খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ করোনার এই মহামারীতে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারী কর্মকর্তা, চিকিৎসক, পুলিশ, মিডিয়াকর্মীসহ তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা করোনা মোকাবেলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ার পর কর্মহীনদের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার।
তারই ধারাবাহিকতায় করোনা ঝুঁকি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশে তৃণমূল পর্যায়ে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে মানবিকতার গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছেন বরিশালের তৃণমূল পর্যায়ের কয়েক জনপ্রতিনিধি। তারা গ্রামাঞ্চলে লকডাউনকে সফল করা থেকে শুরু করে সরকারের নির্দেশে ঘরে থাকা কর্মহীন পরিবারের দ্বারে দ্বারে কখনও নিজস্ব অর্থায়নে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম, সরকারের ভিজিএফ, ভিজিডি ও প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রীসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পৌঁছে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে সত্যিকার অভাবী মানুষের কাছে সরকারীভাবে বরাদ্দকৃত এবং ব্যক্তিগত অর্থায়নে এসব খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে তারা (জনপ্রতিনিধি) এলাকায় সত্যিকার মানবপ্রেমিক জনপ্রতিনিধির মর্যাদা পেয়েছেন। এলাকার সাধারণ জনগণ তাদের প্রশংসা করছেন।
এসব ইউপি চেয়ারম্যানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাদের রাজনৈতিক অভিভাবক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির কঠোর নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে সুবিধাভোগী কতিপয় ব্যক্তির কাছে খাদ্যসামগ্রীর দায়িত্ব না দিয়ে নিজ নিজ হাতে কর্মহীনদের দ্বারে দ্বারে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ায় কতিপয় চেয়ারম্যানরা রোষানলে পড়ছেন। এ নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। সূত্রমতে, করোনার ক্রান্তিলগ্নে বর্তমানে করোনার চেয়েও টাটকা খবর হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনগড়াভাবে উত্থাপিত সরকারীভাবে বরাদ্দকৃত জেলেদের চাল চুরির খবর। বরিশাল জেলা প্রবেশদ্বার গৌরনদী উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নে নিবন্ধিত ৪৫৭ জন জেলের মধ্যে সরকারীভাবে ১১১ জন জেলের নামে ৮০ কেজি করে চাল বরাদ্দ হয়েছে। একইভাবে বার্থী ইউনিয়নের নিবন্ধিত ৩১১ জেলের মধ্যে ৮০ জন, চাঁদশী ইউনিয়নের ৮৯ জেলের বিপরীতে ৮০ জন, মাহিলাড়ার ১৮১ জেলের বিপরীতে ১১৭ জন, বাটাজোরের ২০৮ জেলের বিপরীতে ৯০ জন, নলচিড়ার ৭০৫ জেলের মধ্যে ১৭৭ জন, সরিকল ইউনিয়নের ৬৮৯ জেলের মধ্যে ১৭৭ জন ও পৌরসভার নিবন্ধিত ১৯৬ জন জেলের বিপরীতে ১০৪ জন জেলের প্রত্যেকের নামে ৮০ কেজি করে চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বরাদ্দকৃত চাল জেলেদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। নলচিড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম হাফিজ মৃধা জানান, তার ইউনিয়নের নিবন্ধিত ৭০৫ জেলের মধ্যে সরকারীভাবে বরাদ্দকৃত ১৭৭ জেলের মধ্যে ৮০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। বরাদ্দ না থাকায় বাকি নিবন্ধিত ৫২৮ জন জেলের মধ্যে চাল বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। সরিকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ফারুক হোসেন মোল্লা জানান, তার ইউনিয়নের নিবন্ধিত ৬৮৯ জন জেলের মধ্যে যখন ১৭৭ জন জেলেকে ৮০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে তখন কিন্তু ৫১২ জন নিবন্ধিত জেলেকে বরাদ্দ না থাকায় চাল দেয়া সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে ওইসব জনপ্রতিধিদের সঙ্গে বিগত নির্বাচনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হওয়া কতিপয় ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের লোকজন তাদের ফায়দা হাসিলের জন্য ও আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের রাজনৈতিক মাঠ গোছাতে জনপ্রতিনিধিদের হয়রানি শুরু করেছে। ওইসব ব্যক্তি বরাদ্দ না থাকায় চাল না পাওয়া জেলেদের চাল চেয়ারম্যানরা আত্মসাত করেছে বলে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আগেও যখন এভাবে ঘাটতি বরাদ্দ আসত তখন সকল নিবন্ধিত জেলেদের মধ্যে সমবণ্টন করে সরকারী বরাদ্দকৃত চাল বিতরণ করত। এ কারণেই অনেক চেয়ারম্যানের ভাগ্যে চাল চুরির অপবাদ জুটেছে। খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের পরিষদের ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, ইউপি চেয়ারম্যান, মৎস্য কর্মকর্তা ও ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতিতে তার ওয়ার্ডের নিবন্ধিত ২৪ জেলের মধ্যে বরাদ্দ অনুযায়ী মাত্র আটজন জেলেকে ৮০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। চাল পাওয়া আট জেলে পরবর্তীতে গ্রামে গিয়ে মানবিক কারণে নিবন্ধিত ২৪ জেলেদের মধ্যে সমভাগে চাল ভাগ করে নিয়েছেন। যা প্রথমে তিনি অবগত ছিলেন না। তিনি আরও জানান, এরমধ্যে এক জেলের নাম ইদ্রিস মাতুব্বর। সে (ইদ্রিস মাতুব্বর) তার নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী কুদ্দুস মাতুব্বরের ছোট ভাই। ওই ওয়ার্ডের জেলে কালাম হাওলাদার, উত্তম শিকদার, পুণ্য হালদারসহ সাত জেলে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৮০ কেজি করে চাল পাওয়ার পর আমরা চাল নিয়ে গ্রামে আসি। এক পর্যায়ে অন্য নিবন্ধিত জেলেরা জানান, তাদের ঘরে খাবার নেই। বিষয়টি শোনার পর আমরা আট জেলে নিজের ইচ্ছায় ২৪ জেলের মধ্যে সমভাবে চাল ভাগ করে নিয়েছি। জেলে কালাম হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৮০ কেজি চাল পাওয়ার পর ইদ্রিস মাতুব্বর নামের ওই ব্যক্তি তাদের আরও চাল পাইয়ে দেয়ার কথা বলে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়। পরবর্তীতে তারা (কালাম মোল্লাসহ অন্য জেলে) জানতে পারেন স্বাক্ষর নেয়া ওই সাদা কাগজে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে চাল আত্মসাতের অভিযোগ এনে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ইদ্রিস মাতুব্বর। চাল বিতরণে অনিয়ম না হওয়া সত্ত্বেও শুধু নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে চাল আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। একইভাবে অন্য ইউনিয়নে জেলেদের চাহিদার তুলনায় সরকারী বরাদ্দ কম থাকায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা সদস্য-সদস্যাদের।
সাবেক ইউপি সদস্যের ষড়যন্ত্র ॥ একই নামে দুইজনের ভাতার বই থাকায় একজনের বই অপরজনের সঙ্গে বদল হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাবেক ইউপি সদস্যের রোষানলে পড়েছেন বর্তমান ইউপি সদস্য। ঘটনাটি গৌরনদী উপজেলার শাহাজিরা গ্রামের। ওই গ্রামের মৃত বসু মীরের পুত্র কালাম মীর জানান, তার মা আনোয়ারা বেগম কয়েক বছর যাবত বিধবা ভাতা পেয়ে আসছেন। কয়েক মাস আগে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে আরেক আনোয়ারার সঙ্গে তার মায়ের ভাতা বই বদল হয়ে যায়। যা ইউপি সদস্য ফারুক সরদারের মাধ্যমে তারা ফিরে পেয়েছেন। অথচ বিষয়টি নিয়ে একটি মহল সরিকল ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ডের জনপ্রিয় ইউপি সদস্য ফারুক সরদারকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য ফারুক সরদার জানান, তার গ্রামে আনোয়ারা বেগম নামের একজনের ভাতার বইয়ের সঙ্গে অপর আনোয়ারা বেগমের ভাতার বই পরিবর্তন হয়ে যায়। এ ঘটনাকে পুঁজি করে সাবেক ইউপি সদস্য বাদশা মীর তাকে (ফারুক) বিভিন্ন ধরনের হয়রানি শুরু করেছে। এমনকি তার (ফারুক) বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করতে বিধবা আনোয়ারা বেগমের পরিবারকে চাপ প্রয়োগও করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
সর্বপ্রথম এনজিও’র খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ॥ করোনার প্রায় দুইমাস পর প্রায় দুই শতাধিক সদস্যদের সহায়তার জন্য বরিশালে সর্বপ্রথম গত ১০ মে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের উজিরপুর উপজেলার ধামুরা শাখার আয়োজনে এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন ব্যাংকের বরিশাল জোনের জোনাল ম্যানেজার মোঃ সাইদুর রহমান ভূঁইয়া, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল হালিম, প্রোগ্রাম অফিসার ইমাদুল ইসলাম ও শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ কামাল হোসেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ॥ দেশরত্ম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবার পরিবারের সদস্যদের ঈদের খরচের টাকায় করোনায় কর্মহীন ১৫শ’ পরিবারের মাঝে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন মুলাদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন। গত ১২ মে দিনভর তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা বাটামারা ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এসব খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশে ঈদের আগে আরও যথাসাধ্য চেষ্টা করব অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: