ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সারতাজ আলীম

করোনা পরবর্তী বিশ্বের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০০:২৬, ১০ মে ২০২০

করোনা পরবর্তী বিশ্বের অর্থনীতি

‘গতকাল সারা বিশ্বে কোন করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি’ একদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় এমন খবর প্রিন্ট হবেই। তবে সে জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কারও জানা নেই। তার আগে কত প্রাণ বলি দিতে হবে সেটাও কারও জানা নেই। করোনা মহামারী যেদিনই শেষ হোক না কেন আমাদের ভবিষ্যত জীবনযাত্রায় তার ছাপ রেখে যাবে। আর মানুষের জীবন এবং লাইফস্টাইলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনীতি। কেমন হবে কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বের অর্থনীতি? দীর্ঘ লকডাউন শেষ হওয়ার পর করোনা ধাক্কায় আক্রান্ত মালিক-শ্রমিকের প্রথম যে ভাবনা জাগবে তা হলো আমাদের কারখানাটি কি খুলতে যাচ্ছে? কারখানার মালিক তার ব্যবসার ক্ষেত্র আছে কিনা সেটা দ্রুত অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন। কারখানার শ্রমিক বা এরই মধ্যে আংশিক চলমান শিল্পের ছাঁটাইকৃতরা কাজ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবে। বাণিজ্যের প্রয়োজনে ভ্রমণ করা নিরাপদ হবে কিনা সে ভাবনাও মাথায় ঘুরপাক খাবে। সরকারের পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই। তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক একটা পালাবদল আসবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা ফরেনপলিসি কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বের অর্থনীতি কেমন হবে জানতে চেয়েছিল কয়েক অর্থনীতিবিদের কাছে। তারই কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। মানুষ আগে সমস্যা হলে অন্য রাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ভাবত কিন্তু এখন সব সীমান্ত বন্ধ। মেডিক্যাল সামগ্রী সংগ্রহে বেশ জোর দিয়েছে সবাই। আর এ জন্য মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত এমন খাতকে গুরুত্ব দিতে শুরু করবে রাষ্ট্রগুলো। উৎপাদন ব্যবস্থা যাতে আরও টেকসই হয় এবং বিপর্যয় সহনশীল হয়ে ওঠে তার জন্য প্রচুর ব্যয় করতে শুরু করবে সরকার। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে যতটা শিক্ষা নেয়া দরকার ছিল ততটা আমরা নেইনি। টেকসই মনে হলেও বড় প্রতিবন্ধকতায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়েছে। এবার খুঁটিনাটি সব ভাবতে হবে। বিশ্বায়ন এবং আত্ম-নির্ভরশীলতার মধ্যে সমন্বয় করা শিখতে হবে। মহামারীর পরে আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ব, সেটি হবে মোটামুটি দূরদর্শী, অধিকতর সহনক্ষমতাসম্পন্ন ও সংবেদনশীল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলেছেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রসমূহের মাঝে উন্মুক্ত সীমানার দুর্বলতা ভয়ানকভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ বিশ্বায়নের মূল্য এবং অর্জনকে নতুন করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। বৈশ্বিক নির্ভরতা সাপ্লাই চেনকে বড় ধরনের ধাক্কার মুখে ফেলেছে। এ জন্য রাষ্ট্রসমূহ উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈশ্বিক নির্ভরতা কমিয়ে আনতে চাইবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরেও অনেক নীতি-নির্ধারক আন্তঃদেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় ভরসা হারিয়ে ফেলছেন। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক মাঠ থেকে বিদায় নিতে হবে। গত ৫০ বছর ধরে চলা সমন্বিত প্রচেষ্টা বজায় থাকবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩০ সালের মন্দার পর পৃথিবী কখনও এত বড় অর্থনৈতিক দুর্যোগে পড়েনি। ২০০৮-৯ সালের মন্দা, ব্রেক্সিট বাণিজ্য যুদ্ধের মতো সমস্যায় পড়লেও ১৯৩০ সালের পর এই প্রথম উন্নত থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল সকল দেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেÑ বলছিলেন অর্থনীতিবিদ কার্মেন রেইনহার্ট। করোনা আমাদের ব্রেটন উডস (১৯৪৪ সালের নিউ হ্যাম্পশায়ারের এক সম্মেলনে বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য নিয়ম, আইন এবং পদ্ধতি পুনর্নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হয়। সেখান থেকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রতিষ্ঠা হয় এবং বিশ্বায়নের পথ উন্মুক্ত হয়) পূর্ববর্তী যুগে না নিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থায়ন ব্যবস্থার যথেষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করবে এ দুর্যোগ। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের প্রেসিডেন্ট এ্যাডাম পোসেন বলেছেন মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদ্যমান চারটি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ক্রমবর্ধমান স্থবিরতা, দরিদ্র দেশগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা, মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা অতিমাত্রায় বাড়বে, স্বনির্ভরতা অর্জন করতে যেয়ে অনেকে বিপদে পড়বে। তার ধারণা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যনীতির অধ্যাপক ঈশ্বর প্রসাদ বলেছেন ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের তৈরি নিয়ম ভাঙছে। ফেডারেল রিজার্ভ নিজেরা সম্পদ কিনছে এবং অন্য ব্যাংককে তারল্য ধরে রাখতে সাহায্য করছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা যা করা সম্ভব সবই করবে বলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ধীরে পদক্ষেপ নিতে অভ্যস্ত হলেও এখন তারা প্রচুর সৃজনশীলতা দেখাচ্ছে। আর এসব কিছু থেকে বলা যায় আগামী দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের সাবেক পরিচালক লরা টাইসনের শঙ্কা অনেকেই হারানো কাজ আর ফিরে পাবেন না এবং বেকার হয়ে পড়বেন। তবে সেবাদানকারী কাজের চাহিদা বাড়বে এবং এসব খাতে উপার্জনও বেশি হবে। নিশ্চিতভাবেই ই-কমার্সের প্রসার ঘটবে। শ্রমিকের বদলে যন্ত্রনির্ভর হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। সিঙ্গাপুরিয়ান কূটনৈতিক কিশোর মধুবনীর মতে করোনা ভাইরাস মহামারী অর্থনীতির পালাবদল দ্রুত ঘটাবে। বিশ্বের অর্থনীতি এবং বিশ্বায়ন এখন আমেরিকা নির্ভরতার বদলে চীন নির্ভর হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এ্যাডাম টুজের ভবিষ্যদ্বাণী ‘স্বাভাবিক অর্থনীতি আর কখনই ফিরবে না। ব্যবসা এড়িয়ে নিরাপদে বসে থাকা শুধু স্থবিরতাই বাড়াবে।’
×