বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রাণঘাতী করোনার মধ্যেও হঠাৎই দেশে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের বিদ্রোহী ও সংস্কারপন্থীদের নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের খবর। শনিবার সংবাদ সম্মেলনে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নামে দল গঠন করে ২২২ সদস্যের কমিটিরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে দলটি নিজেদের জামায়াত ও শিবিরের আদর্শিকভাবে জামায়াত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও সংস্কারপন্থী বলে দাবি করলেও একে ‘জামায়াতেরই ভিন্নরুপ’ বলে অভিহিত করেছেন বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একই মত দিয়ে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীসহ উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার দেশের ইসলামী নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ‘এটা জামায়াতের ভন্ডামী’। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন তারা।
এর আগে এক বছর ‘জন আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’ নামে প্লাটফর্মে ঘর গোছানোর পর শনিবার নতুন রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব ও কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহী ও সংস্কারপন্থীরা। দলের নাম ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)’। রাজধানীর বিজয়নগরে ‘সায়হাম স্কাই ভিউ’ টাওয়ারে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের নাম ঘোষণা করেন বহিষ্কৃত জামায়াত নেতা ও ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু। যার নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল ‘জন আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’। মুজিবুর রহমান মঞ্জু নতুন দলের সদস্য সচিব। সংবাদ সম্মেলনে মেজর (অব) ডাঃ আবদুল ওহাব মিনার ও সুপ্রীম কোর্টেও আাইনজীবী তাজুল ইসলামসহ সাতজনকে যুগ্ম-আহ্বায়ক, নয়জনকে সহকারী সদস্য সচিবসহ ২২২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন দলের আহ্বায়ক জামায়াত থেকে পদত্যাগ করা সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে মুজিবুর রহমান মঞ্জু নতুন দলের ঘোষণা দিয়ে বলেন, সমালোচকদের তির্যক ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে আমাদের দলের নাম ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’- এবি পার্টি। আমরা মনে করি, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি সেই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর। ‘আমাদের দলের সঙ্গে জামায়াতের কোন সম্পর্ক নেই’ নতুন দলের নেতারা এমন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, এটি একেবারেই স্বতন্ত্র একটি দল। জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও আদর্শিক কোন ধরনের সম্পর্ক নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না। গত বছরের ২৭ এপ্রিল যাত্রা শুরু হয়েছিল জন আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ নামে নতুন এ রাজনৈতিক উদ্যোগের। এই উদ্যোগের মূলে আছেন জামায়াতের পদত্যাগী প্রভাবশালী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
রাজ্জাকের উদ্যোগকে সমর্থন দিচ্ছেন শিবিরের প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্রেটারি ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ড. আব্দুল বারী, ফরিদ আহমদ রেজাসহ কয়েকজন সাবেক প্রভাবশালী নেতা। দলের আহ্বায়ক সোলায়মান চৌধুরী এক সময় ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শুরা সদস্য এবং জাতীয় পেশাজীবী ফোরামের সভাপতি।
গত বছর ডিসেম্বরে তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে ‘জন আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’ এর সঙ্গে যুক্ত হন। সাবেক সচিব সোলায়মান চৌধুরী রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের সময় ফেনীর জেলা প্রশাসক থাকাকালে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক আলোচিত হন এই আমলা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি কুমিল্লা-৯ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন।
এদিকে দল গঠনকে কেন্দ্র করে হঠাৎই জামায়াতে অস্থিরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় দলের অবস্থান জানিয়ে তৃণমূলকে চিঠি দিয়েছে জামায়াত। চিঠিতে বলা হয়, সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত দলের আমির, সেক্রেটারি, অঞ্চল দায়িত্বশীল, জেলা ও মহানগর আমিরের মাধ্যমে যথাসময়ে সরাসরি জানানো হবে। এর বাইরে কারও আবেদন-নিবেদন ও অনুরোধে নেতাকর্মীরা যাতে সাড়া না দেয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে নতুন এ রাজনৈতিক দল নিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া না আসলেও এবি পার্টিও উত্থান নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার সংগঠন ও ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ। কথা বলেছেন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদরাও। প্রায় প্রত্যেকেই এ সংগঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারের কঠোর নজরদারির আহ্বান জানিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন, জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর গত ৮০ বছরে যখনই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে তখনই চেহারা লুকিয়ে নতুনভাবে হাজির হয়েছে।
এবার তাই করছে। সংগঠনটির নেতারা যাই বলুক সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে যারাই বাংলাদেশ চায়নি। যারাই একাত্তরের গণহত্যা চালিয়েছে। যারা আজও বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না। তাদের একটি পক্ষই আজ দল গঠন করে নামি দিয়েছে, আমার বাংলাদেশ পার্টি। এই দল গঠনকে জাতির জন্য লজ্জার বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
লেখক, সাংবাদিক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর জনকণ্ঠকে বলেছেন, যতই তারা জামায়াত থেকে বের হয়ে আসার কথা বলুক না কেন, তারা তো জামায়াতই। আরেকটি উগ্রবাদী জঙ্গিবাদী রাজনৈতিক দল। এটা জামায়াতেরই আরেক রূপ। এই রূপকে এখনই প্রতিহত করতে হবে।