ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

থেমে নেই ধর্মান্ধরা

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১৩ মে ২০২০

থেমে নেই ধর্মান্ধরা

করোনা মহামারী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে মানুষ কত অসহায়। রাজা বাদশা কোটিপতি কেউই রেহাই পায়নি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ভাইরাসের থাবা থেকে। মানুষ যে, এত অসহায় তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন এমন সব মানুষ, যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। এমন পরিস্থিতিতে আশা করা গিয়েছিল যে, সব মানুষের মধ্যে হুশ ফিরবে। লোভলালসা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, ধর্মব্যবসা, অপরাধ, বিভিন্ন দুষ্ট রিপু থেকে গোটা মানব সম্প্রদায়সহ আমাদের দেশের মানুষও সরে দাঁড়াবে। এই প্রত্যাশা আংশিকভাবে ফলপ্রসূ হলেও অনেকের মধ্যেই সুস্থ চিন্তা এবং চেতনা জাগেনি। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাদের অন্যতম, যাদের মধ্যে চৈতন্য উদিত হয়নি আদৌ। এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনা উল্লিখিত হওয়ার দাবিদার। একটি হলো, স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের করোনা সংক্রমণ নিয়ে। তার বৃদ্ধ মাতা করোনায় আক্রান্ত হলে তিনি মাকে দূরে ঠেলে না দিয়ে তার সেবা এবং চিকিৎসার জন্য মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দ্বিধাহীন। এটা তিনি ভাল করেই জানতেন যে, নিজেও এতে সংক্রমিত হতে পারেন। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথম দিকে তার অবস্থা এতটাই আশঙ্কাজনক ছিল যে, তাকে আইসিইউতে পর্যন্ত নিতে হয়েছে। দিতে হয়েছে অক্সিজেন। তার মাতৃভক্তি স্মরণ করিয়ে দিল প-িত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির কথা। অসুস্থ মাকে দেখার জন্য যিনি উত্তাল দামোদর নদ সাঁতরিয়ে পার হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, পৃথিবীর সকল ধর্মেই মাতৃভক্তিকে শীর্ষ স্থান দেয়া হয়েছে। সেই অর্থে অধ্যাপক মামুন ঋষিতুল্য পুণ্যের কাজ করেছেন। কিন্তু তার অসুস্থতার খবর পেয়ে ধর্মান্ধ কিছু মানুষ বলতে কালক্ষেপণ করেনি যে, অধ্যাপক মামুনের ওপর সৃষ্টিকর্তার গজব নাজিল হয়েছে। তারা সামাজিক প্রচার মাধ্যমে এ ধরনের হীন প্রচারণা চালিয়ে তাদের নিজস্ব পাপাচার প্রমাণ করেছে। এমনকি তারা অধ্যাপক মামুনের মৃত্যু হয়েছে বলেও গুজব ছড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এ ধরনের অমানুষদের জন্যই জাতীয় কবি কাজী নজরুল বলেছিলেন, বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে আমরা তখনও বসে বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ওপর স্রষ্টার গজব পাঠানোর কোন কারণ নেই। এজন্য যে, তিনি একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, নীতিবান, অহিংস, অসাম্প্রদায়িক এবং মানবপ্রেমী মানুষ। একজন আদর্শ ব্যক্তির যেসব উপাদান থাকা প্রয়োজন, তার সবই অধ্যাপক মামুনের মধ্যে উপস্থিত। ১৯৭১-এ যেসব পাকিস্তানী হার্মাদ এবং তাদের বাঙালী দোসর বাংলাদেশে নরহত্যা, ধর্ষণসহ অপরাধ এবং পাপের রাজ্য বিস্তার করেছিল, অধ্যাপক মামুন তাদের মুখোশ উন্মোচন করে পরম পুণ্যের কাজ করেছেন। আর সেজন্যই এসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিষোদাগার। কেননা, তারা তো একাত্তরের সেই গণহত্যা, গণধর্ষণকারীদের অপআদর্শে লালিত। অধ্যাপক মামুনের অপরিসীম অবদান হলো এই যে, তিনি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন একাত্তরের নির্যাতিত মহিলাদের প্রকৃত সংখ্যা পাঁচ লাখের নিচে নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, অধ্যাপক মামুন সে আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। অপর ঘটনাটি বিদ্যানন্দ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে নিয়ে। সকল তথ্য উপাত্ত প্রমাণ করেছে যে, সংস্থাটি অবিশ্বাস্য সাফল্যের সঙ্গে মানব মঙ্গলে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকের বিশ্বাস, এটি একসময় ব্র্যাকের সমপর্যায়ে উপনীত হবে। এই সংস্থার ‘এক টাকার আহার’ প্রকল্প দিয়ে যেমনি আহারের সুযোগ পেয়েছেন লাখ লাখ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত মানবসন্তান বিশেষ করে ছিন্নমূল পথশিশু; তেমনি লাখ লাখ দরিদ্র রোগী চিকিৎসা এবং ওষুধ সুবিধা পেয়েছেন বিদ্যানন্দের পরিচালিত এক টাকার চিকিৎসা কার্যক্রমে। এই সংস্থা দুস্থ ছাত্রদের বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করে মানবতার সেবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অভূতপূর্ব। এই সংস্থার বিরুদ্ধে ধর্মান্ধরা অপপ্রচারে নেমেছে। কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ একজন অমুসলিম এবং সংস্থার নামটিও বাংলা নাম। এরা ভাল করেই জানে, বিদ্যানন্দ শব্দটি একটি শ্রুতিমধুর খাঁটি বাংলা শব্দ এবং সেখানেই ধর্মান্ধদের মাথাব্যথা। কেন বাংলা নাম হবে আর কেনই বা একজন অমুসলিম এ ধরনের একটি দাতব্য সংস্থার প্রধান হবেন! বাংলা শব্দের বিরুদ্ধে প্রথম খড়গ তুলেছিলেন জিয়াউর রহমান। জয় বাংলা শব্দ দুটি যেহেতু বাংলা ভাষায়, তাই জিয়ার এটি সহ্য হয়নি। তিনি অন্য সব বাংলা শব্দ যথাÑ বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ বেতার প্রভৃতির বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকে একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি এবং তাদের বংশধরেরা জিয়াকে গুরু মেনে বাংলা শব্দবিরোধী অভিযানে মেতে ওঠে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মানসে। এসব ধর্মান্ধদের পূর্বপুরুষরা রণদা প্রসাদ সাহার মতো অসাম্প্রদায়িক দানবীরকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। কারণ একটাই, তিনিও ছিলেন অমুসলিম। এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা যে ধর্মবিরোধী কাজ করছে, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামিন অর্থাৎ সকল মানুষের প্রভু। তিনি রাব্বুল মুসলিমিন নন অর্থাৎ শুধু মুসলমানদেরই প্রভু নন। অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করা সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার শামিল। কেননা, এক সৃষ্টিকর্তা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। যে বাণী মদিনা সনদেও প্রতিফলিত। মওলানা জালাল উদ্দিন রুমির মতো সুফী-সাধক থেকে শুরু করে এ কথা প্রতিফলিত হয়েছে লালন শাহের গানে, বন্দে শা’র কবিতায়, কালান্দর শাহের বাণীতে, শ্রী চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ জগৎখ্যাত কবি-দার্শনিকদের তত্ত্বে। জাতীয় কবি নজরুল এদের প্রতি ঘৃণা ভরে লিখেছিলেন, হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন জন। লালন শাহ লিখেছেন, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কি রং দেখলাম না এক নজরে। কবিগুরু বলেছেন, কোন বাক্তি হিন্দু না মুসলিম নয়, আমার বিচার্য সে মানুষ কি না। মানুষ না হলে সে হিন্দু না মুসলিম তাতে আমার কিছু আসে যায় না। বহু যুগ আগে কবি চ-িদাস লিখেছিলেন, শোন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ভারতের দার্শনিক এবং কবি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শংকর দয়াল শর্মা মুসলিম না হয়েও পবিত্র কোরআনের প্রশংসায় একটি সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন হিন্দী ভাষায় চার দশক পূর্বে। তার কবিতার বাংলা তরজমাকৃত দুটি লাইন উল্লেখ করার মতো, যার ভাবার্থÑ জ্ঞানের কিতাব মূর্খদের হাতে ছেড়ে দিয়েছ, হে মুসলমান এ কি করেছ! মওলানা রুমিও একইভাবে বলেছেন, কোরআন যদি মন দিয়ে পড়, সেখানে তুমি খুঁজে পাবে ভালবাসার বাণী। লেখক : আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
×