ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্কা নিয়েই রাস্তায় মানুষ

জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয়ের জোর চেষ্টা

প্রকাশিত: ২২:২৯, ১৩ মে ২০২০

জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয়ের জোর চেষ্টা

মোরসালিন মিজান ॥ বুক ধুক ধুক করছে। বাসা থেকে বের হলেই বিপদ। কখন কীভাবে শরীরে ঢুকে পড়বে করোনা তার ঠিক নেই। তবুও লোকজন রাস্তায় নামছে। সুধীজনের অনেকে এই বের হওয়া দেখে বিরক্ত। তীব্র্র সমালোচনা করছেন। বলছেন, অহেতুক বের হচ্ছে এরা। সবার জন্য বিপদ ডেকে আনবে। আসলে অতো সরল নয় অঙ্কটা। কোভিড ১৯-এর কামড়ে ইতোমধ্যে অনেক কিছু তছনছ হয়ে গেছে। বহু মানুষ বর্তমানে কর্মহীন। একদিন কাজে না গেলে যাদের সংসার চলে না তাদের এত লম্বা সময় ঘরে বসে থাকার সুযোগ কোথায়? তাই বের হতে বাধ্য হচ্ছেন। একদিকে জীবন। অন্যদিকে জীবিকা। দুটোর মধ্যে সমন্বয় করার একটি চেষ্টা এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর বাইরে অনেক মানুষ প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত। তাদের পরিবার পরিজনকে ছুটতে হচ্ছে। জরুরী নানা কাজ দীর্ঘদিন ধরে জমানো ছিল। সেগুলো করতে হচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষের সংখ্যা তাই বাড়ছে। চেনা চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে রাজধানী ঢাকা। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। পরবর্তীতে ছুটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এখনও বহাল আছে সরকারী ছুটি। অঘোষিত লকডাউন আরও বেশ কিছুদিন চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ছুটি বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে করোনা ছাড়াও নতুন নতুন সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এ বাস্তবতায় অঘোষিত লকডাউন কিছুটা শিথিল করেছে সরকার। প্রথমে কিছু গার্মেন্টস খুলে দেয়া হয়। গত রবিবার থেকে খুলে দেয়া হয়েছে দোকানপাট। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে। আইইডিসিআর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৯৬৯ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে আরও ১১ জনের। এছাড়া সুস্থ হয়েছেন ২৪৫ জন। এ নিয়ে মোট মৃত্যু সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫০ জনে। আর শনাক্ত রোগী সংখ্যা হয়েছে ১৬ হাজার ৬৬০ জন। অর্থাৎ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে বৈ কমছে না। এর পরও জীবিকার প্রয়োজনে বের হচ্ছে মানুষ। প্রায় দেড় মাস বন্ধ থাকার পর ঢাকার বিপণীবিতান খুলতে শুরু করেছে। হকার্স মার্কেটের পাশের কিছু পোশাকের দোকান খুলতে দেখা গেছে। খোলা আছে এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকান। বসুন্ধরা সিটি শপিংমল বা যমুনা ফিউচার পার্কের মতো বৃহৎ মার্কেটগুলো বন্ধ থাকলেও, আড়ং বাটা, এ্যাপেক্সের মতো নামকরা কিছু ব্র্যান্ডের আউটলেট চালু হয়েছে। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ঘষে নিয়ে এসব আউটলেটে ক্রেতারা প্রবেশ করছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখারও চেষ্টা হচ্ছে ভেতরে। কোন কোন মার্কেটের প্রবেশ পথে জীবাণুনাশক গেট বসানো হয়েছে। থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবে কেনাকাটার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন মার্কেট কর্তৃপক্ষ। সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা থাকছে দোকানপাট। মঙ্গলবার হকার্স মার্কেটের পাশের একটি পোশাকের দোকানে কথা হচ্ছিল মুহিবুর রহমান নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকেই কাপড় দেখছিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাই। এখন