ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দুখী গোলাপ

প্রকাশিত: ১৯:২৯, ১৬ মে ২০২০

দুখী গোলাপ

গ্রীষ্মের চমৎকার রোদ ঝলমলে সকাল। বাগানের পূর্ব দিকের কৃষ্ণচূড়া গাছটা মাথা উঁচু করে যেন আকাশের সঙ্গে গল্প করছে। তার সবুজ পাতাগুলো আড়াল হয়ে গেছে লাল টুকটুকে ফুলের থোকায়। আর সেই লাল-সবুজের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে টুকরো টুকরো আকাশ। ছোট্ট গোলাপ গাছটা মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে। কী সুন্দর দেখতে সে! কী তার রূপ! গোলাপ গাছটা চোখই ফেরাতে পারে না। কিন্তু একই সঙ্গে তার মন খারাপ হয়ে যায়। কৃষ্ণচূড়া গাছটার কী সৌভাগ্য! তার ডালজুড়ে থোকায় থোকায় লাল টুকটুকে ফুল। তার গায়ে এসে বসে কত পাখি! এসব ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায় গোলাপ গাছটার। তার নিজের কী অবস্থা! একটা ফুল নেই, একটা কুঁড়ি নেই। কোন পাখি আসে না তার কাছে। তাকে দেখতে কৃষ্ণচূড়ার মতো সুন্দর লাগে না। কেউ তার প্রশংসা করে না। গোলাপ গাছটার বয়স কম। এই বসন্তের শুরুতেই কলম থেকে হয়েছে সে। চোখ মেলেই প্রথমে দেখেছিল পলাশ-শিমুলের কমলা-লাল রঙের ঝলক। যেন আগুন লেগে গেছে গাছে। গোলাপ গাছ অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল আর ভেবেছিল, তার ডালেও কি এমন ফুল ফুটবে? শিমুল-পলাশের মতো ফুল ফোটার আশায় থাকতে থাকতে গোলাপ গাছটা এতদিন পার করে ফেলেছে। বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম এসেছে। বসন্তের শেষেই কৃষ্ণচূড়াটায় ফুল ফুটতে শুরু করল। এখনও তার ডালজুড়ে টুকটুকে ফুলের থোকা। অথচ গোলাপ গাছটায় এখনো কোন ফুল ফোটেনি। গোলাপ গাছটার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। সে কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলে। তাকে কাঁদতে দেখে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা পলাশ গাছটা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার গোলাপ? তুমি কাঁদছ কেন? গোলাপ গাছটা কাঁদতে কাঁদতে বলে, তোমাদের সবার গায়ে কী সুন্দর ফুল! শুধু আমার ডালেই কোন ফুল ফোটে না। আমি আসলে অকর্মা। আমার ডালে কখনোই ফুল ফুটবে না। পলাশ গাছটা গোলাপের কথা শুনে হো হো করে হেসে ফেলল। বলল, ধুর বোকা মেয়ে! কী যে বল! প্রত্যেক ফুলের ফোটার নির্দিষ্ট সময় আছে। তোমার সময় হলেই তোমার ডালজুড়ে সুন্দর ফুল ফুটবে। গোলাপ গাছটা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, কখন আমার সময় আসবে? পলাশ গাছটা একটু ভেবে বলে, সেটা তো আমি জানি না। আমি আগে কখনো কোন গোলাপ গাছকে দেখিনি। তবে হ্যাঁ, গোলাপ ফুল দেখেছি। কী যে সুন্দর! গোলাপ গাছটা তখন কৃষ্ণচূড়া গাছকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তুমি জান কখন গোলাপ ফোটার সময়? কৃষ্ণচূড়া বলে, না গো। আমি তো এই বাগানে কখনও গোলাপ গাছ দেখিনি। আমি জানি না। তবে তুমি মন খারাপ কর না। খুব তাড়াতাড়িই তোমার ডালে কুঁড়ি আসবে, দেখ। গোলাপ গাছ মন খারাপ করে অপেক্ষা করতে থাকে। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে আসে। কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলো আবার সবুজ হতে থাকে পাতায় পাতায়। ফুল কমে আসে। কিন্তু গোলাপ গাছে আর কুঁড়ি আসে না। গোলাপের এবার খুব মন খারাপ হয়। খুব রাগ হয়। সব গাছে কী সুন্দর ফুল! এই বাড়ির মানুষগুলো গাছগুলোর কতই না প্রশংসা করে। অথচ তার ডালে একটাও ফুল নেই। এতদিনেও কি ফুল ফোটার সময় হয়নি তার? গোলাপ গাছটার এবার মনে হয়, তার ডালে আসলে কখনোই ফুল ফুটবে না। সে মনে মনে ভাবে, ফুলই যদি না ফোটে, তাহলে আর ফুলগাছের মূল্য কোথায়? আমার জীবন একদম বৃথা। এই ভেবে সে মন খারাপ করে খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দেয়। রোজ এসে মালী তার গোড়ায় পানি দেয়, কিন্তু গোলাপ গাছ সেই পানি খায় না। দিন দিন সে