ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

ঘোষণা দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি কাঁপিয়েছিলেন ‘দ্য ওয়াল’

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ৬ মে ২০২০

ঘোষণা দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি কাঁপিয়েছিলেন ‘দ্য ওয়াল’

চ্যালেঞ্জ, হুঙ্কার শব্দগুলোর সঙ্গে কেমন যেন ঔদ্ধত্যের গন্ধ মেশানো থাকে! ক্রিকেটে ভদ্রলোকের প্রতিমূর্ত রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে যা কখনোই যায় না। ‘দ্য ওয়াল’ রাহুল সেটা করেনওনি। ¯্রফে মনের জোরে শত্রুদেশ পাকিস্তানে দাঁড়িয়েও সেদিন বলেছিলেন, ‘দেখ বড় ইনিংস আসছে...। ’ সেটা যে এভাবে সত্য হয়ে যাবে তা হয়ত ভাবেননি। যেখানে সফরে প্রথম দুই টেস্টে নামের পাশে ৬, ৩৩ ও ০। ঘোষণা নয়, যেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটি বাস্তবায়নে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। রাওয়ালপিন্ডিতে শোয়েব আকতার, মোহাম্মদ শামিদের কাঁদিয়ে রাহুল হাঁকিয়েছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি, খেলেন ক্যারিয়ারসেরা ২৭০ রানের ইনিংস। যার ওপর ভর করে কেবল ম্যাচই নয়, পাকিস্তানের মাটিতে ২-১এ সিরিজ জিতেছিল সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারত। ২০০৪, অবিস্মরণীয় সেই স্মৃতি বর্ণনায় ১৬ বছর পেছনে ফিরে গেলেন রাহুল। ‘আমার মনে আছে প্রথম দিন শেষে ১৫ বা এমন কাছাকাছি রানে (আসলে ১০) অপরাজিত ছিলাম। রাতে ডিনার করতে নিচে গিয়ে খাওয়া শেষ করে বসে ছিলাম। কিছু সাংবাদিকও তখন উপস্থিত ছিলেন। তখন আমার নিজের ব্যাটিং নিয়ে খুব সন্তুষ্টি কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, এই ১৫ রানের (১০*) জন্য আমি দারুণ ব্যাটিং করেছি! আমি পুরো সিরিজেই ভাল খেলছিলাম কিন্তু ইনিংস বড় হচ্ছিল না।’ স্মৃতিচারণে বলছিলেন দ্য ওয়াল রাহুল। দলের ব্যাটিং স্তম্ভ হয়েও আগের দুই ম্যাচে অমন ব্যর্থতায় নিশ্চয়ই চাপ ছিল। ভদ্রলোক কিন্তু জবাবে বিশ্বাসী নন, ¯্রফে মনের জোর থেকে বলেছিলেন, ‘আমাকে আউট করতে হলে তোমাদের বোলাররা যেন সেটা প্রথম ঘণ্টাতেই করেন!’ কারণ আগের দিন ওই ১০ রানে অপরাজিত থাকার পথেই তিনি বুঝেছিলেন, বড় ইনিংস আসছে। সেটা যে ক্যারিয়ারসেরা হয়ে যাবে তা হয়ত ভাবেননি। পাকিস্তানকে ২২৪ ও ২৪৫Ñ এ গুঁড়িয়ে দিয়ে বল হাতে প্রাথমিক সিঁড়িটা তৈরি করে দিয়েছিলেন লক্ষিপতি বালাজি ও অনিল কুম্বলে। প্রথম ও একমাত্র ইনিংসে ঠিক ৬০০ রানের পাহাড়গড়ে ইনিংস ও ১৩১ রানের জয়ে বাকি গল্পটা রাহুল দ্রাবিড়ের। রাওয়ালপিন্ডিতে আগে ব্যাট করে বালাজির বোলিং তোপে ২২৪ রানে অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। এ পেসার নেন ৪ উইকেট। ফলে প্রথম দিনই ব্যাটিংয়ে নামতে হয় ভারতকে। পাল্টা জবাবটা বেশ ভালই দেন শোয়েব আখতার। রানের খাতা খোলার আগেই ফিরিয়ে দেন সিরিজজুড়ে দুর্দান্ত খেলতে থাকা বিরেন্দর শেবাগকে। তবে দ্বিতীয় উইকেটে পার্থিব প্যাটেলকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান ‘দ্য ওয়াল’ রাহুল। সেই দিন করেন দলীয় ২৩ রানে, পরে দ্বিতীয় দিনে গড়েন ১২৯ রানের জুটি। ইমরান ফারহাতের বলে বোল্ড হওয়ার আগে ৪৯৫ বলে খেলেন ২৭০ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। ৭৪০ মিনিট স্থায়ী ইনিংসটা কতটা ধৈর্য আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গড়া ৩৪ চারের বিপরীতে একটি মাত্র ছক্কাই তার প্রমাণ। ১৯৯৬ থেকে ২০১২Ñ দেড় যুগের টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৬৪ ম্যাচের ২৮৬ ইনিংসে ৫২.৩১ গড়ে রাহুলের মোট রান ১৩,২৮৮। আরও চারটি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন, কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতমসেরা এই ব্যাটসম্যান সেটিকে ট্রিপলে নিয়ে যেতে পারেননি! ক্রিকেটে ভাগ্যবিধাতার খেলা বোঝা সত্যি দায়। যেমন বোঝা যায়নি ভারতীয়দের ব্যাটিংঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকরের (বেস্ট ২৪৮*) ট্রিপল সেঞ্চুরি না পাওয়ার বিষয়টিও! রাহুল ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন ধ্রুপদী ব্যাটসম্যান। কোচিং ম্যানুয়ালে একেকটা শট যেভাবে খেলতে বলা আছে, ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের একনিষ্ঠ অনুসারী ঠিক সেভাবেই খেলেছেন। তাঁর ছিল রক সলিড টেম্পারমেন্ট, জমাট ডিফেন্স, গভীর মনোসংযোগ আর ইস্পাতদৃঢ় মানসিকতা। যে কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে উইকেটে কাটিয়ে দিতে পারতেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে। ক্রিজে একবার সেট হয়ে গেলে তাঁকে আউট করাটা ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য। যেমন সংযম প্রদর্শন করতেন, তাঁকে আউট করতে গিয়ে বোলারদেরও ঠিক তেমনি ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হতো। ব্যক্তিজীবনেও রাহুল এক নিপাট ভদ্রলোক, এতটুকো অহঙ্কার নেই, অভিযোগ নেই। ন্যায়পরায়ণতার অনন্য দৃষ্টান্ত। অনিল কুম্বলে-রবি শাস্ত্রীদের নিয়ে টালমাটাল সেই সময়ে তাঁকে জাতীয় দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি সেটি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছিলেন, এত বড় প্লাটফর্মে আসার আগে তিনি কোচিংটা ভাল করে শিখতে চান। ঠিক সেটাই করে যাচ্ছেন, ভারত অনুর্ধ-১৯ দলের প্রধাণ কোচ হিসেবে দেশকে উপহার দিয়েছেন ২০১৮ বিশ্বকাপের শিরোপা। এরপর জাতীয় একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখনও নিজেকে পরিপক্ব করে তুলছেন। এই হলেন একজন রাহুল দ্রাবিড়। অসম্ভব দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অনুকরণীয়, অনুস্মরণীয়।
×