করোনা সংক্রমণের ভয় আছে। তবুও জীবিকার প্রয়োজনে বের হয়েছি। আজ বাসায় ফেরার পথে মনে হলো, দুই বাচ্চার জন্য দুটো জামা নেয়া দরকার। ঠিক ঈদের জন্য নয়, গরম পড়তে শুরু করেছে, বাসায় পরার মতো সুতি জামা খুঁজতে দোকানে ঢুকলাম। এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানে ক্রেতা তেমন নেই শোয়েব নামের এক দোকানি বললেন, ‘কাস্টমার তো দোকান খুললে পরে আইব। আর না খুইল্যা কয়দিন থাকমু? পেটে তো ভাত নাই। সংসার চালানোর টেকা দিয়া দোকান ভাড়া দিছি। তা না হইলে মালিক উঠায়া নগদে আরেকজনের কাছে ভাড়া দিয়া দিব। অমার করোনার চিন্তা করলে চলব, কন?’ ঢাকার রাস্তাঘাটও ফাঁকা পড়ে নেই। প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি মাইক্রোবাস সিএনজি চালিত অটোরিক্সা লেগুনা ইত্যাদি চলছে। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় বাস চোখে পড়ছে না। বাদ বাকি সব ধরনের যানবাহন রাস্তায় আছে। মৃদু যানজটও দেখা যাচ্ছে কোন কোন স্থানে। তবে বেশিরভাগ রাস্তা সচল থাকায় দ্রুতই যে যার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারছেন। সাইন্সল্যাব মোড়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন সিএনজি অটোরিক্সা চালক মোঃ আল আমিন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে বউ বাচ্চা আছে। মা আছে। গত এক মাস তাদের কাছে কোন টেকা পয়সা পাঠাই নাই। মোবাইল করলে ধরিও নাই। কিন্তু হেরা যে কষ্ট করতাছে আমি বুঝি। এ কারণেই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন বলে জানান তিনি। ব্যস্ততা বেড়েছে ট্রাফিক পুলিশেরও। গত বেশকিছু দিন অল্প সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশকে ডিউটি করতে দেখা গেছে। মোটামুটি অলস সময় কাটাতে হয়েছে তাদের। এখন ফুল টাইম ডিউটি। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত ওঠানো নামানোর সেই ছবিটা দৃশ্যমান হচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে সংযোগকারী বিভিন্ন মহাসড়কের প্রবেশ পথেও এখন অনেক যানবাহন। আব্দুল্লাহপুর, গাবতলী যাত্রাবাড়ী এলাকা দিয়ে এসব যানবাহন রাজধানীতে ঢুকছে। সেইসঙ্গে প্রতিদিন ঢুকছে মানুষ। বিশেষ খুব একটা জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে না তাদের। গাবতলীতে কথা হচ্ছিল সুলতান নামের এক মাঝবয়সীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি বিজয়নগরের একটা হোটেলে চাকরি করি। মার্চের ২৭ তারিখ থাইকা সেইটা বন্ধ। কিছু টাকা নিয়া বাড়ি গেছিলাম। সব শেষ। কয়দিন বউয়েল জমাইন্যা টাকায় সংসার চলছে। আমি হোটেলের ম্যানেজাররে মোবাইল করছিলাম কিছু টেকা দেয়ার জন্য। উনি হোটেল না খুললে টাকা দেয়া সম্ভব না, কইয়া ফোন কাইট্যা দিলেন। কবে হোটেল খুলবে তাও কিছু কইলো না। কিন্তু আমরা তো চলতে হইবো।তাই আপাতত অন্য একটা কাজ খুঁজতে ঢাকায় ফিরে এসেছেন বলে জানান তিনি। এভাবে জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় কারার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অসচেতন উদাসীন মানুষেরও দেখা মিলছে রাস্তা ঘাটে। বাসায় আর ভাললাগে নাÑ এ যুক্তিতে তারা ঘর থেকে বের হয়ে আসছেন। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ বলছেন, মাস্ক পরে বের হয়েছি। পকেটে স্যানিটাইজার আছে। আমার কিছু হবে না। কেউ বলছেন, আল্লা মৃত্যু দিলে ঠেকানোর সাধ্য মানুষের নাই। তাই এ নিয়ে ভাবি না! এমন আরও অনেক কা-জ্ঞানহীন অকারণেই ভিড় বাড়িয়ে চলেছে। ঢাকার রাস্তা ঘাটে তাই লোকের অভাব নেই। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেই চেনা চেহারায় ফেরার চেষ্টা করছে ঢাকা। এ চেষ্টার ফল কী হবে? সময়ই বলতে পারে শুধু।
×