ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সোহেল নওরোজ

গল্প ॥ করোনাকাল

প্রকাশিত: ০০:২১, ১ মে ২০২০

গল্প ॥ করোনাকাল

মোবারক হোসেন রসিক মানুষ। শুধু কথায় না, মুখের ভেতর পানের পুঁটলি চালান করে দিয়ে যখন চিবোতে থাকেন, গালচি বেয়ে রস গড়িয়ে পড়ে। একদিন দেখি, বাসার নিচে দারোয়ানের জন্য রাখা চেয়ারটাকে নিজের মনে করে তাতে বসে ঝিমোচ্ছেন। যথারীতি গালের কোণা বেয়ে পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। কয়েকটা মাছি তার মুখের ওপর ভনভন করছে। যেন সুযোগ খুঁজছে ব্যাটা একটু চোখ বুজলেই গিয়ে পানের রস চেটেপুটে খাবে! এ বাসার দারোয়ান টিটু মিয়ার সঙ্গেই কেবল তার বনিবনা হয় না। এর একটা কারণ হতে পারে, এত বড় বাড়ির সবাই যে মানুষটাকে পছন্দ করে, নিজেদের একজন মনে করে, তিনি মোবারক হোসেন। আর এ বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই টিটুকে পছন্দ করে না। কেউ কখনও তাকে হাসিমুখে কথা বলতে দেখেছে বলে স্মরণ করতে পারে না। সব কাজ করে অনিচ্ছার সঙ্গে। দেখে মনে হয় তার পূর্বপুরুষেরা বিরাট জমিদার ছিল। সদ্যই তাদের জমিদারি খোয়া গেছে। কিছুদিন বাদে আবার তা ফিরে পাবে। তখন টিটুও এই কাজ ছেড়ে জমিদারি সামলানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। মোবারক হোসেনের যৌথ পরিবার। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ আর দেড় বছরের এক নাতনিকে নিয়ে আটতলা ভবনের সপ্তম তলায় থাকেন। এ বাড়ির ভাড়াটিয়াদের মধ্যে অবস্থানের দিক দিয়ে তারাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আছেন। কাজেই বাসার মালিকের সঙ্গে সম্পর্কটা অন্যদের চেয়ে আলাদা, হৃদ্যতাপূর্ণ। মোবারক হোসেনের কথাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়ারাও সুযোগটা নিতে কার্পণ্য করে না। কারও বাসার বেসিন পাল্টাতে হবে, কারও দরজার লক নষ্ট হয়ে গেছে, কারও টাকার টানাটানির জন্য ভাড়া কিছু কম দিতে হবেÑউপায় একটাই। সোজা গিয়ে মোবারক হোসেনের কাছে বলা। একটা না একটা ব্যবস্থা তিনি ঠিকই বের করে দেবেন। সেদিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছি, দেখি মোবারক দাদু বাড়িওয়ালার সঙ্গে গম্ভীর মুখে কী যেন বলছেন! তার কথা পুরোটা কানে না এলেও বাড়িওয়ালার কথা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ‘আপনার জন্য আর পারি না মোবারক ভাই। আর কত ছাড় দেব বলুন। ভাড়াটিয়াদের এই এক বদাভ্যাস। সুযোগ পেলেই একের পর এক বাহানা নিয়ে হাজির হয়। এভাবে চলতে থাকলে আমাকেই একদিন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ ‘কী যে বলেন না! সহায়-সম্পত্তি সবার কপালে জোটে না। আপনার কপালে জুটেছে বলেই তো বলছি। আমার নিজের জন্য কখনও কিছু বলতে আসি না। কিন্তু পরের বিপদে কী করে চুপ থাকি বলুন তো! আলতাফের মেয়েটা সত্যি সত্যিই অসুস্থ। মেয়েটার চিকিৎসার জন্য আলতাফ পানির মতো টাকা ঢালছে। একা আর কত কুলাবে বলুন। তাই বলছিলাম, এ মাসের ভাড়াটা অর্ধেক করে দিলে ওর একটু উপকার হয়। আমরা একই বিল্ডিংয়ে থেকে যদি এটুকু না করতে পারি তবে কেমন দেখায় আপনিই বলুন।’ ‘আচ্ছা যান কেবল আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে এ মাসের ভাড়া অর্ধেক করে দিলাম। তবে খবরটা আর কারো কানে যেন না যায়। গোপন রাখবেন। অন্য ভাড়াটেদের কানে গেলে দেখবেন কাল নানা অজুহাতে ভাড়া কমানোর জন্য সবাই লাইন দেবে। কারো হাতে থাকবে ব্যান্ডেজ, কারো কপাল কাটা, কেউ বিছানা থেকেই উঠতে পারছে নাÑ এসব বলে সুযোগ নেবে। ভাড়াটেদের আর যাই হোক কখনও অজুহাতের অভাব হয় না।’ মোবারক হোসেনের মুখে বিজয়ীর হাসি। তিনি নিজেও হয়ত এতটা আশা করেননি। মানুষের মন থেকে ক্রমেই দয়া-মায়া-মমতা উঠে যাচ্ছে। স্বার্থের বাইরে কেউ এক বিন্দু চিন্তা করতে নারাজ। আর স্বার্থ মানেই গাড়ি-বাড়ি, টাকা-পয়সা। জমাও আর জমাও। আলতাফের দুর্দিনে এই টাকাগুলো কত বড় সহায় হবে তা ভাবতেই মোবারক হোসেনের চোখ ভিজে উঠল। ॥ দুই ॥ সন্ধ্যার খানিক পর খাবার পানি আনতে নিচে নেমেছি। এ সময় কেউ পানি নিতে আসে না বলে আরাম করে কল ছেড়ে পানি নেয়া যায়। কোন কারণে আজ লিফট বন্ধ। পাঁচতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় দ্বিতীয় তলার তৌহিদ, বয়সে আমার কয়েক মাসের ছোট হবে, যে কিনা বিশেষ কারণ ছাড়া বাসায় থাকে না, সে দেখি ঘুরঘুর করছে। আমি ডাকার আগেই কাছে এসে হাজির। যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিল এতক্ষণ! ‘কী খবর তৌহিদ, এ সময়ে তুমি বাসায়?’ ‘আর যাব কোথায় ভাই! সব তো লকডাউন। করোনায় সব খেয়ে দিল। সারা দুনিয়া ছারখার করে ফেলছে। রাজা-গজা কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধুমছে লোক মরছে।’ ‘তুমি দেখি সারা বিশ্বের খবর রাখ!’ ‘শুধু বিশ্ব না ভাই, এই বাড়ির খবরও ভাল না।’ ‘বল কী? কার কী হলো?’ ‘ছয় তলার নিমাই দাদুকে করোনায় ধরেছে। কাল রাত থেকে জ্বর, কাশি। শুনছি সকাল থেকে শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। তার বউ আর ছেলে বুড়োটাকে ফেলে রেখে সাতসকালে পালিয়েছে।’ ‘তাহলে এখন উনার কী হবে?’ ‘কী আর হবে! আবার সেই মোবারক দাদু।’ ‘মানে?’ ‘কেউ তার কাছে যেতে চাচ্ছিল না। খবর পেয়ে মোবারক দাদুই ছুটে গেলেন। তার বাসার কেউ রাজি ছিল না, কিন্তু তিনি নাছোড়। হাতে-পায়ে ধরেও কেউ ঠেকাতে পারেনি। দাদুর একই কথাÑমানুষের প্রয়োজনে মানুষ ছুটে না গেলে পৃথিবী টিকে থাকবে কী করে?’ ‘ডাক্তারের কাছে নেয়নি?’ ‘হাসপাতালে খবর দেয়া হয়েছে। শুনছি তারা এসে নিয়ে যাবে।’ পরদিন সকালে দুইজন লোক এসে এ্যাম্বুলেন্সের মতো গাড়িতে করে নিমাই সাধুকে নিয়ে গেল। আর মোবারক দাদুকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রেখে দিল। একেবারে গৃহবন্দী অবস্থা। চৌদ্দ দিন একই ঘরে আটকা থাকতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের নিরাপত্তার খাতিরে নিমাই সাধুর ঘরটাতেই তাকে রাখা হলো। কাজের মহিলা গিয়ে তিনবেলা দরজার বাইরে খাবার রেখে আসবে। তিনি খেয়ে পরিষ্কার করে থালা-বাটি বাইরে রেখে দেবেন। মোবারক দাদুর মতো মানুষের জন্য কঠিন জীবন! তবু তিনি উচ্চবাচ্য না করে মেনে নিয়েছেন। নিমাই সাধুকে নিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরই পুলিশ এসে পুরো বাড়িটাকে লকডাউন ঘোষণা করে। জরুরী কারণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বাইরের কেউ যেমন বাড়িতে ঢুকতে পারবে না, তেমনি বাড়ি থেকেও কেউ চাইলেই বাইরে যেতে পারবে না। বাড়িটা লকডাউন হওয়ার পর থেকেই টিটুর ক্ষমতা কয়েক শ’ গুণ বেড়ে গেছে। সব বিষয়েই খবরদারি করছে। বাসার মালিক বাদে আর সবার সঙ্গেই মোটামুটি গলা উঁচিয়ে কথা বলছে। কেউ সে কথার জবাব দিলেই পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে। তার একটা ফোনকলেই নাকি পুলিশ ছুটে আসবে। এসেই ধপাধপ লাঠির বাড়ি! তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এমন সুযোগ বার বার আসবে না। তার মতো মানুষের জন্য করোনা ভয়ের নয়, ভয় দেখানোর