ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নগদ পাবে ৫০ লাখ পরিবার

প্রকাশিত: ২২:৫১, ১৫ মে ২০২০

নগদ পাবে ৫০ লাখ পরিবার

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ইতিহাসে প্রথম মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান কর্মসূচী উদ্বোধনের পাশাপাশি কর্মসৃজন কার্যক্রমে আরও আড়াই হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, দেশের এই সঙ্কটকালে দেশের প্রতিটি মানুষের কষ্ট লাঘব আর কোন মানুষ যেন কষ্ট না পায় সেটাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য। কারও যেন কষ্ট না হয় এবং সবাইকে কিছু দিতে পারি সেই চিন্তা থেকেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা বিজয়ের জাতি। যতই ঝড়-ঝাপটা আসুক, যত আঘাত আসুক, যাই আসুক না কেন- আমাদের সবসময় বিজয়ী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলতে হবে। ইনশাল্লাহ আমরা করোনার আঘাতও মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিনা খরচে ৫০ লাখ পরিবারের প্রত্যেকের হাতে ঈদের আগেই আড়াই হাজার টাকা করে পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রতিটি মানুষের কষ্ট দূর করাই আমাদের লক্ষ্য এবং আমরা সেটাই চাই। আমাদের এত মানুষ। মানুষের জীবনে প্রয়োজন অনেক বেশি, মানুষের ক্ষুধার জ্বালা আমরা বুঝি। তাই এ অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। আমরা হয়তো অনেক বেশি দিতে পারবো না। কিন্তু কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও সবাই পাবে। কেউ যাতে বঞ্চিত না হয়, সবাই যাতে সামান্য হলেও সহায়তা পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে কারো কাছে যেতে হবে না, ধর্না দিতে হবে না। কিন্তু সবার কাছে টাকা হেঁটে পৌঁছে যাবে। মানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পৌঁছে যাবে। অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী ঈদ ও রমজান উপলক্ষে দেশের সকল মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের আর্থিক সহায়তা এবং ঈদের আগে আরও সাত হাজার কওমি মাদ্রাসাকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী করোনা পরবর্তী ব্যাংকহারে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশি করে প্রবাসীসহ দেশের তরুণ-তরুণীদের ঋণ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারে সেজন্য কর্মসংস্থান ব্যাংককে ২ হাজার কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে আরও ৫০০ কোটি টাকা সরকার থেকে আমানত প্রদানের কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে সুইচ টিপে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান কর্মসূচীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রতি পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে মধ্যে নগদ অর্থ প্রদানে ইতোমধ্যেই সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকা ছাড় করেছে সরকার। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিনা খরচে প্রত্যেক পরিবারের হাতে ঈদের আগেই এই টাকা পৌঁছে দেয়া হবে। একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে মোবাইল ব্যাংকিং/অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংবলিত বোতাম টিপে ¯œাতক ও সমমান পর্যায়ের ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বিতরণ কার্যক্রমও উদ্বোধন করেন। ভিডিও কনফারেন্স সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সংযুক্ত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া গণভবন প্রান্তে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পিএমও এবং গণভবনের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বরগুনা, শরিয়তপুর, সুনামগঞ্জ এবং লালমনিরহাট জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সংযুক্ত হয়ে উপকারভোগী জনগণ ও উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ইতোমধ্যে অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য ১৭টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমনন্ত্রী। আজকে (বৃহস্পতিবার) ১৮তম প্যাকেজে সেটা হলো পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনকে আপনি ৫০০ কোটি করে সর্বমোট ২০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তাতে সর্বমোট ১ লাখ ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হলো, যা মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়ানোর জন্য আরও ২ হাজার কোটি টাকা আমানত দেয়া হবে। ২ হাজার কোটি টাকা বিশেষ আমানত দিয়ে দেবো। আমাদের যুবক শ্রেণী যাতে বেকার হয়ে ঘুরে না বেড়ায় তার জন্য তারা সেখান থেকে ঋণ নিতে পারবে। নিজেরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে। অথবা যৌথভাবে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে। নিজেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। সবাই আস্থা-বিশ্বাস ও মনোবল নিয়ে থাকুন। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রবাসীদের জন্য ঋণ সুবিধা বাড়াতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের আমানত বাড়ানো হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যারা প্রবাসী তারা কিন্তু আমাদের রেমিটেন্স পাঠায়। তারা যেন ঘরবাড়ি বিক্রি না করে ঋণ নিয়ে বাইরে যেতে পারে, বিদেশে যেতে পারে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক নামে আরেকটি বিশেষ ব্যাংক আমরা প্রতিষ্ঠা করে দেই। সেই ব্যাংকে আরও টাকা দেব। সেই ব্যাংকেও আমরা আরও অতিরিক্ত ৫শ’ কোটি টাকা দেব। এর আগে সেখানে আমরা ৪শ’ কোটি টাকা দিয়েছি। আমরা আরও ৫শ’ কোটি টাকা জমা করে দিচ্ছি। তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে এখন প্রবাসে কাজের পরিধি সীমিত হয়ে গেছে। সেখানে বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছে, অনেকে দেশে ফিরে আসছে। তারা আমার দেশের নাগরিক, তারা সেখানে কষ্ট করুক তা আমরা চাই না। ফিরে এসে এখানেও যাতে কিছু কাজ করে খেতে পারে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, শিল্পায়নে তারা যাতে সুযোগটা পায় সে জন্য তাদের ওই ব্যাংকে আরও ৫শ’ কোটি টাকা আমরা দিয়ে দিচ্ছি। পাশাপাশি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আছে। সেখানে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ এই কর্মসূচী নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আমরা ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। সেখানেও এই ব্যবস্থা করছি। করোনা মোকাবেলায় আমরা ২ হাজার ডাক্তার, ৬ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া আরও স্বাস্থ্যকর্মী ও হেলথ টেকনিশিয়ান নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর কারণে সারাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার নগদ, বিকাশ, রকেট ও শিউরক্যাশের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের হিসাবে সরাসরি এ নগদ অর্থ পাঠানো হচ্ছে। এ সহায়তার জন্য ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারে চারজন সদস্য ধরা হলে এই নগদ সহায়তায় উপকারভোগী হবে অন্তত দুই কোটি মানুষ। একই সঙ্গে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তিনি। এ সহায়তার জন্য ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যখন প্রথমবার সরকারে আসি, তখন আমাদের যুবক শ্রেণীর যেন বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে না হয়। এজন্য একটা বিশেষ ব্যাংক করে দিয়েছিলাম; কর্মসংস্থান ব্যাংক। সেটার কার্যক্রম এখনও আছে, তা হলো বিনা জামানতে একজন যুবক, তিনি শিক্ষিতই হোন, আর অশিক্ষিত হোন; বেকার হলেই জামানত ছাড়াই স্বল্পসুদে দুই লাখ টাকা ঋণ নিতে পারবেন। এই ঋণ নিয়ে নিজেরা ব্যবসা করতে পারেন কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে যৌথভাবে ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারবেন। সেই সুযোগ সৃষ্টির জন্য আমি কর্মসংস্থান ব্যাংক সৃষ্টি করেছি। এই ব্যাংকের ঋণ আরও বৃদ্ধি করার জন্য সরকার বিশেষ আমানত দিচ্ছে। যাচাই-বাছাই করেই অর্থ সহযোগিতা দিচ্ছি ॥ ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদানের কথা উল্লেখকরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে যারা একেবারে ভাসমান মানুষ রয়েছে, নির্মাণ শ্রমিক, গণপরিবহন শ্রমিক আছে, রেস্টুরেন্ট, ফেরিওয়ালা, রেলওয়ে কুলি, মজুর, ঘাট শ্রমিক, নরসুন্দর, রিক্সা-ভ্যান-গাড়ি চালক, নি¤œবিত্ত আয়ের লোকসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষ যারা দৈনন্দিন কাজ করে খেত। একটু চা বিক্রি করে খেত বা একটা দোকান দিয়ে খেত- তাদের কোন কাজ নেই। কারণ মানুষ যাতায়াত করে না। তাদের কাজ থাকবে কোত্থেকে? সেখানে তারা শ্রম দিতে পারছে না। তাদের যে দিনের আয়, সেই আয়ের পথ বন্ধ। তিনি বলেন, এসব মানুষদের কীভাবে এই রমজান মাসে আমরা একটু সাহায্য করতে পারি, সেই লক্ষ্য নিয়েই এই উদ্যোগ নিয়েছি। সেইভাবে অনেক হিসাব-নিকাশ করে আমরা কিছু অর্থ সাশ্রয় করার চেষ্টা করেছি, কিছু অর্থ ইতোমধ্যে আমরা ব্যবস্থা করেছি। সেই লক্ষ্য নিয়েই প্রায় আরও ৫০ লাখ মানুষকে আমরা সাহায্য দেব। ওএমএসের মাধ্যমে মানুষ ১০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক যে নিরাপত্তা বেষ্টনী, বয়স্ক-বিধবা-প্রতিবন্ধী-মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতা আছে, সেই ভাতাগুলো যেমন অব্যাহত থাকছে। সেই ভাতাগুলো আমরা দিচ্ছি। আমরা মাতৃকালীন ভাতা দিচ্ছি। এ রকম ভাতাগুলোও চালু থাকবে। সরকারপ্রধান বলেন, এসব সুবিধাভোগী ও ১০ টাকার চালের রেশনকার্ডধারীকে বাদ দিয়ে বাকি যারা রয়ে গেছেন, তাদের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যারা সহযোগিতা পান তাদের বাইরে যারা এখন রয়ে গেছেন, যারা অন্তত নিজেরা কিছু কাজ করে নিজের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাদের কথা চিন্তা করেই আমরা তাদের আড়াই হাজার টাকা করে জনপ্রতি এককালীন প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, এই টাকাটা দেয়ার জন্য কিন্তু কমিটি আছে। সেই কমিটিতে বারবার যাচাই-বাছাই করা হয়েছে এবং সেখানে দ্বৈততা পরিহার করার ব্যবস্থা করেছি। যারা একবার পান, যাদের নাম আছে তাদের নাম বাদ যাবে। করোনার সংক্রমণ বাড়লেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব ॥ করোনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শিথিলতার জন্য হয়তো সংক্রমণ একটু বেড়ে গেছে। তবে আশা করি, এটাও আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা এটা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। তবুও দেশের জনগণকে বলব নিজেরা একটু সুরক্ষিত থাকুন। তিনি বলেন, দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছি। মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি। দেশবাসীকে বলব, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা দিচ্ছে সেগুলো মেনে চলবেন। জীবন তো কখনও অচল হয়ে থাকতে পারে না। যে কারণে রোজার মাসে অনেকেরই জীবন-জীবিকার প্রয়োজন রয়েছে সেজন্য কিছু কিছু শিথিল করেছি। তিনি বলেন, করোনা এমন একটা অদৃশ্য শক্তির প্রভাব এবং আঘাত যেটা কেউ চোখে দেখে না, জানেন না কিন্তু তার ফলে সমগ্র বিশ্ব স্থবির হয়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে সামাজিকভাবে সারা বিশ্ব আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও আড়াইশ’ মতো মারা গেছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যেখানে দিনে হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। সরকারপ্রধান বলেন, আমরা শুরু থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। অন্যান্য দেশ যেভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বা আক্রান্ত হয়েছে, আমরা সেটা কিন্তু অনেক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। তবে কতদিন মানুষকে আটকে রাখতে পারি? মানুষের জীবনের প্রয়োজনটা অনেক বেশি। মানুষের ক্ষতি হবে, মৃত্যু হবে সেই চিন্তা করে যতই আমরা আটকে রাখি না কেন ক্ষুধার জ্বালাটা তার থেকে অনেক বেশি। মানুষের পেটে ক্ষুধার অন্ন যোগাতে হবে, কাজেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের জীবন মান চলমান রাখতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা অদৃশ্য শক্তি, এই শক্তি মোকাবেলা কোন বিশ্বই পারছে না। যত শক্তিধর দেশ, হোক সে অস্ত্রের দিক থেকে হোক আর অর্থের দিক থেকে বহু শক্তিধর দেশ দেখেছি। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এমন এক শক্তি যেখানে সব শক্তি পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। এদের কাছে সকলের আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, তবে লাভবান হয়েছে প্রকৃতির। যেখানে বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ প্রতিবেশ নষ্ট হয়েছিল নানা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছিল। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এই করোনার প্রভাবে জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ অচল, প্রকৃতি কিন্তু তার আপন গতিতে হেসে খেলে উঠেছে। এটিই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেছে সারাবিশ্বে। সবসময় মাস্ক পরে থাকা নয় ॥ সবসময় মাস্ক পরে না থাকার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা বলব না সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকেন। কেননা আপনাদের কিন্তু অক্সিজেন নিতে হবে, নিশ্বাস নিতে হবে। কারও সঙ্গে কথা বলার সময় বা যখন জনসমাগমে যাবেন বা বাজার-ঘাটে যাবেন তখন পরবেন। যখন এমনি থাকেন তখন কিন্তু এটা পরবেন না। এটা কিন্তু অনেক সময় ভালোর চেয়ে ক্ষতিও করে। তিনি বলেন, কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে অথবা হাঁচি-কাশি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনে যেন ভাইরাসটি সংক্রামিত না হয়, সেটা দেখতে হবে। যখন অফিসে কাজকর্ম করছেন, যখন নিজে কাজ কর্ম করছেন, তখন মাস্ক পরে থাকতে হবে তা কিন্তু নয়। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এমন মাস্ক পরতে হবে যাতে সহজে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া যায়। এন-৯৫ মাস্ক কিন্তু সাধারণ মানুষের পরার জন্য না। এটা যারা ডাক্তার, নার্স বা কোভিড রোগীর সেবা দেবে তাদের জন্য। এটা সাধারণ মানুষের পরার দরকার নেই বা যৌক্তিকতাও নেই। এমনকি ঘরে তৈরি মাস্কও পরা যায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এন-৯৫ মাস্ক শুধু চিকিৎসা যারা দেবেন, অপারেশন থিয়েটারে যারা থাকবেন বা আইসিইউতে থাকবেন, হাসপাতালে রোগীর পাশে যারা থাকবেন, যারা রোগীর পরীক্ষা করবেন তারাই পরবে। সাধারণ মানুষের এটা পরার কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই। এটা পরে অপচয় না করে হাসাপাতলে পাঠিয়ে দেয়াই ভাল। ইনশাল্লাহ এই অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি পাব। ঈদের আগে মসজিদ-মাদ্রাসায় যাবে সহায়তা ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সারাদেশে বিভিন্ন মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ অন্যরা আছেন। সাধারণত রমজান মাসে সবাই মসজিদে বেশি যায়। তারাবির নামাজ পড়েন, অনেকে দান করেন। এতে মসজিদের ভাল ইনকাম হয়। আমি খোঁজ নিচ্ছি, এখনও অনেক মসজিদ কমিটি ও বিত্তশালীরা দান করে যাচ্ছেনÑ এ খবর আমি জানি। তারপরও সরকারের একটা দায়িত্ব আছে। আমি ইতোমধ্যে একটি তালিকা করতে বলে দিয়েছি। সব মসজিদে রমজান-ঈদ উপলক্ষে আর্থিক সহায়তা দেব। আরও সাত হাজার কওমি মাদ্রাসায় ঈদের আগে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অনেক মাদ্রাসায় এতিমখানা রয়েছে। যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তারা খুব কষ্টের মধ্যে ছিল। তাদের কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে ছয় হাজার ৮৬৫টি কওমি মাদ্রাসায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পর্যায় আরও সাত হাজার কওমি মাদ্রাসায় ঈদের আগে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার পদক্ষেপ নিয়েছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মঙ্গা থাকে না ॥ প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন বাংলাদেশে মঙ্গা থাকে না, দরিদ্র থাকে না। এগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১ অর্জন করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা যখন আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় একটি অদৃশ্য শক্তির আঘাত আসলো। যার ফলে সারাবিশ্ব একেবারে থমকে গেছে। সারাবিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে আক্রান্ত। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। এই যে অদৃশ্য শক্তির হঠাৎ আক্রমণে সবাই বিপর্যস্ত। আমাদের ভূখ- ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনীতি সচল রাখা উচিত। এজন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। অন্যান্য দেশে যেভাবে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে এবং মারা গেছেন এর তুলনায় আমরা কিন্তু অনেক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের ক্ষুধার জ্বালাটা কিন্তু আমরা বুঝি। এ জন্য অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এমন একটি অদৃশ্য শক্তির মোকাবেলা কিন্তু কোন দেশই পারছে না। কত শক্তিশালী দেশকে আমরা দেখছি, এই করোনাভাইরাসের শক্তির কাছে সারেন্ডার করতে হচ্ছে। অনেক মহামারীর কাহিনী জানি, দুর্ভিক্ষের কাহিনী জানি। কিন্তু এবারের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের এক ইঞ্চি জায়গায়ও যেন অনাবাদি না থাকে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি পুনরায় আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। অন্তত খাদ্যের কষ্ট হবে না আল্লাহর রহমতে। সেটা আমরা ব্যবস্থা করতে পারব। কিছু নগদ সাহায্য দেয়া একান্ত অপরিহার্য। আমরা সেটুকু ব্যবস্থা করছি। সেইসঙ্গে যারা এখন বেকার আছেন, তারা কিছু কিছু কাজ করতে পারেন। যেখানে জমি-জমা আছে একটা কিছু চাষাবাদ করতে পারেন। নিজে উদ্যোক্তা হয়ে একটু কাজ করেন। নিজে আর্থিকভাবে যেমন আপনারা দাঁড়াতে পারেন, দেশও সহায়তা পাবে। তিনি বলেন, একেবারে বেকার বসে না থেকে নিজেরা কিছু কিছু কাজ করলে, সেটা শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে শক্তি পাবেন। আর দেশের উপকার হবে, পরিবারের উপকার হবে। এজন্য আমি সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, ফসল তোলার সময় আমাদের যে সমস্যাটা ছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থাটা বন্ধ। সাধারণত আমাদের এক অঞ্চলের ধান কাটতে অন্য অঞ্চল থেকে লোক আসে। তারা ধান কাটে। ধান কেটে টাকা নিয়ে যায়। কিন্তু এবার এটা সীমিত ছিল। তারপর আমরা যখন উদ্যোগ নিলাম, আমাদের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পদক্ষেপ নিল। কিন্তু সেখানেও লোকবলের অভাব ছিল। আমি প্রথমে আমাদের ছাত্রলীগকে আহ্বান