর্ব সাফল্য। ভালবাসা ও নিষ্ঠায় কৃচ্ছসাধনার সঙ্গে নিয়েছিলেন কিছু ব্যবস্থা। রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্যের ও সকলের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নকরণ, আবর্জনা নিষ্কাশন ও বায়ুচলাচল ইত্যাদির ব্যবস্থা। মৃত্যুহার নেমে এসেছিল শতকরা বিয়াল্লিশ ভাগ থেকে শতকরা দুই ভাগে। হাতে দীপ নিয়ে রাতে অসুস্থদের দেখতে বেরোতেন বলে পরিচিতি পেলেন ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ বলে। ‘দ্য টাইম' পত্রিকা সর্বপ্রথম দেয় এই উপাধিটি। এই উপাধি নিয়ে সকলের কাছে হয়ে উঠলেন সেবাপরায়ণতার এক উদ্‌যাপিত ব্যক্তিত্ব। এটি ছবি-সহ স্মারক হিসাবে ব্যবহৃত হতে লাগল বিভিন্ন জিনিসপত্রে। রচিত হল কবিতা, গান ইত্যাদি। কবি হেনরি ওয়ার্ডফোর্থ তাঁকে নিয়ে লিখলেন ‘সান্তা ফিলোমেনা’ কবিতা। এই প্রচার কিন্তু তাঁর পছন্দ ছিল না। তাই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে থাকতেন সাধারণ-যাপনের মধ্যে। আর বাইরে ভ্রমণে গেলে ব্যবহার করতেন ‘মিস স্মিথ’ ছদ্মনামটি। ফিরে এসে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন নাইটিঙ্গেল। প্রতিষ্ঠা করলেন পৃথিবীর প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ নার্সিং স্কুল। এটি এখন লন্ডনের কিংস কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি’ নামে পরিচিত। সামরিক বাহিনীর স্বাস্থ্যের মান নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন নাইটিঙ্গেল। তাঁর অনুরাগী মহারাণী ভিক্টোরিয়া-সহ সকলকে সেটি বোঝাতে কাজে লেগেছিল তাঁর অঙ্কের ব্যুৎপত্তি। সংগৃহীত জটিল ও বিপুল তথ্যকে সহজবোধ্য ভাবে পরিবেশন করেছিলেন পরিসংখ্যানের গ্রাফগত পরিভাষায়, ‘পাইচার্ট’-এ, ‘রোজ ডায়াগ্রাম’-এ। দেখিয়েছিলেন শতকরা ৯০ ভাগ অসুখই হয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অভাবের জন্য, যা নিবারণযোগ্য। তাঁর উদ্যোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। তিনি রোগীর অসুখ ও চিকিৎসাগত সব তথ্য নথিবদ্ধ করে রোগীর আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার জন্য পাঠিয়ে দিতেন পরিষেবা যেখানে সুলভ এবং উন্নত সেইখানে। সেই অর্থে নাইটিঙ্গেলকে ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’-এর পথিকৃৎ বলা যায়। অন্তত দুশ’টির ওপর বই এবং বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখে গিয়েছেন নাইটিঙ্গেল। বিস্ময়কর কুশলতায় বিচিত্রতা নিয়ে ছুটেছে তাঁর লেখনী। ১৮৫৯ সালে লিখেছিলেন ‘নোটস অব নার্সিং’। এটিকে রোগীসেবা নিয়ে নার্সিং-এর প্রথম বই বলা যায়। যা আজও প্রাসঙ্গিক। ‘অর্ডার অব মেরিট’-সহ প্রচুর পুরস্কার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন জীবনে। আজও সেবিকারা তাঁদের শিক্ষাজীবন শুরু করেন তাঁর নামে ‘নাইটিঙ্গেল’ শপথ নিয়ে। নার্সিং সেবার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কারের নাম তাঁরই নামে, ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মেডেল’। এই মহীয়সী লন্ডনে প্রয়াত হন ১৯১০ সালের ১৩ অগস্ট। বহুমুখী কর্মপ্রতিভায় ঋদ্ধ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল শুধু নার্সিং সেবাটিরই উত্তরণ ঘটাননি, তিনি আলোকিত করেছিলেন স্বাস্থ্যবিধিবিহীন অবস্থায় অন্ধকারে থাকা সেই সময়টিকেও। উচ্চকিত ভাবে ‘নারীবাদী’ না হয়েও অনন্যা এই নারী দেখিয়েছিলেন নারীমুক্তির পথ।। - অরুণাভ সেনগুপ্ত লেখক: পশ্চিম বাংলার আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
×