ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুহারেও এগিয়ে

করোনায় পুরুষরা কেন বেশি আক্রান্ত?

প্রকাশিত: ২২:২৮, ৫ মে ২০২০

করোনায় পুরুষরা কেন বেশি আক্রান্ত?

রাজন ভট্টাচার্য ॥ করোনার থাবায় বিশ^ব্যাপী এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ৩৫ লাখ। মৃত্যু হয়েছে আড়াই লাখ মানুষের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১৮২ জনের, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ২০০ জনের বেশি। তবে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব এখনও কোভিড-১৯ এর চোখ রাঙানির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস নারীদের তুলনায় পুরুষদের জন্যে বেশি ভয়ঙ্কর। এ ভাইরাসে নারীদের তুলনায় পুরুষের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুহার কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিগুণ অথবা আড়াইগুণ। করোনায় ভরাবহতার শিকার দেশগুলোর পরিসংখ্যান তুলে ধরে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম। দেশে সোমবার পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে ৭৩ ভাগ পুরুষ ও ২৭ ভাগ নারী। প্রশ্ন হলো কেন পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কেনই বা পুরুষের মৃত্যুহার বেশি। গোটা বিশে^র কাছে করোনা ইস্যু এই প্রশ্ন সামনে এনেছে। যদিও এ নিয়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশে চলছে গবেষণা। চলছে চুলছেড়া বিশ্লেষণ। এ নিয়ে মতামত দিয়েছেন দুনিয়ার নামকরা চিকিৎসকসহ বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী এবং ২ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ মারা যেতে পারে। ‘বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, করোনায় নারীদের তুলনায় পুরুষদের মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি’ এই শিরোনামের টেলিগ্রাফ প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, যারা নিশ্চিতভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষের জন্যে ভাইরাসটি ভয়ঙ্কর। সেই তুলনায় এটি ভয়ঙ্কর ২ দশমিক ৮ শতাংশ নারীর জন্য। বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মতে, পুরুষদের মধ্যে ধুমপান ও অ্যালকোহলের গ্রহণের হার বেশি বলে এমনটি হতে পারে। আবার কারো কারো মতে, পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের হার বেশি হওয়ায় তারা নারীদের তুলনায় বেশি করোনা ঝুঁকিতে আছেন। কেন করোনাভাইরাস নারীদের তুলনায় পুরুষদের জন্যে বেশি ভয়ঙ্কর শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের লস এ্যাঞ্জেলেস টাইমসের এক প্রতিবেদনে গত ২১ মার্চ বলা হয়েছে, ‘ইতালির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি নারীদের তুলনায় কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে যে সংখ্যক পুরুষ রয়েছেন তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশর মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। একই ধরনের পরিসংখ্যান চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লে করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনের কোভিড-১৯ আক্রান্তদের নিয়ে করা এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংক্রমিতদের মধ্যে ৬০ শতাংশ পুরুষ। চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মৃত্যু হার ৬৫ শতাংশ বেশি। একই অবস্থা ১৬ বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রেও। উহানের শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত ১৭১ জন শিশুর মধ্যে ৬১ শতাংশ ছেলে। দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ পুরুষ। দেশটিতে মোট আক্রান্তদের মধ্যে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মৃত্যুহার ৮৯ শতাংশ বেশি। গুরুত্বপূর্ণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ॥ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নারীর তুলনায় পুরুষের বেশি ধূমপান করা ও বেশি অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ধূমপান ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এছাড়াও পুরুষের তুলনায় নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হতে পারে বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। লস এঞ্জেলেস টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ওকলাহোমা মেডিক্যাল রিসার্চের ইমিউনোলজিস্ট সুসান কোভাতস বলেছেন, গবেষকরা প্রমাণের জন্য কোভিড-১৯ এর রেকর্ড দেখছেন। পুরুষের তুলনায় নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এ ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হতে পারে। যদি এই ‘সহজাত’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে তাহলে সংক্রমিত নারীরা ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে ফেলতে পারেন। ইউসি ডেভিসের ফুসফুসবিষয়ক গবেষক কেন্ট ই পিঙ্কারটন বলেন, নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরুষদের তুলনায় ভাল কাজ করছে জেনে আমি মোটেই অবাক হইনি। বহু বছর ধরে ইমিউনোলজিস্টরা কেবল পুরুষদের নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কারণ নারীর হরমোনের ভিন্নতা তাদের গবেষণার ফলাফলকে জটিল করে তুলছিল। বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে যুক্তরাজ্যের ইস্ট এ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল হান্টার বলেন, প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষের তুলনায় নারীর রয়েছে ভিন্নমাত্রার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। পুরুষদের তুলনায় নারীদের দেহে ফ্লুর প্রতিরোধক এ্যান্টিবডি বেশি তৈরি হয়। এর অনেক প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। দেশে ৭৩ ভাগ পুরুষ আক্রান্ত ॥ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে এখন পর্যন্ত ১৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২৭ শতাংশ নারী। সোমবার নিয়মিত অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিনে এ তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডাঃ নাসিমা সুলতানা। গত ৩ মে রিপোর্ট থেকে মারা যাওয়াদের বয়সের চিত্র তুলে ধরে নাসিমা সুলতানা বলেন, মারা যাওয়াদের মধ্যে ৬০ বছরের বেশি ৪২ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ২৭ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১৯ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৭ শতাংশ, ৩ জন রয়েছেন ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এবং ১০ বছরের নিচে রয়েছে ২ শতাংশ। নাসিমা সুলতানা বলেন, গতকাল বলেছিলাম ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মারা যাওয়া একজন আছে। কিন্তু এটাকে শতাংশের তালিকায় আনা হয়নি। যেহেতু এটা ১১ বছর বয়সের কম দশমিক ৫ শতাংশ। একজন ব্যক্তি এরকম হয় না। এজন্য এটা শতাংশের মধ্যে আসেনি। জার্মানের প্রতিবেদন ॥ করোনাভাইরাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হানার শিকার দেশগুলোর মৃত্যুর হার পরিসংখ্যান করে জার্মান অনলাইন পোর্টাল স্ট্যাটিস্টা বলছে নারীদের থেকে পুরুষরা আড়াইগুণ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডেটা, প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক খাতের তথ্য সংগ্রহ করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে স্ট্যাটিস্টা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষেরা বেশি ঝুঁকিতে। নারীর চেয়ে পুরুষেরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপের দুটি দেশ ইতালি ও স্পেন। এ দুটি দেশে নারীর তুলনায় পুরুষের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। ইতালিতে কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭১ শতাংশ পুরুষ এবং ২৯ শতাংশ নারী। স্পেনে মৃতদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৫ শতাংশ নারী। মৃতদের মধ্যে ফ্রান্সে পুরুষের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ ও নারীর সংখ্যা ৪২ শতাংশ, ইরানে ৫৯ শতাংশ পুরুষ ও ৪১ শতাংশ নারী মারা গেছে। জার্মানিতে মৃত্যুর হারে ৬৬ শতাংশ পুরুষ ও নারী ৩৪ শতাংশ। ইতালির মতো ডেনমার্কেও নারী পুরুষের মৃত্যুর হারে পার্থক্য অনেক, হারও এক। সেখানে মৃতদের মধ্যে ৭১ শতাংশ পুুরুষ, ২৯ শতাংশ নারী। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদিও নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী, এরপরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে ফেলে এমন অটোইমিউন রোগের ৮০ শতাংশের বেশি নারীদেরই হয়ে থাকে। এটার কারণ হখন একটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়, তখন অন্যান্য রোগ দেহের অন্য অঙ্গকে লক্ষ্যবস্তু করে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
×