উপলক্ষ্য হয়েই এসেছে। একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থাতেই দিন কাটতে থাকে। ইন্টারনেট-ফেসবুকে ঢুকে করোনার খবরা-খবর নিই। দিনে দিনে অবস্থা সত্যিই খারাপ হচ্ছে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দোকানপাট, গাড়িঘোড়াও চলছে না। একের পর এক জেলা লকডাউন হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থার সঙ্গে আগে পরিচয় না থাকায় একটু যেন অস্বাভাবিকই লাগছে! হঠাৎ করেই সবার অখ- অবসর। তবে আতঙ্কের কারণে সেই অবসর কারোরই ভালভাবে কাটছে না। বাসায় বন্দী থাকতে থাকতে সবাই হাঁপিয়ে উঠছে। বাচ্চাগুলো দরজার বাইরে বের হতে না পেরে বাবা-মাকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। একটু পরপরই তাদের প্যাঁ প্যাঁ কান্নার সুর কানে এসে লাগছে। ॥ তিন ॥ দীর্ঘ ষোলো দিন পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন নিমাই সাধু। তার দুইদিন আগেই হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ হয়েছে মোবারক হোসেনের। বাড়ির ওপর থেকে লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে। বাইরের কিছুই স্বাভাবিক না হলেও এই বাড়িতে এতদিন বাদে স্বস্তির দেখা মিলছে। সবাই খুশি হলেও, টিটু মিয়া আবার আগের মতো চুপসে গেছে। বেলুনের হাওয়া বের হওয়ার মতো তার তেজ ঠুস করে বের হয়ে গেছে। রাতারাতি এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেখে বেশ লাগছে। যারা তার অত্যাচারে জেরবার হয়ে যাচ্ছিল, তারা একটু ঠাস দিয়ে কথা বলে মুখ টিপে হাসছে। নিমাই দাদুর বউ আর ছেলে ফিরে এসেছে। এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেছে। কেউ দেখতে গেলে সেই কান্নার জোর বাড়ছে। নিমাই বেশ বুঝতে পারছেন এসবই তাকে দেখানোর জন্য করা। এতদিন একসঙ্গে থেকেও তিনি তাদের আপন হতে পারেননি কিংবা পরিস্থিতিই তাদেরকে পর হতে বাধ্য করেছে। তাই যদি হবে তবে মোবারক কেন এত বড় ঝুঁকি নিতে গেল! রক্তের সম্পর্কের বাইরেও কিছু সম্পর্ক আছে যা ব্যাখ্যা করা যায় না। মোবারক হোসেন নিজের বাসায় ফিরে গেলেও পরিস্থিতি কেমন যেন বদলে গেল! ছেলে, বৌমা আর আগের মতো কাছে আসছে না। নাতনিটাকেও কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। তিনি নিজেও এ ব্যাপার নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলছেন না। করোনাভীতি থেকেই এমনটা হয়েছে। কয়েকটা দিন গেলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কেবল বাসার ভেতরেই না, বাইরের লোকগুলোও তার সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তিনিই করোনার বাহক! কাছে আসলেই বাকিরা সংক্রমিত হয়ে পড়বে! মোবারক দাদু হঠাৎ করেই বড় একা হয়ে পড়লেন। একটা ভাইরাসের কাছে ভালোবাসা-আদর-মহব্বত এভাবে হেরে যেতে পারে না। তিনি ভাল সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। ভাল সময় আর আসে না। বুকের তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে করতে এক রাতে হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান মোবারক হোসেন। যে মানুষটা পরের বিপদে স্থির থাকতে পারত না, তিনি নিজে কাউকে বিপদে ফেলতে চাননি বলেই বোধহয় এভাবে টুপ করে সরে গেলেন! মরার সময় স্ত্রী মারুফা বেগমকে ছাড়া আর কাউকেই তিনি পাশে পাননি। কিছু সংবাদ বাতাসের আগে ধায়। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই মানুষ তা বিশ্বাস করে নেয়। বুকের ব্যথায় মারা গেলেও স্বল্প সময়ের মধ্যেই পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে গেল করোনাতে মৃত্যু হয়েছে মোবারক হোসেনের। তার লাশ দেখতেও কেউ এলো না। নিজের ছেলে আর বৌমা তাদের সন্তানের দোহাই দিয়ে সরে পড়ল। যে নিমাইয়ের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন, সেই নিমাই সাধুও বলতে লাগলÑএকবার যমের হাত থেকে বহু কষ্টে ফিরে এসেছি, এবার সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই! সকাল পর্যন্ত লাশ নিয়ে তার স্ত্রী ঘরে মধ্যেই বসে রইলেন। ॥ চার ॥ বাইরে প্রচ- বৃষ্টি হচ্ছে। পৃথিবীর ধুলো-ময়লা ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়ার মতো বৃষ্টি। চারপাশে এত মানুষ অথচ মোবারক হোসেনের লাশ দাফনের মতো কেউ নেই। মারুফা বেগম অস্থির হয়ে উঠেছেন। ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য মুঠোফোনটা হাতে নিলেন। কান্না সংবরণ করতে চাইলেও পারলেন না। কণ্ঠস্বর কঠিন করে জানতে চাইলেনÑ‘তোর বাবার কি জানাজা হবে না? তাকে কবর দিবি না? মানুষটা মরার পরে এমন অবহেলায় পড়ে থাকবে?’ ছেলে মারুফ নিরুপায় এবং নির্দয়ের মতো উত্তর দিলÑ‘করোনা রোগীদের গোসল, জানাজা আর দাফনের জন্য লোক ভাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে তাদের খুঁজবে কে? তুমি চিন্তা করো না, বৃষ্টি একটু কমলেই খোঁজ লাগাব।’ মারুফা রাগে-ক্ষোভে মুঠোফোনটা দেয়ালে ছুড়ে মারেন। মানুষের জন্য এত করে কী লাভ পেল লোকটা? মোবারক হোসেনের মতো মানুষের যদি এই দশা হয়, তিনি মারা গেলে হয়ত পাটিতে জড়িয়ে এতক্ষণে লাশটা পুড়িয়ে দিত বা কোথাও ফেলে আসত! দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মারুফা বেগম দরজা খুলতে ছুটে যান। অন্ধকারের চাদর সরিয়ে একটু যেন আশার আলো দেখা গেল! বাইরে টিটু আর তিনজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই স্টেইনলেস স্টিলের খাটিয়া চকচক করছে। টিটু মিয়া ভেজা গামছা চিপে মাথা মুছতে মুছতে বলেÑ‘দাদুরে নিয়ে যাতি আসিছি। আমরাই তারে গোসল করাব। জানাজা দেব। কবর খুঁড়ে রেখে আসিছি। সেখেনেই মাটি দিয়া হবে। আপনি চিন্তা কইরেন না। আমি বেঁচে থাকতি উনারে জানাজা ছাড়া কোনো রকমে মাটিচাপা দিতি দেব না। আর সিদ্ধান্ত নিইছি, কালকের তে আর এই বাড়িতি কাজ করব না। এমন ভাল মানুষটারে যারা চিনতি পারল না, মরার পরে সম্মান জানাল না, সেখেনে থেকে শান্তি পাব না। দরকার হলি কামলা খাটপ, তাও ভাল।’ মানুষ চেনা আসলেই বড় দায়। বিপদে-আপদে তার প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হয়। বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টে কোমল মানুষটিও এ সময় ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে যায়, হৃদয়বান হয়ে যায় চরম নির্দয় আবার যার হৃদয়ের খবর কেউ রাখে না, অপাঙ্ক্তেয় বলে এড়িয়ে চলে সেই হয়ে যায় আপনের চেয়েও আপন, খুব কাছের। মোবারক হোসেন বেঁচে থাকতে সবাই তার কাছ থেকে সুবিধাটাই নিয়েছে। চোখ বোজার পর তাদের টিকেটেরও দেখা মিলছে না। আর খটোমটো ছেলেটাই নিজের সন্তানের মতো এসে দাফনের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। বৃষ্টির রেশ কমেনি, বরং আগের চেয়েও বেড়েছে। চারজন রক্তের সম্পর্কহীন মানুষ মোবারক হোসেনের খাটিয়া কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছে। তাদের চোখে হয়ত অশ্রু নেই, এ সময়ে তার প্রয়োজনও নেই; প্রকৃতি কেঁদে অশ্রুর ঘাটতি পুষিয়ে দিচ্ছে। দিনশেষে মানুষ অমানুষের মতো আচরণ করতে পারে, প্রকৃতি পারে না।
×