ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফুটবল আর স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বনাথ

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ৬ মে ২০২০

ফুটবল আর স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বনাথ

রুমেল খান বিধির বিধান অনুসরণ/ আধ্যাত্মিক দর্শন/দুটি সত্তার আকর্ষণ/ মনের সংমিশ্রণ/হৃদয়ে স্পন্দন/দৃষ্টি নন্দন/পবিত্র বন্ধন/আবর্তন/দাম্পত্য জীবন ... বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ও ক্লাব দল বসুন্ধরা কিংসের কৃতী ফুটবলার বিশ^নাথ ঘোষের দাম্পত্য জীবনের কাহিনী পাঠকদের শোনাব আজ। বান্ধবী, প্রেমিকা থেকে কিভাবে জীবনসঙ্গিনী করলেন স্ত্রীকে থাকছে পেছনের সেসব গল্পও। সংসার-জীবন কেমন কাটছে? ‘আনন্দেই। আমাদের মাঝে কোন ঝগড়া এখনও হয়নি। টুকটাক ঝগড়াও নয়! স্বামী হিসেবে আমাকে অনেক কেয়ার করে ও। তবে খেলোয়াড় হওয়ায় আমাকে কম সময় দিত, এটা আক্ষেপ ছিল। তাই মন খারাপ হতো। তবে এখন করোনার কারণে ওকে বেশি কাছে পাচ্ছি। এজন্য খুশি।’ বিশ^নাথের স্ত্রীর হাসিমাখা জবাব। জানান তিনটি অজানা তথ্যও, ‘আমার পরামর্শেই ও বসুন্ধরা কিংসে যোগ দেয়। বিয়ের আগে থেকেই ও ফুটবল নিয়ে ঘুমাতো। এখনও ঘুমায়। ঘুমিয়ে গেলে যদি ফুটবল সরিয়ে রাখি, তাহলে জেগে ওঠে আবারও খাটের নিচ থেকে উদ্ধার করে। তবে আমি যেন ফুটবলকে সতীন মনে না করি, সেজন্য ও খাটে ঘুমানোর সময় ফুটবলটাকে রাখে বা পাশে, আর আমাকে রাখে ডান পাশে! আরেকটা হলো বিশু খুব ভাল নুডলস রাঁধে ও মুড়ি মাখাতে পারে। এমনিতে বাকি সব আমিই রাঁধি। খেয়ে ও প্রশংসাই করে। কিন্তু ভয়ে করে কিনা, তা বলতে পারব না!’ ‘ইয়ে’ করে বিয়ে, মানে প্রেম করে বিয়ে। স্ত্রী চৈতী সরকারের সঙ্গে বিশ^নাথের পরিচয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। তখন সিলেট বিকেএসপিতে ছিলেন (পরে বাফুফে এটি অর্থাভাবে আর চালাতে পারেনি) ছয় মাস, অ-১৭ দলের ক্যাম্পে। নারায়ণগঞ্জের সৈকত হোসেন তখন সেখানে অ-১৪ দলের ক্যাম্পে ছিলেন, যাকে ছোট ভাইয়ের মতো ¯েœহ করতেন বিশ^নাথ। সৈকতের ফোনে তখন চৈতীর ছবি দেখেন বিশ^নাথ। সৈকত আর চৈতী উভয়েই ছিলেন একই বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাদের দুজনের পরিচয় পরীক্ষার হলে। সৈকতের কোন বোন নেই। অচিরেই চৈতীর ‘ভাই’ বনে যান তিনি। পারিবারিকভাবেও চৈতীর পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয়ে যায় তার। চৈতীর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চনে। মোবাইলে চৈতীর ছবি দেখে প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়ে যান বিশ^নাথ। সৈকতকে জিগ্যেষ করেন, ‘মেয়েটির সঙ্গে রিলেশন করা যাবে?’ বিশ^নাথকে ভাল ছেলে বলেই জানেন সৈকত। তাই আপত্তির কারণ খুঁজে পাননি। তার মাধ্যমে জীবনের প্রথম প্রেমের পথে পা বাড়ান বিশ^নাথ। এক সপ্তাহ পর চৈতীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন বিশ^নাথ। যদিও ফোনালাপ মাসখানেক পর। এতদিন লাগার কারণ? ‘প্রথমে বিশ^কে পাত্তা দেইনি। এজন্য একমাস ওকে ঘুরাই!’ চৈতীর ব্যাখ্যা। বিশ^নাথকে প্রথম টিভিতে দেখেন চৈতী। প্রথম দেখার অনুভূতি কেমন ছিল? ‘টিভিতে ওকে খেলতে দেখি। বলেছিলাম দুনিয়ার একটা কালা বিশ^! হি হি হি!’ অবশ্য পরে যখন কথা বলেন, তখন বিশ^নাথের ইতিবাচক মন-মানসিকতা দেখে তার প্রতি দুর্বল-আকৃষ্ট হয়ে পড়েন চৈতী। তার পরিবার আগে থেকেই ক্রীড়ানুরাগী বলে বিশ^নাথের সঙ্গে চৈতীর সম্পর্কটা মেনে নেয়। চৈতীর সঙ্গে বিশ^নাথ প্রথম দেখা করেন (স্থান: ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসিতে, বিশ^নাথকে ‘সাহস জোগাতে সঙ্গী ছিলেন পুলিসে ফুটবল খেলা সাইফুল) প্রায় দেড় বছর পর, ২০১৬ এর শেষদিকে। তখনও চৈতীকে ‘আপনি’ করে বলতেন বিশ^নাথ! দেখা হওয়ার দু’দিন পর সম্বোধনের আপগ্রেড (মধুর ‘তুমি সম্বোধন) ঘটে বিশ^নাথের তরফ থেকেই। ‘তুমি’তে নামার পর থেকেই (বিয়ের পর আদর করে স্ত্রীকে ‘বাবুলি’ বলে ডাকেন) আমার আত্মবিশ^াস অনেকটাই বেড়ে যায়’Ñ ফোনে যেন কিছুটা লাজুক শোনালো ২০ বছর বয়সী বিশ^নাথের কণ্ঠ! যাকে ভালবাসবেন, তাকেই জীবনসঙ্গী করবেনÑ এমনটাই ছিল বিশ^নাথের মনোবাসনা। মনের ইচ্ছে বাস্তবে রূপ দিতে তৎপর হন। প্রথমে নিজের মাকে চৈতীর কথা জানান। মা সানন্দেই মেনে নেন। এবার পালা মনের মানুষের পরিবারের মন জয় করা। ধীরে ধীরে তাদের সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন বিশ^নাথ। পাঁচ মাস পর। উপযুক্ত সময় হয়েছে বুঝতে পেরে আর দেরি না করলেন না বিশ^নাথ। বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন চৈতীদের পরিবারের কাছে। না, জাতীয় দলের ফুটবলারকে জামাই হিসেবে মেনে নিতে কোন আপত্তি করেননি তারা। কাজেই বিয়ের সানাই বাজলো ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি। ওই সময় বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলের খেলা নিয়ে বিশ^নাথ ব্যস্ত। বাংলাদেশ সেমিতে লড়বে বুরুন্ডির বিপক্ষে। ম্যাচের আগের রাতে পরিণয়পর্ব সেরে ফেলেন বিশ^নাথ। কোচ জেমির কাছ থেকে ‘মাত্র তিন ঘণ্টার ছুটি’ নিয়ে পুরনো ঢাকার ঢাকেশ^রী মন্দিরে অনুষ্ঠানস্থলে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন টিমমেট তপু বর্মণ এবং সোহেল রানাকে। সেদিন বিয়ে করলেও বাসর রাত করা হয়নি বিশ^নাথ-চৈতীর। কেননা বিয়ে করেই বিশ^নাথকে ফিরতে হয়েছে টিম হোটেলে! কারণ পরদিন সেমির ম্যাচ। বউকে পাঠিয়ে দেন নিজেদের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটে। ‘বিয়েটা হুট করেই হয়। অনুষ্ঠানও হয় সংক্ষিপ্ত সময়ে। বাসর রাত হবে না, এটা মেনে নিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছি। কারণ জানি, সবার আগে দেশ। আর বিশ^নাথ তো দেশের জন্যই ফুটবল খেলে। বাসর রাত হয়নি বলে কোন দুঃখ নেই। তাছাড়া আমি খুবই বাস্তববাদী।’ বাসর হয়নি দেশের খেলার জন্য। আর এই দম্পত্তির হানিমুনও হয়নি এখনও। সেটা ক্লাবের খেলার জন্য। বিশ^নাথ বলেন, ‘এখন করোনার কারণে বাসাতেই হানিমুন করছি। হা হা হা! তবে সময়-সুযোগ পেলে থাইল্যান্ডের পাতায়া যাব হানিমুন করতে। জায়গাটা চৈতীর খুব পছন্দ।’ বিশ^নাথের ঘরের কোচ তার স্ত্রী!’ কিভাবে? ‘আমার সব খেলা ও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে, সমালোচনা করে, পরামর্শ ও উৎসাহ দেয়। ও আমার প্রতি খুব যতœশীল।’ মোটা হয়ে যাবেন বলে বিশ^নাথকে সপ্তাহে একবারের বেশি ভাত খেতে দেন না চৈতী। মজার ব্যাপার, আগে ফুটবলের ‘ফ’-ও বুঝতেন না চৈতী। বিষয়টা শোনা যাক তার মুখেই, ‘ফুটবলের নিয়ম-কানুন, পজিশন এগুলো কিছুই বুঝতাম না। শুনলে হাসবেন, দুই দলের কারা যে কোন্ দিকে গোল করবে, সেটাও বুঝতাম না! বিশ^নাথই আমাকে সবকিছু শিখিয়েছে।’ সেই সঙ্গে স্বামীর উদ্দেশে তার প্রশংসা ও পরামর্শ, ‘ওর একাগ্রতা, নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করে। ওভারল্যাপ করে ও দ্রুত ওপরে উঠতে পারে। লম্বা থ্রোয়িংয়ে ওকে আরও উন্নতি করতে হবে।’ চৈতী গ্যালারিতে গিয়ে প্রথমবার বিশ^নাথের খেলা দেখেন ২০১৬ সালে, মোহামেডান বনাম আবাহনীর লিগ ম্যাচে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তো বটেই, জীবনে প্রথম কোন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে দর্শক হিসেবে ওটাই ছিল চৈতীর অভিষেক ম্যাচ! সারপ্রাইজ দিতে তিনি স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন বিশ^নাথকে না জানিয়ে! খেলা শেষে গ্যালারির কাছে আসার পর চৈতীকে দেখে চিনতে পেরে তাকে বিশ^নাথ বলেন, ‘চাকমা চেহারার মেয়েটাকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি!’ পরেরবার ২০১৯ সালে, একই মাঠে, ফেডারেশন কাপের ফাইনালে ছিলেন চৈতী। বিশ^নাথের বসুন্ধরা কিংস চ্যাম্পিয়ন হয়। একটি গোল এ্যাসিস্ট করা ও প্লেয়ার অব দ্য ফাইনাল হওয়া বিশ^নাথ গোল উদযাপন করেন চৈতীকে উড়ন্ত চুম্বন করে! ‘ফ্লাইং কিসটা যে আমার উদ্দেশে, সেটা বুঝতে পেরে খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম।’ ২০০০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখা চৈতীর সলজ্জ স্মৃতিচারণ। মাঠে মাথা গরম করে খেলে ফাউল করে প্রায়ই কার্ড পান বিশ^নাথ, এটা কষ্ট দেয় চৈতীকে। তবে দাবি করেন, ‘বিয়ের পর ওর মাথা গরম স্বভাবটা অনেকটাই কমেছে!’ এছাড়া বিশ^নাথের আরেকটা দিক জানান, ‘বাজারে গেলে একাধিক আইটেম হলে অনেক কিছুই ভুলে আনে না। ঠিক করেছি এখন থেকে বাজারে গেলে ওকে লিস্ট করে দেব।’ নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখা (পড়ছেন সিদ্বেশ^রী গার্লস কলেজে বিবিএতে, তৃতীয় বর্ষে) চৈতীর তিন প্রিয় ফুটবলারের দুজন আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি এবং ভারতের গুরপ্রিত সিং সান্ধু। আরেকজন? অবশ্যই তার পরানের স্বামী, বিশু!
×