জানালাম। যে যেখানে আছি, তাদের নিজের এলাকাসহ সব জায়গায় তাদের নামতে হবে এবং ধান কাটায় কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে ধান থেকে চাল হয়। আর এ চাল থেকে কিন্তু ভাত হয়। যা আমাদের মূল খাদ্য। কাজে সেই কাজ করতে লজ্জার কিছু নেই, বরং তা গর্বের বিষয়। আমরা যা খেয়ে জীবন বাঁচাই, সেই জায়গায় শ্রম দেব না! এই দৈন্যতা যেন কারও মনে না থাকে। এ সময় ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সত্যি আমি খুবই আনন্দিত এবং সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। ছাত্রলীগকে আমরা দেখেছি- তারা মাঠে নেমে কৃষকের ধান কেটে দিয়েছে। আমাদের কৃষক লীগ নেমে গেছে (ধান কাটতে)। আমাদের যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যেখানে ছিল প্রত্যেকে নেমে পড়েছে এবং ধান কাটায় সাহায্য করেছে। আজকে আমাদের সারা বাংলাদেশের কৃষকের গোলা ভরা ধান। যতই ঝড়-ঝাপটা আসুক, মাথা উঁচু করে চলুন ॥ স্নাতক ও সমমান পর্যায়ের ২০১৯ সালের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও টিউশন ফি প্রদানের কার্যক্রম তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড মাধ্যমে কিছু শিক্ষা সহায়তা দিয়ে থাকি। উচ্চ শিক্ষায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সেই সহায়তা দেয়া হয়। এখানে ট্রাস্টে স্থায়ী তহবিল গঠন করা আছে। সেই তহবিলে বিত্তবানরা বা অনেক প্রতিষ্ঠান অনুদান দেন। সেই ট্রাস্টের মাধ্যমে ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ২ লাখ ৯ হাজার ৬৭৪ জন ছাত্রছাত্রীর মাঝে উপবৃত্তি বাবদ ১০২ কোটি ৭৪ লাখ ২ হাজার ৬০০ টাকা এবং টিউশন ফি বাবদ ৮ কোটি ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ২০০ টাকা বিতরণ করা হলো। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা খুবই মেধাবী। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে এটা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। আমরা বিজয়ের জাতি। আমাদের শুধু সেটা মনে রাখতে হবে যে আমরা বিজয়ের জাতি। যতই ঝড়-ঝাপটা আসুক যত আঘাত আসুক, যাই আসুক না কেন আমাদের সব সময় বিজয়ী জাতি হিসেবে এই কথা চিন্তা করে মাথা উঁচু করে চলতে হবে। তিনি বলেন, দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছি। মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি। দেশবাসীকে বলব, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা দিচ্ছে সেগুলো মেনে চলবেন। জীবন তো কখনও অচল হয়ে থাকতে পারে না। আর ছোট ছোট শিশু কতদিন ঘরে বসে থাকবে। তাদের লেখাপড়ার সুযোগ করতে হবে। তাদের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে আরও কিছু মানুষ আছেন- যেমন হিজড়া-বেদে বা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমরা তাদের কিছুটা সহযোগিতা করার চেষ্টা করব। আর করোনাভাইরাসের সময় মা ও শিশুদের জন্য কী কী জিনিস করা যায় সে বিষয়ে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাব। এই মুজিববর্ষ উপলক্ষে যেহেতু আমরা আমাদের সমস্ত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে পারলাম না, কাজেই আমাদের যা যা টাকা-পয়সা এখানে- সেখানে ছিল, সেগুলো নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। আমরা সেখান থেকে যে অর্থ সাশ্রয় করতে পারছি সেগুলোও অসহায় মানুষদের দিচ্ছি। আমি জানি এটা কিছুই না। তারপরও যেটুকু দিতে পেরেছি, তা সামান্য হলেও মানুষের কাজে লাগবে বলে আশা করি। দোয়া করবেন যেন এভাবেই দিয়ে যেতে পারি। রূপসী গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবির দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, খেতে তরি-তরকারি, ফলমূল, ফল-ফলাদি যেন আরও ব্যাপকভাবে হয়। আমাদের দেশের মানুষ যেন দুধভাতে যেন ভাল থাকে।
×