ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

শতবর্ষে সত্যজি‍ৎ রায়

প্রকাশিত: ০১:০৩, ৭ মে ২০২০

শতবর্ষে সত্যজি‍ৎ রায়

গত ২ মে ছিল চলচ্চিত্র শিল্পের রাজপুত্র সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মদিন। তার এবারের জন্মবার্ষিকী ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু মানবকুলের শত্রু করোনাভাইরাসের প্রভাবে সব মাটি হয়ে গেল! তবে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন, সামনের বছর তারা জাঁকজমকভাবে এই উৎসব পালন করবেন। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ বলে কথা! বাংলা ভাষা এবং প্রায় সমান সংস্কৃতির ধারক হওয়ায় এই উৎসব আমাদেরও নিশ্চয়ই আলোড়িত করবে। বিশ^ দরবারে ‘বাংলা সাহিত্য’কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন করে মহিমান্বিত করেছেন, তেমন করে বাংলা চলচ্চিত্রকে সত্যজিৎ রায় পূর্ণতা দিয়েছেন। এখানে এই দুই মহাত্মার শিল্পক্ষেত্র ভিন্ন হলেও শেকড় কিন্তু এক। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যে বলেই ফেলেন, সত্যজিৎ রায় শেষ মহাপুরুষ। বাংলা শিল্প-সাহিত্যের দুনিয়ায়। সিনেমা নির্মাণ করে সত্যজিৎ আজ বিশ^ব্যাপী উঁচু আসনে অধিষ্ঠান এবং আগামীতেও থাকবেন। চলচ্চিত্রের ভাষা, পরিধি কিংবা ধারণা বদল হলেও তার গুরুত্ব কখন-কিঞ্চিত ম্লান হবে না। খেদ চলচ্চিত্র বোদ্ধারা তাই মনে করেন। তার চলচ্চিত্র মানে আবহমান সময়ের প্রতিনিধি। অথচ এই মানুষটার চলচ্চিত্রকার হওয়ার প্রাথমিক দিকে দৃষ্টি দিলে এক অন্য ঘরানার মানুষের সন্দান মেলে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির ছাত্র। যার ইচ্ছা ছিল ইংরেজী সাহিত্যে পড়ার, কিন্তু পড়তে হয়েছে অর্থশাস্ত্র। এর পর রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনে তার দিন কেটেছে সেখানকার লাইব্রেরির সব মূল্যবান পুস্তক পাঠ করে। বিশ^সাহিত্য এবং বিশ^ চলচ্চিত্র পাঠ সত্যজিৎকে গভীর অধ্যাবসায় করে তোলে। বিশেষ করে, সে সময়ের বিশ^ চলচ্চিত্রের সেরা সেরা মনীষীর লেখা বই কিংবা চলচ্চিত্র বিষয়ক অধ্যয়ন তাকে নিবিড়ভাবে পেয়ে বসে। একই সঙ্গে তার অন্তরীক্ষে সেলুলয়েডের ফিতা ঘুরতে থাকে। প্রায় দু’শ’ বছরের দুঃসাশনের পর ‘ভারত’ রাষ্ট্রের জন্ম হলে অনেক কিছুর সঙ্গে চলচ্চিত্রও হয়ে ওঠে ভারতীয়দের কাছে একটা অবলম্বন। একটু বলে রাখা ভাল সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হয়েছিল। এরপর ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারের সঙ্গে সাক্ষাত হলে, তার সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন। পরে লন্ডন শহরে অবস্থানকালে ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্র ‘বাইসাইকেল চোর’ দেখার পর ভীষণভাবে মুগ্ধ হন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত স্থির করনে। স্বাধীনতার ৮ বছর পর ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’। বলা দরকার তার প্রথম সিনেমা ভারতবর্ষে খুব একটা সমাদৃত না হলেও বিশ^ দরবারে ভীষণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, সে সময়ের কথাসাহিত্যিক কমল কুমার মজুমদার তো সরাসরি বলেছেন, তার এই সিনেমা (পথের পাঁচালী ) ভাল লাগেনি। মূলত বহির্বিশ^ বা পশ্চিমা বিশ^ যাই বলি না কেন, সেখানকার চলচ্চিত্র বদ্ধা এবং দর্শকরা ‘মিস্টার রয়’কে প্রথম আবিষ্কার করেন। সে সময়ে ভারতীয়দের চলচ্চিত্র নিয়ে উপলব্ধি বোধ ততটা পক্ত হয়নি। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বর্তমান সময়ের নামকরা চিত্রনির্মাতা সুজিত সরকার তার একটা স্মৃতিকথায় তিনি বলেছিলেন, ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে গিয়েছিলাম। মিনিট কুড়ি পর হওয়ার আগেই আমি হারিয়ে গিয়েছিলেন ঘুমের রাজ্যে। বড় হয়ে দেশের বাইরে এক চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে আবার যখন ছবিটি দেখার সুযোগ হয়, তখন ‘পথের পাঁচালী’ শেষ হওয়ার পর আসন ছেড়ে উঠতে পারেনি। সেখানেই বসে পর পর কয়েক বার দেখেছি। উৎসব বলে এমনটা সম্ভব ছিল। মূলত এই উদাহরণটা দেয়ার কারণ হলো যখন, ভারতীয়রা সত্যজিতের চলচ্চিত্র বুঝতে শুরু করল তখন আর তার চলচ্চিত্র ছেড়ে উঠতে পারেনি। কথাসাহিত্য এবং চলচ্চিত্র এক না হলেও তিনি এই দুটোর সমন্বয়ে একটি নান্দনিক অধ্যায় তৈরি করেছেন। যা তার আগে খুব কমজনই সফল এবং সার্থক হয়েছেন। কখন কখন মূল সাহিত্যের থেকে তার চিত্রনাট্যের আলো অনেক দূর অবধি ছড়িয়েছে! তার একের পর এক নির্মিত চলচ্চিত্র আজ বিশ^ চলচ্চিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাকে বলা হয় চলচ্চিত্র শিল্পের রাজপুত্র। ১৯২১ সালে কলকতার বিখ্যাত রায় পরিবারে তার জন্ম। যার জন্ম না হলে বাংলা চলচ্চিত্র হয়ত বিশ^ দরবারে কোন পরিচিতি পেত না। বাংলাদেশর চলচ্চিত্র শিল্পে তার অবদান ছিল পথ প্রদর্শকের মতো। বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করলে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের মানদ- আমাদের সামনে চলে আসে। যদিও সে সময় অনেকে এ কথা স্বীকার না করলেও কার্যক্ষেত্রে তা প্রমাণিত হয়েছে বহুলাংশে। বাংলাদেশ নিয়ে তার মধ্যে একটা ইতিবাচক ধারণা সব সময়ই ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকায় এসেছিলেন, জরুরী কাজ ফেলে এবং বলেছিলেন আবার আসবেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে না আসলেও কখন এই বাংলা মায়ের থেকে মুখ ফিরাননি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শ্রীবৃদ্ধি সব সময় চেয়েছেন। কিন্তু আমরা কি তার চাওয়া পূরণ করতে পরেছি?
×