শুকিয়ে যেতে থাকে। পাতাগুলো হলুদ হতে থাকে। তার এই অবস্থা দেখে বাগানের অন্য গাছেরা তাকে খুব করে বোঝাতে থাকে যেন সে এভাবে খাওয়া-দাওয়া না ছেড়ে দেয়। এভাবে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ডালে ফুল ফুটবে কিভাবে? গোলাপ গাছ কারও কথাই শোনে না। সে একদম ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা আসে। ঝুম বৃষ্টি নামে। গোলাপ গাছের পাশেই রেইন লিলির ঝোপটা গোলাপি হয়ে ওঠে ফুলে ফুলে। সুন্দর সুন্দর তারার মতো দেখতে গোলাপি ফুল, আর কী মিষ্টি ঘ্রাণ! প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কদম গাছটাও ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যায়। সাদা বলের মতো কদম ফুটে থাকে তার গা জুড়ে। কিন্তু গোলাপ গাছটার ডালে এখনো ফুল ফোটা দূরে থাক, কোনো কুঁড়িও আসে না। তার আরও মন খারাপ হয়। সে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আরও উদাসীন হয়ে যায়। কারও সঙ্গে কথা বলে না। মনমরা হয়ে থাকে। কদম গাছটা বলে, সবার জীবনে একই সময়ে সফলতা আসে না, গোলাপ। প্রত্যেকের জীবনে একটা ঘড়ি থাকে। তার নিজের ঘড়ি। সেই ঘড়িতে যখন সময় হয়, তখন সফলতা আসে। কারও আগে সময় হয়, কারও পরে। কিন্তু তাই বলে তো হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। হাল ছেড়ে দিলে তো জীবনের ঘড়ি বন্ধ হয়ে যাবে, জীবন থেমে যাবে। গোলাপ গাছ শুনতেই চায় না কোন কথা। বর্ষা পেরিয়ে শরৎ আসে। শিউলি গাছের তলা সাদা হয়ে যায় ফুলে ফুলে। রোজ ভোরে সারা বাগান মৌ মৌ করে শিউলির ঘ্রাণে। কিন্তু গোলাপ গাছে আর ফুল আসে না। শিউলি গাছটা গোলাপকে বলে, এই যে দেখো, এতদিন পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, রেইন লিলি, কদম- সবার ডালে ডালে ফুল ফুটেছে। তাই বলে কি আমি হতাশ হয়ে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি? দিইনি তো। এই যে দেখ, ধৈর্য ধরে থাকার ফল আমি এখন পাচ্ছি, দেখো, কী সুন্দর ফুল এখন আমার। যদি আমি ধৈর্য না ধরে থাকতাম, আগেই হাল ছেড়ে দিতাম, তাহলে কি সফল হতাম বলো? সবকিছুতে ধৈর্য ধরতে হয়। আশা ছাড়তে হয় না কখনও। কিন্তু গোলাপ গাছ কি আর সেই কথা শোনে? সে সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে, কাঁদে, ঠিক করে খায় না। দেখতে দেখতে শীতকাল এলো। ডালিয়া গাছে কুঁড়ি এলো, গাঁদা গাছে ফুল এলো। এখনও গোলাপ গাছে কোন কুঁড়ি আসেনি। গোলাপ গাছ এবার ঠিক করল, এই জীবন রাখবেই না সে। তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। তার মরে যাওয়াই ভাল। সে এবার সব রকম খাওয়া-দাওয়া একদম বন্ধ করে দেবে ঠিক করল। হঠাৎ তার পাশ থেকে ডালিয়া গাছটা বলে উঠল, আরে আরে! গোলাপের ডালে ওটা কী? কুঁড়ি না? তার কথা শুনে বাগানের সবাই গোলাপের দিকে তাকাল। গোলাপ নিজেও তার ডালটার দিকে তাকাল। তাই তো! ছোট্ট সবুজ একটা কুঁড়ি! গোলাপ গাছের যে কী আনন্দ হলো! সে খুব ভাল করে খাওয়া-দাওয়া শুরু করল। প্রতিদিন কুঁড়িটাকে দেখে সে। প্রতিদিন কুঁড়িটা একটু একটু করে বড় হয়। বাগানের সব গাছ অপেক্ষা করে গোলাপের ফুল ফোটার। তারপর একদিন সেই মুহূর্ত আসে। গোলাপের কুঁড়ির পাপড়িগুলো একে একে খুলতে থাকে। যতই কুঁড়িটা পাপড়ি মেলে, ততই সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এত সুন্দর ফুল তারা কখনোই দেখেনি। ধীরে ধীরে কুঁড়িটার ফোটা শেষ হয়। সে এক অপূর্ব সুন্দর লাল গোলাপ। এত সুন্দর ফুল বাগানের কেউ কখনও দেখেনি। গোলাপ গাছ আনন্দে কেঁদে ফেলে। বাগানের অন্য গাছদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, তোমরা ঠিকই বলেছিলে। ধৈর্য ধরা আর আশাবাদী থাকাই সাফল্য এনে দেয়। মুগ্ধতা নিয়ে নিজের ডালের গোলাপটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এত চমৎকার ফুল সে নিজেও কখনও দেখেনি! এ জন্যেই বুঝি সবাই বলে, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়!
×