ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক

চিরদিনের জন্য চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ॥নিভে গেল চেতনার বাতিঘর

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১৫ মে ২০২০

চিরদিনের জন্য চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ॥নিভে গেল চেতনার বাতিঘর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মেধা ও মননে সময়ের এক আধুনিক মানুষ জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। তাঁর হাতে প্রাণ পেয়েছে এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন। সমৃদ্ধ হয়েছে ভাষাও সাহিত্যের গবেষণা। জ্ঞানের চর্চায় আলোকিত করেছেন শিক্ষার ক্ষেত্র। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের বিকাশে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেই ভূমিকার মূল্যায়ন করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- ‘জানি দৃষ্টি তার সদা মানবের প্রগতির দিকে/প্রসারিত। কী প্রবীণ, কী নবীন সকলের বরেণ্য নিয়ত’। এই কবিতার পঙ্ক্তিমালার মতোই বর্ণবহুল কর্মজীবনের আশ্রয়ে জাতির চেতনার বাতিঘরে পরিণত হয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। নিভে গেল সেই চেতনার বাতিঘরটি। পগতির পানে প্রসারিত দৃষ্টিটি আর কখনও চাইবে না চোখ মেলে। সঙ্কটে দেখাবেন না পথের দিশা কিংবা বাঙালিত্বের উদ্্যাপনে থাকবেন না সামনের সারিতে। শেষ হলো মুক্তচিন্তা, সংস্কৃতির বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কীর্তিমান মানুষটির দীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য জীবনের পরিভ্রমণ। বৃহস্পতিবার জাতির বাতিঘর হিসেবে পরিচিত এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। এদিন বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। এই মৃত্যুর সঙ্গে যবনিকা ঘটল এক কিংবদন্তির জীবনের। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। রেখে গেছেন ছেলে আনন্দ জামান, স্ত্রী সিদ্দিকা ওহাব, দুই মেয়ে রুচিবা ও শুচিতা এবং একমাত্র ছেলে আনন্দ আনন্দ জামানকে। আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান জনকণ্ঠকে জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে সিএমএইইচে চিকিৎসাধীন অবস্থার মৃত্যুবরণ করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কোথায় এবং কখন আনিসুজ্জামানকে সমাধিস্থ করা হবে সে বিষয়ে আজ শুক্রবার পারিবারিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। বৃহস্পতিবার তার মরদেহ সিএমএইচের হিমাগারে রাখা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা কোভিড টেস্টের পর আজ পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করবে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, পরিবেশমন্ত্রী মোঃ শাহাবউদ্দিন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, খেলাঘরের সভাপতিমন্ড লীর চেয়ারম্যান পান্না কায়সারসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোক জানিয়েছে বাংলা একাডেমি, ছায়ানট, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। রাষ্ট্রপতির শোক ॥ শোকবাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। রাষ্ট্রপতি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ এদিকে তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোক বার্তায় তিনি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তার শোকাহত পরিবার-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার দিনগুলোতে আনিসুজ্জামানকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রয়াত শিক্ষকের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী তার শোকবার্তায় বলেন, ‘আমি ছিলাম স্যারের টিউটোরিয়াল গ্রুপের শিক্ষার্থী।’ হৃদরোগ, কিডনি ও রক্তের সংক্রমণসহ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় জটিলতা নিয়ে গত ২৭ এপ্রিল বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে ৯ মে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ড. আনিসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমায় মোহাম্মদপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক আবু তাহের মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম ও মাতা গৃহিণী সৈয়দা খাতুন। মা হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তার বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। বলা যায়, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ছিল তাদের পরিবার। ১৯৫১ সালে নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে বাংলায় ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য যোগদান করেন। তার বিষয় ছিল- ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালী মুসলমানের চিন্তাধারায় ১৭৫৭-১৯১৮’। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রী অর্জন করেন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল’। তিনি ১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমি বৃত্তি পান, সেই বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এ্যাডহক ভিত্তিতে তিন মাসের জন্য যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। পরে ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। সেখান থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপকে পদে সম্মানিত করে। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আনিসুজ্জামান অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বটে কিন্তু প্রকৃত নেশা তার লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity, Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records, Creativity, Reality and Identity, Cultural Pluralism, Identity, Religion and Recent History, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, আমার চোখে, বাঙালী নারী : সাহিত্যে ও সমাজে, পূর্বগামী, কাল নিরবধি, বিপুলা পৃথিবী উল্লেখযোগ্য। বেশকিছু উল্লেখযোগ্য বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদও করেছেন এবং নানা বিষয়ে বই সম্পাদনা করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্যক্ষেত্রে, সাংগঠনিকক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত পুরস্কার, একুশে পদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার (১৯৯০), দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক (১৯৯৩), অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪)। এছাড়াও তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট সম্মাননা পেয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য স্মারক বক্তৃতার মধ্যে রয়েছে- এশিয়াটিক সোসাইটিতে (কলকাতা) ইন্ধিরা গান্ধী স্মারক বক্তৃতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎচন্দ্র স্মারক বক্তৃতা, নেতাজী ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান এ্যাফেয়ার্সে নেতাজী স্মারক বক্তৃতা এবং অনুষ্টুপের উদ্যোগে সমর সেন স্মারক বক্তৃতা উল্লেখযোগ্য।
×