ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতি ও অপরাজনীতির খন্ডচিত্র

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ১৫ মে ২০২০

রাজনীতি ও অপরাজনীতির খন্ডচিত্র

উঁচু মানসম্পন্ন টেকসই যে কোন শিল্পনির্মাণে মনস্তত্ত্বে¡র যুক্তিসিদ্ধ উপাদানগুলোর সার্থক সমন্বয়ে সুদক্ষ পূর্বপরিকল্পনা প্রণয়ের মাধ্যমে প্রস্তুতিগ্রহণ উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের পূর্ণ বাস্তবায়নে প্রবল ভূমিকা রাখে। মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ‘মায়াবী দৌলত’ পাঠ করে তেমনই পরিশ্রমলব্ধ আগাম প্রস্তুতির জ্বলজ্বলে চিহ্নগুলো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কালিঙ্গা বিলের আশপাশের ফুলঝুড়ি ও বনগাঁও ছাড়াও ষোলো-সতেরোটি গ্রামের মানুষের আচার-আচরণ, অভ্যাস, নীতিবোধসহ অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপাদান তথা গ্রামীণ জীবনধারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে, হাডুডু ও নারিকেল পেটানো খেলা। প্রতিবছর খেলাগুলোকে কেন্দ্র করে আড়মোড়া ভেঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে এখানকার নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এ উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলো হচ্ছে- দেলু চোর, মঞ্জিলা, মঞ্জু, হারিছ, মজনু, হাছুন আলী, আজিজ মাস্টার, এবাদ আলী, তহুরা ও বাসেত বাঙালী। চরিত্র বিশ্লেষণ শেষে সাধারণ পাঠকগণ দেলু চোরকেই আখ্যানটির প্রধান চরিত্র বা নায়ক হিসেবে নির্ধারণ করবেন। কেননা, তাকে ঘিরেই কাহিনীটি ডালপালা বিস্তার করে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই ডালপালা গজানোর প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে দেলু চোরের অন্তর্জগতে প্রগাঢ় শ্রদ্ধার সঙ্গে ধারণ ও লালন করা এক আদর্শ। সেই আদর্শ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ। সেই আদর্শ দেলুর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে একটি কোটের মাধ্যমে। সেটি হলো মুজিব কোট। বংশগত চোর দেলুর চুরি করা মালামালের সঙ্গে এই কোটটিও চলে আসে। সে চিনতে পারে, এটি মুজিব কোট। জাতির পিতার আদর্শ বহন করা অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কোট। এটিকে কেন্দ্র করে তার বুকের ভেতর কেমন পরিবর্তনের ঢেউ খেলে যায়। নেতিবাচক অভ্যাসগুলো অলৌকিক আলোকবৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে তার মানসজগত হতে থাকে সফেদ জ্যোৎ¯œার মতো, সাদা অফসেট কাগজের মতো দাগহীন, ধবধবে। সত্য ও সুন্দরের নির্ভেজাল উপমার মতো নিটোল, চকচকে, ঝকমকে। তার মধ্যে জন্ম নেয় দেশপ্রেম। ভেতরে ভেতরে প্রতিবাদীও হয়ে ওঠে সে। কোটটিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি হিসেবে সম্মান দিয়ে পলিথিন কাগজে মুড়িয়ে সযত্নে ট্রাঙ্কে ভরে রাখে। বৃষ্টি এলেই পানি পড়ে, ভিজে জবজবে হয়ে যায় গৃহতল- এমন জীর্ণ গৃহে কোটটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিংবা তার পক্ষে এর মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে- এই ভেবে এটি উপহার দেয়ার জন্য আদর্শবান মানুষ খুঁজে বেড়ায় দেলু। কিন্তু পায় না। ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক-দালালদের দাপিয়ে বেড়ানো দুঃসময়ে, বঙ্গবন্ধু বিরোধী দাঁতাল অন্ধকার হাঁ করে থাকা, আকাশে মাংসাশী শকুনের ঝাঁক উড়ে বেড়ানো অশুভ দিনে মুজিব কোট উপহার দেয়ার মতো শুভ্র মনের দেশদরদী সাহসী মানুষ খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। তখন আজিজ মাস্টারের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধারাও জীবনের ভয়ে চুপ। সে কাকে দেবে এই কোট? এই কোট দেখেই কেউ কেউ ভয়ে চুপসে যায়। কেউ কেউ কটুকথা বলে, হেনস্তা করে তাড়িয়ে দেয়। এর জন্য পুলিশের কাছে ধরিয়েও দেয়া হয় তাকে। তখন মুজিবের নাম নেয়া মানেই অমানবিক নির্যাতন অথবা মৃত্যু। এতটা বৈরী সময়েও বুকের মধ্যে পরম মায়ায় মুজিব কোটটি আগলে রাখে দেলু। এটি বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তি পায়। শক্তি পায়। সুপথের দিশা খুঁজে পায়। সে একদিন মানুষরূপী প্রেতাত্মাদের উৎপাতে, জানোয়ারদের বিষাক্ত নখে খামচে ধরা সমাজ থেকে, বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে, সবকিছু ফেলে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। সঙ্গে নেয় শুধু সেই মুজিব কোট। আর বাপের ভিটের একমুঠো মাটি। একদিন সে সেই কোটকে কেন্দ্র করেই মুজিব-আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে খাঁটি মানুষে পরিণত হয় এবং পরিবারবর্গসহ আলোকিত জীবনে ফিরে আসে। মুজিবের চেতনায় প্রদীপ্ত হয়ে বাঙালী কেবল রাজপথের লড়াকু সৈনিক হয়ে উঠবে, তা নয়। পেতে পারে বদলে যাবার মন্ত্র। হতে পারে জীবনযুদ্ধে দুঃসাহসী সৈনিক। হার না মানা বীর। দেলু তারই শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। একমাত্র সন্তান মঞ্জুকেও নিজ চেষ্টায় নিষ্ঠবান, আদর্শবান এবং হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত করে গড়ে তুলে দেলু। শেষ পর্যন্ত সেই সন্তানের গায়ে মুজিব কোটটি পরিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত হয় সে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে মনে হবে, দেলু নয়, মুজিব কোটই এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তাই যদি হয়, এটিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে দীপ্তমান অনন্য এক উপন্যাস অবশ্যই বলা যায়।
×