ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের গানে মনের মুক্তি

প্রকাশিত: ০০:২৬, ৮ মে ২০২০

রবীন্দ্রনাথের গানে মনের মুক্তি

রবীন্দ্রনাথের গানের অনেক দিক রয়েছে তার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মন নিয়ে। তার গানে যেমন প্রকৃতি রয়েছে, আধ্যাত্মিক দর্শন রয়েছে, সুন্দরের প্রতি আকুতি রয়েছে, মানব মনের অনুভূতি প্রকাশ রয়েছে তেমনি রয়েছে মানব মন জাগ্রত করার সূক্ষ্ম, সচেতন আহ্বান। তিনি অনেক গানেই মনের মুক্তির কথা বলেছেন। মন বিকশিত আর মুক্ত না হলে পরিপূর্ণ মানসিক চিন্তার ধারক হওয়া যায় না। মন যদি অদৃশ্য শেকলে বন্দী থাকে তবে একটি ব্যক্তি হয়ে পড়ে অসম্পূর্ণ সত্তা। তার চিন্তা তাকে সঠিকভাবে চালিত করে না, সে হয়ে পড়ে স্থবির আর জড়। রবীন্দ্রনাথ তার একটি সুপরিচিত গানে প্রার্থনা করেন এই অন্তরের মুক্তির জন্য: ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে, মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।’ গানটিতে বদ্ধ মনের মুক্তির কথা এসেছে সরাসরি: ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ, সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।’ কবি মুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। আর মনের মুক্তি ছাড়া শারীরিক মুক্তি থাকলেও তা অসম্পূর্ণ মুক্তি। কবি তাই মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মনের সংকটময় অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পক্ষে: ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।’ পরক্ষণেই কবি ম্রিয়মাণ মনকে হতাশাগ্রস্ত থেকে কিংবা বাধাগ্রস্ত থেকে জাগ্রত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন: ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়/ দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো, /নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো /মুক্ত করো ভয়, নজের ‘পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।’ গানটি শেষ হয় কোমল মনের বিভ্রান্তি ছেড়ে ফেলে মনকে সংশয় মুক্ত করার প্রত্যয় জানিয়ে: ‘মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়’ কবি মনকে দিয়ে অসীম সত্তাকে অনুভব করতে চান। কবি ছিলেন একজন আইডিয়ালিস্ট বা ভাববাদী কবি তাই তার ধ্যানে, জ্ঞানে পরমাত্মার অন্বেষণ। কারণ পরমাত্মা ছোট আকারে ক্ষুদ্রাতায় বিরাজমান। সে আভাসটুকু দিয়ে যায় কিন্তু অজ্ঞেয় হয়ে থাকে: ‘আমার মনের কোণের বাইরে আমি জানলা খুলে ক্ষণে ক্ষণে চাই রে। কোন অনেক দূরে উদাস সুরে আভাস যে কার পাই রে- আছে-আছে নাই রে।’ কিন্তু সুরের মূর্ছনায় কবি সেই না পাওয়া বেদনা ভুলতে চান: ‘কার ছায়া আমায় ছুঁয়ে যে যায়, কাঁপে হৃদয় তাই রে- গুনগুনিয়ে গাই রে।’ অসীম শুধু হৃদয়কে অজানায় অবগুণ্ঠিত রাখে না এতে আসে বান মাঝে মাঝে যারা অনুভব করতে পারে তাদের জন্য: ‘পরানে পড়িয়াছে টান, ভরা নদীতে আসে বান, আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো, বাঁধ আর বাঁধিতে নারি’ কবি মন তবুও কী যেন কী না পাওয়ার নিরাশায় বিচলিত: ‘হৃদয় আপনি উদাস, মরমে কিসের হুতাশ জানি না কী বাসনা, কী বেদনা গো কেমনে আপনা নিবারি।’ তাই কবি হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা জনকে না পেয়ে স্বাভাবিকভাবে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়েন। মনের মাঝেই আমাদের সবকিছু লুকিয়ে আছে কিন্তু আমরা তা বাস্তবের অতি বাস্তবতায় নিমগ্ন হয়ে বুঝতে পারিনা। কবি কিন্তু তা বুঝতে পারেন: ‘আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায় তুমি ছিলে আমার কাছে, আমি তোমার কাছে যাই নি।’ কিংবা ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না’ এই গানটিতে। আর একখানে কবি আমাদের নুইয়ে পড়া মনকে জাগিয়ে তুলতে মধুর আহ্বান জানিয়েছেন। কবি মনের সংকটকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বলেছেন অসাধারণ ভাবে: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ আধুনিক মনোবিজ্ঞানের মতে মনকে নিজেই অটোসাজেশন দিয়ে আমরা আরও আত্মসচেতন করে তুলতে পারি; গানের এক অংশে রবীন্দ্রনাথ এ কথাটি বলে গেছেন। অসাধারণ কবির এটি একটি অসাধারণ উপলব্ধি। তিনি নিজের মন খুলে দিতে বলেছেন যারা মানসিকভাবে দুর্বল তাদের। যেমন সক্রেটিস বলেছেন নিজেকে চেনো বা জানো: ‘যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা, যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়Ñ তবে পরান খুলে ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে।’ কবি মন অসীম মনের সঙ্গে একাত্ম হতে চায় তবে অবশ্যই প্রকৃতির মাঝখান দিয়ে। কারণ এই নির্মল, নিষ্কলঙ্ক, অতুলনীয়-সুন্দর প্রকৃতি স্রষ্টার সৃষ্টি তাই কবি প্রকৃতির নিরাভরণ ভূমিতেই তার মনের উন্মেষ দেখেন: গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ/ আমার মন ভুলায় রে।ও যে আমায় কেড়ে নিয়ে যায়/ যায় সে কোন চুলায় রে আমার মন ভুলায় রে।’ কবি এই গানে অজানা জগতে প্রবেশ করান তার মাধ্যম একটি সাদামাটা পথ। এই পথ আর কিছুই নয় মনকে অসীম এর সঙ্গে যুক্ত করার পথ। কিন্তু সবাই অসীম রহস্যের সৃষ্টি বুঝে না। কারো কারো মন ডুবে থাকে অন্ধকারে কবি এ ব্যাপারেও পুরোপুরি সচেতন: ‘আমার মন, যখন জাগলি না রে ও তোর মনের মানুষ এল দ্বারে। তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ভাঙল রে ঘুম- ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে।’ তাই কবি মনের জানলা খুলে দেন এবং অজানাকে জানতে চান তার গানের মাধ্যমে: আমার মনের কোণের বাইরে/আমি জানলা খুলে ক্ষণে ক্ষণে চাইরে।’ কবি মন জানে সুদূরের সঙ্গে এক হতে না পারলে; সুদূরের আভাস না পেলে তার মনের জাগরণ ঘটবে না তাই তিনি অনিমেষ তার মনের খোঁজ করে বেড়ান যে মন তার নিজের কাছে অজানা। কবির আকুল না পাওয়ার বেদনা এই মন কে কেন্দ্র করে: ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার/ তাই জীবন গেল শান্তি পেলি না রে।’ কবির সমুদ্র সমান মনে না পাওয়ার আকুলতা অনেক বেশি কারণ অসীমকে না পেলে এই বিচিত্র মনের পূর্ণতা কখনো আসবে না। কবির তাই বেদনাঘন সুর মূর্ছনা: ‘অনেক দিনের অনেক কথা ব্যাকুলতা বাধা বেদন- ডোরে/ মনের মাঝে উঠেছে আজ ভোরে।’ হতাশা তাকে গ্রাস করে কিন্তু কবি কখনোই হতাশ হন না কারণ কবি হচ্ছেন অনেক বড় আশাবাদের কবি। তিনি আরেকটি গানে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চান অবারিত আলো দিয়ে তার মনের ভিতরে যে আরেক অবগুণ্ঠিত মন রয়েছে তা জাগিয়ে তুলতে চান: ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও। যে জন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও।’ কবি মন কখনো মেঘের সঙ্গী হয়ে দিগদিগন্ত ছড়িয়ে পড়ে অসীমের পানে কিছু একটার আশায়। তাই অনুরণন বাজে: ‘মনো মোর মেঘেরও সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তের পথে নিঃসীম অন্ধকারে।’ কিন্তু অসীমের খোঁজ কবি নিজের মনের মাঝে পেয়ে যান কারণ অসীম, সসীম এর মাঝেই বিরাজ করে: ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে মনে আমার মনে/সে আছে বলে/ আমার আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে/ প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে আমার বনে।’ কিংবা সুপরিচিত এক গানে: ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে!/ মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা, মনে মনে।/তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার,/পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ্-কথার/পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা মনে মনে। কবি বলেছেন স্রষ্টার আভাস না পেলে এ জীবন অপূর্ণ রয়ে যায় তাই কবি অপূর্ণ জীবন পূর্ণ করতে চান তার গানের ধারায় বয়ে গিয়ে স্রষ্টাকে খুঁজে: ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে/ তুমি জাননা আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে।’ কবি মন ধীরে ধীরে আলোকের রেখা দেখতে পান আঁধারের মাঝে। এ যেন অজানার মাঝে জানার কিঞ্চিৎ আনন্দ লাভ: ‘আলো যে যায় রে দেখা/হৃদয়ের পুব গগনে সোনার রেখা/ এবারে ঘুচল কি ভয়, এবারে হবে কি জয়? আকাশে হলো কি ক্ষয় কালির লেখা?’ কবি মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে যায় যখন তিনি স্রষ্টার আলোক ধারার মাঝে আনন্দের স্ফূরণ দেখেন। আলো প্রতিদিন আমাদের জীবনে নতুন আনন্দের উৎস হয়ে আসে। সেখান থেকেই কবি মানসিক শক্তি লাভ করেন। তিনি বলেন ‘আমার পরান বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃত গান।’ কবির ধ্যানি মন দূর থেকে প্রাণের মাঝে অন্য বারতা পায়: ‘একি গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধরে/ সকল আকাশ আকুল করে/ সেই বাণীর পরশ লাগে/ নবীন প্রাণের বাণী জাগে/ হঠাৎ দিকে দিগন্তরে ধরার হৃদয় উঠে ভরে।’ কবি অসীমের সুন্দর রুপের মাঝে নিজের পুলকিত মনকে ধন্য হতে দেখেন: ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর/ পূণ্য হলো অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর। আমাদের মন সব সময় আপন চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে কবি তাই তার গানের মাঝে আমাদের নিজের সেই শৃঙ্খলিত চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে বলেন: ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’ কবি তার মনের মুক্তি খুঁজেন প্রাচুর্যপূর্ণ প্রকৃতিতে: ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে/আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে/দেহমনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে/ আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে/ দুঃখ-বিপদ সহ্য করা কঠিন কাজে/ বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা, আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা/ জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি আশে।’ ঔ একটি বিশেষ গানে রবীন্দ্রনাথের স্রষ্টার কাছে বিশেষ আবেদন থাকে মনকে আরো পরিপূর্ণ করে দেবার জন্য: ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।’ শুধু মন নয় কবি চান তার চেতনার উদ্ভাস ঘটুক আরো বিকশিত হয়ে: ‘প্রভু আরো দাও মোরে আরো চেতনা দ্বার ছুটায়ে বাঁধা টুটায়ে মোরে কর ত্রাণ মোরে কর ত্রাণ।’ মানসিক ত্রাণ বা মুক্তি যেটি আমাদের মনকে সবধরনের মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করতে পারে কবি সেখান থেকে পরিত্রাণ চান। অবিরল সুমধুর প্রেম এসে মনের ক্ষুদ্রতাকে ধুয়ে নিয়ে যাক কবির এই প্রার্থনা চমৎকারভাবে এই গানটিতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকে: ‘আরো প্রেমে আরো প্রেমে মোর আমি ডুবে যাক নেমে সুধা ধারে আপনারে তুমি আরো আরো আরো কর দান মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।’ অবচেতন মন নিয়ে এই বিংশ শতাব্দীতে কথা হচ্ছে। মনের সচেতন অংশকে দিয়ে অবচেতন মনকে জাগ্রত করে আমরা নিজেকে হতাশা, গ্লানি থেকে মুক্ত করে নতুন জীবন লাভ করতে পারি; এই কথাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। সচেতন মন দিয়ে অবচেতন মনকে জাগ্রত করার উল্লেখ করার মতো প্রয়াস রয়েছে এই গানটিতে। মনের দ্বিতীয় অংশকে বা অবচেতন মনকে কবি প্রিয়তম উপমা দিয়ে উল্লেখ করেছেন: ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-’পরে- প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো। রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দাঁড়ায়ে আমি আর কতকাল এমনে কাটিবে স্বামী- প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।’ হৃদয়ের আঁধার থেকে তাই উঠে আসবার গভীর প্রচেষ্টা প্রতীয়মান হয় গানটিতে অপূর্ব প্রতীক আশ্রয়ে: ‘রজনীর তারা উঠেছে গগন ছেয়ে, আছে সবে মোর বাতায়ন-পানে চেয়ে— প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।’ মনের দুই অংশে বিভক্ত হয়ে গেলে মনে নেমে আসে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর হতাশা তাই কবি যেন মনের দুই অংশের সমন্বয়ে চান। রূপক এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ উপলব্ধি: ‘মিলাব নয়ন তব নয়নের সাথে, মিলাব এ হাত তব দক্ষিণ হাতে— প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।’ প্রকৃতির উদার নিঃস্বার্থ প্রাচুর্যের মাঝখানে কবি মন এমনিতেই আবেশিত হয়ে যায়। তার ভাবনালোক ভরে ওঠে। প্রকৃতিকে যদি আমরা অক্ষত রাখতে পারি তাহলে আমাদের মন এই প্রকৃতিই সতেজ করে দেবে। কবির ভাবনা আলোড়িত হয়ে যায়। সিক্ত হয়ে যায় প্রকৃতির পরশে: ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো, দোলে মন দোলে অকারণ হরষে। হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে রসের ধারা বরষে।’ কবির সেই ভাবনা প্রকৃতির সুগন্ধে, বর্ণে রঙ্গে অবগাহন করে তার একটি অতি পরিচিত গানে ‘আজ সবার রঙে রং মিশাতে হবে।’ কবি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতির সাবলীল রং অনন্যসাধারণ করে তোলেন; তার মনে উৎসবের আমেজ: ‘আজ সবার রঙে রং মিশাতে হবে। ওগো আমার প্রিয়, তোমার রঙিন উত্তরীয় পরো পরো পরো তবে’ প্রকৃতির মুখর সৃষ্টিশীলতায় রবীন্দ্রনাথ প্রফুল্ল মনে নিজেকে বিলিয়ে দেন। তার ভঙ্গুর হৃদয় সবল হয়ে ওঠে: ‘যখন তারি হাওয়া লাগে তখন রঙের মাতন জাগে কাঁচা সবুজ ধানের ক্ষেতে। সেই রাতের-স্বপন- ভাঙা আমার হৃদয় হোক-না রাঙা তোমার রঙেরই গৌরবে’ আকাশ, সূর্য, তারা আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এই পৃথিবীতে এমনিতেই মন জেগে ওঠে; রবীন্দ্রনাথ তাই অপূর্ব ছন্দে শিহরিত হয়ে ওঠেন: ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’ বিস্ময়কর এই পৃথিবী অনন্য দান সৃষ্টিকর্তার। রবীন্দ্র প্রাণ তাই উদ্বেলিত হয়ে ওঠে সৃষ্টির মোহনীয় সুর মূর্ছনায়: ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, এ আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। যত সব মরা গাছের ডালে ডালে নাচে আগুন তালে তালে রে, আকাশে হাত তোলে সে কার পানে।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ শুধু শুধু বিশ্বকে ধারণ করতে চাননি; মহাবিশ্বের, মহাকাশের এবং মহাকালের সমস্ত শক্তিকে তিনি প্রার্থনা করেছেন যেন তা জীবনকে পরিপূর্ণ করে দেয়। ভয়হীন পরিম-লে আমাদের বিচরণ না হলে মানসিক মুক্তি আসবে না। কবি নিজেই বলেছেন ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ মন ভয় শূন্য হলেই আমরা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারব। তার গানের বহুমুখী ব্যঞ্জনার মাঝে মনকে পরিশুদ্ধ ও পূর্ণরূপে আলোকিত করার প্রয়াস নিবিড়ভাবে আছে তাই তিনি জীবন যখন শুকায়ে যায় সবাইকে সৃষ্টিকর্তার অপার করুণা লাভ করতে সীমাহীন সৃষ্টি ভা-ারে দীনহীন মনকে অবারিত করতে বলেন অবিচল ভাবে: ‘কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন, দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ, রাজ-সমারোহে এসো। বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায় ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।’
×