শংকর কুমার দে ॥ গার্মেন্টস শিল্প এলাকা হয়ে উঠছে করোনাভাইরাসে হটস্পট। গার্মেন্টস শিল্পের কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। চাকরি হারানোর ভয়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষা না করে গোপন রাখছে গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এটা এতই ভয়াবহ বিপজ্জনক যে অনেকটা টাইম বোমার মতোই। যে কোন সময়ে টাইম বোমার মতো করোনাভাইরাসের বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে বলে শিল্পাঞ্চল পুলিশের দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে করোনার যে সংক্রমণ চলছে, সেই সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি যে এলাকাগুলোতে রয়েছে, তার মধ্যে তিনটি এলাকা হলো ঢাকা, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ। এই তিনটি এলাকাই গার্মেন্টস অধ্যুষিত এলাকা। সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে গার্মেন্টসগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত ২৬ এপ্রিল থেকে। এরপর থেকেই এই এলাকাগুলোতে রোগীর সংখ্যা অন্য সময়ের চেয়ে বাড়ছে। কয়েকটি গার্মেন্টস কারাখানাতেও রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর ফলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, বাংলাদেশে গার্মেন্টস এলাকাগুলো রেড জোনে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
দেশের অর্থনীতি এবং জীবিকার প্রয়োজনে গার্মেন্টস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। গার্মেন্টস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিদেশী অর্ডার। তখন গার্মেন্টস মালিকরা আশ্বস্ত করেছিলেন যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে গার্মেন্টসগুলো খোলা হবে। কিন্তু গার্মেন্টসগুলো খোলার পর এখন পর্যন্ত দেখা গেছে যে, হাতে গোনা দু’একটি গার্মেন্টস ছাড়া অধিকাংশ গার্মেন্টসে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।
শিল্পাঞ্চল পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে ২৬ এপ্রিল যখন দেশের পোশাক কারখানা চালু করা হয়, তখন থেকেই শিল্পাঞ্চলগুলোতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কায় ছিল। পোশাক কারখানাগুলো যখন বন্ধ ছিল তখন কিন্তু করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা কম ছিল। যখনই কারখানাগুলো খুলেছে তখনই আমাদের করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। আগামী দিনগুলোতে করোনাভাইরাসের পরিণতি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কি হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গার্মেন্টস শিল্প কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এতে প্রায় ৪৪ লাখ পোশাক শ্রমিক করোনাভাইরাস ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সাভারে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয় ১৪ এপ্রিল। পরবর্তী ১৬ দিনে আক্রান্ত হন আরও ১৭ জন। ২৯ এপ্রিলের পর বাড়তে থাকে সংক্রমণের হার। ১২ দিনে সংক্রমণ বেড়ে যায় সাড়ে চার গুণ। ১১ মে পর্যন্ত মোট শনাক্ত ৮২ জন। ৪৭ জনই পোশাক শ্রমিক। গাজীপুরে সোমবার পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫৯ জন। তবে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম। শনাক্ত হয়েছেন ১৫ জন। তবুও পোশাক কারখানাগুলো নিয়ে সতর্ক জেলার স্বাস্থ্য কর্মীরা। সাভার, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চলগুলো হয়ে উঠছে করোনা হটস্পট।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সিভিল সার্জনের মাধ্যমে গার্মেন্টসগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে। যাদের জ্বর, ঠা-া, কাশি আছে তাদের নমুনা আমরা সংগ্রহ করছি। আর কিছুদিন গেলেই আমরা বুঝতে পারব আমরা যা পাচ্ছি সেটাই আসল চিত্র নাকি আরও বাড়ার প্রবণতা আছে। তবে গার্মেন্টস শিল্প কারখানা চালুর পর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলেও সংক্রমণ বেড়ে গেছে। শ্রমিকদের মধ্যে যদি কেউ করোনা আক্রান্ত হন, তাহলে শুধু তাদের না, তাদের পরিবারের জন্যও বড় ঝুঁকি তৈরি হবে এবং তারা উপার্জন হারাবেন। এই ঝুঁকি তারা নিতে চাইছেন না। এজন্য তারা উপসর্গ গোপন করছেন। এর ফলে তাদের কেউ যদি করোনা সংক্রমিত হন, তাহলে অন্যদের মাঝে এটা ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিকেদের কিন্তু খুব কাছাকাছি থেকে কাজ করতে হয়। কারখানার ভিতরের বিষয়টা আমরা না দেখলেও কারখানার বাইরে তারা যেভাবে মিছিলের মতো করে যাচ্ছে তা কিন্তু খুবই বিপজ্জনক। মালিক বলা হয়েছে, তারা যেন আরও যথেষ্ট সতর্ক হয়ে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করেন। গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা তাদের মুনাফার জন্য শ্রমিকদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্বৃতি দিয়ে পুলিশ বলেছে, গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের মধ্যে করোনাভাইরাস প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগেই যেন ল্যাব স্থাপন, আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়।
এরই মধ্যে গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলে ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তৈরি করতে হবে নারীশ্রমিকদের জন্য আইসোলশন সেন্টারও। এসব এখনও অনুপস্থিত। যত দ্রুত সম্ভব করোনা ভাইরাস প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে গার্মেন্টস শিল্পে। নতুবা চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা খোলার এবং শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও শ্রমিকদের মধ্যে এখনও যথেষ্ট সচেতনতার অভাব রয়েছে। এর ফলে এরই মধ্যে পোশাককর্মীদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ রোধে উদ্যোক্তারা ও শিল্প পুলিশ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। তবে কারখানার শ্রমিকদের আরও বেশি সচেতন করতে কর্তৃপক্ষকে সচেতনতা কর্মসূচী বাড়াতে হবে। বিশেষ করে কারখানায় আসা-যাওয়ার সময়। এখন করোনার পিক সময়ে গার্মেন্টস এলাকাই হয়ে উঠছে করোনার হটস্পট। যেভাবে গার্মেন্টসগুলো চলছে তাতে গার্মেন্টসগুলো একেকটা করোনার স্ফুলিঙ্গের মতো হয়ে উঠেছে। এ জন্য কারখানার মালিকদেরই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: