ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উৎসবমুখর হাওড় ॥ ৮৫ শতাংশ ধান কাটাই সম্পন্ন

প্রকাশিত: ২২:২১, ৫ মে ২০২০

উৎসবমুখর হাওড় ॥ ৮৫ শতাংশ ধান কাটাই সম্পন্ন

কাওসার রহমান ॥ বিশাল এক উৎসবমুখর কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে এবার সোনালি ধান ঘরে তুলেছেন হাওড়বাসী। এবারের মতো এমন উৎসাহ উদ্দীপনায় হাওড়ে ধান কাটা দেশের ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। এর অন্যতম কারণ হলো সরকারী প্রশাসন যন্ত্রের সরাসরি সহযোগিতা এবং এই প্রথম ব্যাপকভাবে যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কাটা। হাওড়ের এই কর্মযজ্ঞে এবার ৮৭৯টি ধান কাটার যন্ত্র ও সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক অংশ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে হাওড়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। আর তিন-চার দিনের মধ্যে হাওড়ের শতভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হবে। ফলে হাওড় নিয়ে দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে এখন সরকারের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। ধান কাটার এই কর্মযজ্ঞটি প্রতিদিন সরাসরি মনিটর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। এতদিন হাওড়ের ধান কাটার ইতিহাস ছিল ভারি বৃষ্টি ও আগাম পাহাড়ী ঢলের আশঙ্কা। সাম্প্রতিক সময়ে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শ্রমিক সঙ্কট। এবার সেই শঙ্কা ও সঙ্কট আরও ঘনীভূত করেছিল করোনাভাইরাস নামক এক অদৃশ্য দানবের বিস্তার ঠেকানোর লকডাউন। কিন্তু শঙ্কা থাকলেও এবার শেষ পর্যন্ত সব কিছু ছাপিয়ে হাওড়ের ধান কাটা উৎসবে পরিণত হয়েছে সরকারের বিরল সহযোগিতা ও উদ্দীপনায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে সরকারের পুরো প্রশাসন এসে দাঁড়িয়েছে হাওড়ের চাষীদের পাশে। সেই সঙ্গে সরকারের উদ্দীপনা সৃষ্টির কারণে দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষও কোমড় বেঁধে হাওড়ে নেমেছেন চাষীদের সারাবছরের একমাত্র ফসল ঘরে তুলে দিতে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সরকারের প্রশাসনিক সহযোগিতার পাশাপাশি যান্ত্রিক সহযোগিতা হাওড়ের ধান কাটায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইতিহাসে এই প্রথম হাওড়ের ধান কাটা যান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করেছে। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর ও রিপারের ছোঁয়ায় বিয়ে বাড়ির মতো মহা ধুমধামেই এখন হাওড়ের চাষীরা তাদের মাঠের সোনালি ফসল ঘরে তুলছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর আকার ধারণ করায় বিশ্বে খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। তাই এই খাদ্য সঙ্কট এড়ানোর জন্য সরকারের সামনে প্রথম টেস্ট কেস ছিল পাহাড়ী ঢল বা ভারি বৃষ্টিপাতের আগেই হাওড়ের ধান কেটে কৃষকের গোলায় তোলা। ফলে এটা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এবার সব সময় পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন যথাসময়ে হাওড়ের ধান কাটার বিষয়ে। কৃষি মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে হাওড়ের ধান কাটার ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ছিল বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকদের হাওড় এলাকায় নিয়ে যাওয়া এবং দ্রুত ধান কাটার জন্য কৃষি যন্ত্র সরবরাহ করা। এ ব্যাপারে গত ৯ এপ্রিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিসে ধান কাটা শ্রমিকদের ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাওড় এলাকায় আগমন ও চলাচল নির্বিঘœ করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ’ করা হয়। নোটিসে বলা হয়, ‘হাওড় এলাকায় ধান কর্তন ও চলাচলকালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি হ্রাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ নিজের, কৃষকের ও শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে পালন করবেন।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেন বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকদের হাওড় অঞ্চলে নিয়ে যাবার ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ ব্যাপারে পুলিশ বাহিনী পূর্ণ সহযোগিতা করে। তারা নিজেরাই বাস দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের হাওড়ের জেলাগুলোতে নিয়ে যায়। আবার কৃষি মন্ত্রী নিজেও রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলা থেকে কৃষি শ্রমিকদের হাওড়ে নিয়ে আসার জন্য জেলা প্রশাসক এবং কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। ফলে সেসব জেলার জেলা প্রশাসনও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিধি মেনে শ্রমিক পাঠায় হাওড় অঞ্চলে। সরকারের এসব উদ্যোগের কারণে সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক হাওড় অঞ্চলে এসে পৌঁছেন এবং নয় শ’ ধান কাটার কৃষি যন্ত্র সরবরাহ করা হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে হাওড়ের ধান কাটার লক্ষ্য নিয়ে সরকার ধান কাটার কাজ শুরু করে। সে লক্ষ্য ইতোমধ্যে পূরণের পথে। আর তিন-চার দিনের মধ্যে হাওড়ের শতভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। হাওড়ের গুরুত্ব ॥ বোরো ধান উৎপাদনে হাওড় এলাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত : হাওড় অঞ্চলের ৭টি জেলার মানুষ এই বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। কারণ বোরোই হচ্ছে তাদের একমাত্র ও প্রধান ফসল। হাওড় এলাকায় কিছু আউশ ধান আবাদ হলেও তা নগণ্য। ফলে হাওড়বাসীর জন্য তাদের এই বোরো ফসল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত : দেশে বোরো ধান সর্বপ্রথম কাটা শুরু হয় হাওড় অঞ্চলে। কোন কারণে ওই অঞ্চলের ধান পাহাড়ী ঢল বা বন্যায় তলিয়ে গেলে তার প্রভাব পড়ে দেশের পুরো ফসল উৎপাদনের ওপর। চাল ব্যবসায়ীরা এটাকে পুঁজি করে বাড়িয়ে দেন চালের দাম। যেটা ২০১৭ সালে দেখা গেছে। ওই বছর পাড়াড়ী ঢল ও ভারি বর্ষণে হাওড়ের সব ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এতে ১০ লাখ টন বোরো কম উৎপাদন হলেও বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে সারাবছর ধরেই চালের দাম বাড়তি থাকে। তৃতীয়ত : দেশের মোট উৎপাদিত বোরোর প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় হাওড়ের সাত জেলায়। এবছর সারাদেশে চাল আকারে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে হাওড় অঞ্চলে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২০ ভাগের জোগান দেয় হাওড় অঞ্চলের বোরো ধান। ফলে দেশের চাল উৎপাদনে হাওড় অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ কারণেই সরকার আগাম বন্যা, পাহাড়ী ঢল বা ভারি বৃষ্টিপাতের আগেই হাওড়ের ধান কাটায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এতে এবার পুরো সফল হয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে হাওড়ের ৮৫ ভাগ ফসল কাটা সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ ফসলও আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই কৃষকের ঘরে তোলা সম্ভব হবে। হাওড়ে নতুন মাত্রা যান্ত্রিকীকরণ ॥ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল বা ভারি বৃষ্টিপাতের আগেই ফসল ঘরে তোলার জন্য হাওড়ে এখন শেষ সময়ে চলছে ধানকাটা। হাওড়ের ধান কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল কৃষকদের। সেই দুশ্চিন্তা দূর করে হাওড়ের ধান কাটার চিত্রই বদলে দিয়েছে মেশিন। দ্রুত ধান কাটতে এবার বড় ভূমিকা রেখেছে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর ও রিপার মেশিন। কৃষকের পাশাপাশি দ্রুত ধান কাটতে এখন হাওড়ে ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েক শ’ কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর ও রিপার মেশিন। বর্তমানে তিন লাখ ৪৯ হাজার ৬৫১ জন শ্রমিক এবং ৮৭৯টি যন্ত্রের মাধ্যমে হাওড় অঞ্চলে ধান কাটা হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে ৩৬৯টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর এবং ৫১৩টি রিপার। যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কাটতে পেরে হাওড়ের চাষীরা খুবই খুশি। কারণ এই যন্ত্র শুধু তাদের শ্রমিক সঙ্কটই দূরে করে দেয়নি, অর্থেরও সাশ্রয় করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে সাশ্রয় হচ্ছে সময়ের। যন্ত্র দিয়ে ধান কাটায় কৃষকদের এখন অর্ধেক অর্থই সাশ্রয় হচ্ছে। শ্রমিক দিয়ে এক বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াইয়ে যেখানে তিন হাজার টাকা খরচ পড়ে, সেখানে যন্ত্র তথা হার্ভেস্টর দিয়ে তাদের এক বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করতে খরচ পড়ছে মাত্র ১৫শ’ টাকা। আবার এই ধান কাটা ও মাড়াইয়ে যেখানে একদিন লেগে যাওয়ার কথা, সেখানে এক ঘণ্টায়ই এক বিঘা জমির ধান কেটে মাড়াই করে বস্তাবন্দি করে দিচ্ছে হার্ভেস্টর। ফলে যন্ত্র দিয়ে ধান কাটতে পেরে হাওড়ের কৃষক এবার মহাখুশী। তারা সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন, আগামী বছর হাওড়ের ধান কাটায় যাতে আরও বেশিসংখ্যক হার্ভেস্টর দেয়া হয় কৃষকদের। হার্ভেস্টিং মেশিন হলো এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে ধান কাটা থেকে শুরু করে ঝাড়াই, মাড়াই, বস্তাবন্দী সবকাজ একবারে হয়ে যায়। এবং রিপার মেশিন দিয়ে শুধু ধান কাটা যায়। সাধারণ একটি হার্ভেস্টিং মেশিন এক একর জমির ধান এক ঘণ্টায় কাটতে পারে। এভাবে দিনে দুই শিফটে ১৬ ঘণ্টায় ৫০ বিঘা ধান কাটা সম্ভব হার্ভেস্টর দিয়ে। এতে একজন অপারেটর অন্তত ১৫০ জন শ্রমিকের কাজ করতে পারেন। এসব যন্ত্রের ভাড়া বা তেল খরচ বাবদ খরচও হয় কৃষি শ্রমিকদের মজুরির তুলনায় অনেক কম। যেমন একজন কৃষকের ১০ বিঘা জমির ধান কাটতে ৭০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন। যাদের মজুরি বাবদ খরচ পড়বে প্রায় ৭০ হাজারের মতো টাকা। অথচ একটি হার্ভেস্টিং মেশিন দিয়ে মাত্র প্রায় অর্ধেক খরচে তিনি এই কাজ করিয়ে নিতে পারবেন মাত্র ১০ ঘণ্টায় । তবে যন্ত্র দিয়ে বেশি পানি জমে থাকা নিচু জমির ধান কাটা যায় না। কেবলমাত্র সমতল জমির ধান হার্ভেস্টর ও রিপার দিয়ে খুব সহজেই কাটা যায়। ফলে হাওড় এলাকার সমতল জমির ধান কাটা হয়েছে যন্ত্র দিয়ে, আর পানি উঠে যাওয়া নিচু জমির ধান যথারীতি শ্রমিকদের দিয়ে কাটা হচ্ছে। উদ্দীপনার নতুন দৃষ্টান্ত ॥ কৃষক ও শ্রমিকদের উৎসাহ ও সহমর্মিতা-সহানুভূতি জানাতে কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক নিয়মিত বিভিন্ন হাওড় এলাকায় বোরো ধান কাটা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওড় এলাকা পরিদর্শন করেছেন। কৃষিমন্ত্রীর নিয়মিত মনিটরিং এবং পর্যবেক্ষণের কারণে সাধারণ মানুষও কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে উদ্দীপ্ত হচ্ছে। কৃষকের ধান কাটার দুশ্চিন্তা ঘোচাতে ধান কাটতে মাঠে নেমেছেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ছাত্র, স্কাউট সদস্য, বেকার যুবকসহ সব পেশার মানুষ এখন ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাঁধে কাঁধ রেখে কৃষকদের ধান কেটে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাওড়ের ধান কাটার বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন স্থানীয় জেলা প্রশাসকরা। অনেক জেলা প্রশাসক নিজে মাঠে গিয়ে কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন। এতে স্থানীয় প্রশাসন যন্ত্রও কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হাওড় এলাকায় ধান কেটে কৃষকদের ঘরে তুলে দিতে উদ্বুদ্ধ করতে কাস্তে হাতে মাঠে নামেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন নিজেই। এছাড়া পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, পৌর মেয়র মোঃ ফজলুর রহমান, মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারীসহ অনেকেই। আবার সরকারের পুলিশ বিভাগও হাওড়ের ধান কাটায় শ্রমিক দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তারা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসে করে শ্রমিকদের নিয়ে গেছে হাওড় অঞ্চলে। ফলে এবার সহজেই হাওড়ের ধান কাটার জন্য কৃষকদের শ্রমিক সঙ্কটের শঙ্কা দূর হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওড়ের ভুকশিমইল এলাকায় নানা পেশার মানুষের সঙ্গে ধান কাটতে ক্ষেতে নামেন সুলতান আহমদ নামের এক স্কুল শিক্ষকও। তিনি কুলাউড়া উপজেলার রবিরবাজার ইছাছড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে গ্রামে অনেক মানুষ তার মূল পেশার কাজ করতে পারছেন না। হাওড়ে উৎপাদিত ধান কাটতে কর্মহীনরা নেমে পড়লে ধান মাঠে পড়ে থাকবে না।’ ভুকশিমইল এলাকার কৃষক ও ক্ষুদ্র কাপড় ও কসমেটিক্স ব্যবসায়ী সিরাজ আহমদ বলেন, এক মাস থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখন কর্মহীন। হাতে খরচ করার মতো কোন টাকা নেই। তাই নিজের বর্গা দেয়া জমির ধান কাটতে এসেছি। শ্রমিক সঙ্কটের মৌলভীবাজার জেলার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার কৃষকদের পাশে দাঁড়ায় দুটি উপজেলার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা কৃষকের ধান কেটে দেন। গত ২৫ এপ্রিল দুপুরে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এমরান হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জুনেদ আহমদের নেতৃত্বে শতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী হাকালুকি হাওড়ের মুর্শিবাদকুরা গ্রামের কৃষক মনোরঞ্জন বিশ্বাসের তিন বিঘা ধান কেটে দেন। অন্যদিকে, জুড়ী উপজেলা ছাত্রলীগ ও কলেজ ছাত্রলীগও কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তুলে দিয়েছে। কৃষক ইউসুফ মিয়ার দুই বিঘা জমির ধান কেটে বাড়ি পৌঁছে দেন তারা। এ প্রসঙ্গে কৃষক ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘শ্রমিক সঙ্কটে পাকা ধান কাটতে পারছিলাম না। ঝড় হলে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবে, তাই চিন্তায় ছিলাম। বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে তারা ধান কেটে দেয়ায় আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’ সর্বশেষ অগ্রগতি ॥ জানা যায়, ইতোমধ্যে হাওড়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ বোরো ধান কেটে কৃষক ঘরে তুলেছেন। এখন বাকি আছে মাত্র ১৫ শতাংশ। এর বেশিরভাগই কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকায়। ওই এলাকার কৃষকরা ব্রি ২৯ ধান আবাদ করেছে বেশি। এই এলাকার ধান এখনও পুরোপুরি না পাকায় পিছিয়ে আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব মতে, ২ মে পর্যন্ত ধান কাটার অগ্রগতি ছিল সিলেট ৯০ শতাংশ, মৌলভীবাজার ৯১ শতাংশ, হবিগঞ্জ ৮৬.৭০ শতাংশ, সুনামগঞ্জ ৮৪ শতাংশ, কিশোরগঞ্জ ৮০ শতাংশ, নেত্রকোনা ৯৩ শতাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৮১.৬০ শতাংশ। আর এই দিন পর্যন্ত ধান কাটায় অংশ নিয়েছে ৩৬৯টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ও ৫১৩টি রিপার এবং তিন লাখ ৪৯ হাজার ৬৫১ জন শ্রমিক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুসারে হাওড়াঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাতটি জেলায় এবছর শুধু হাওড়ে ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে ২ মে পর্যন্ত ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৩৬৯ হেক্টর জমির ধান। শতকরা হিসাবে ধান কাটার অগ্রগতি হচ্ছে ৮৫ শতাংশ। এ বছর বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। এ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২০ ভাগ আসবে হাওড়াঞ্চল থেকে। হাওড় নিয়ে স্বস্তি বোধ করছি: কৃষিমন্ত্রী ॥ এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, হাওড় এলাকায় ধান কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম কারণ পাহাড়ী ঢলে ধান অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। সেই শঙ্কা কেটে গেছে। খুশির কথা হলো ইতোমধ্যে হাওড় অঞ্চলের ৮৫ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকার ধান কাটা কিছুটা পিছিয়ে আছে। কারণ ওই এলাকায় ব্রি ২৯ জাতের ধান বেশি আবাদ করা হয়েছে। এই ধান একটু দেরিতে পাকে। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে ওই এলাকায় ধান আবাদ করতে একটু দেরি হয়েছে। ব্রি-২৮ জাতের ধান আগে পাকে, এটি কাটা শেষ হয়েছে। এখন ব্রি-২৯ জাতের ধান কাটা চলছে, আর কয়েক দিনের মধ্যেই এই ধানও কাটা শেষ হয়ে যাবে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, হাওড় এলাকার ধান সফলভাবে কাটার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। পরিবহন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হাওড়াঞ্চলের ধান কাটার জন্য আমরা বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকদের আনার ব্যবস্থা করেছি। পরিবহন নেতা জাতির পাটির মহাসচিব এমপি মশিউর রহমান রাঙ্গাকে অনুরোধ করেছি বাস ভাড়া কমিয়ে দেয়ার জন্য। আমাদের প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ভাইকে (মোহাম্মদ নাসিম এমপি) অনুরোধ করেছি পাবনা সিরাজগঞ্জ থেকে শ্রমিক পাঠানোর জন্য। তার ছেলে সাবেক এমপি তানভীর শাকিল জয় এলাকায় উপস্থিত থেকে শ্রমিক পাঠিয়েছে। এভাবে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে এসেছি। শ্রমিকের পাশাপাশি হাওড় এলাকায় ধান কাটার জন্য ৩৬৯টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর ও ৫১৩টি রিপার যন্ত্র দিয়েছি। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে ধান কাটা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফলে এখন পাহাড়ী ঢল বা ভারি বৃষ্টিপাত হলেও আর ভয়ের কিছু নেই। হাওড় নিয়ে আমরা এখন স্বস্তি বোধ করছি। তিনি বলেন, ‘যন্ত্র দিয়ে এত চমৎকারভাবে ধান কাটা হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখে বিস্মিত হয়েছেন। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর দিয়ে সুন্দরভাবে ধান কেটে মাড়াই হয়ে একেবারে ঝকঝকে ধান বের হয়। এটা দেখে কৃষকও খুব খুশি। এবার মাঠ থেকেই পাইকাররা ভাল দামে ধান কিনে নিয়েছেন। ফলে কৃষকও ধানের ভাল দাম পেয়েছেন।’ তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্বে খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই খাদ্য উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আশা করি কৃষি উৎপাদন ও বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে পারব। বাংলাদেশে খাদ্যের সঙ্কট যাতে না হয়, সেজন্য যা যা করা দরকার, আমরা সেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
×