ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের হার ঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১ মে ২০২০

করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের হার ঝুঁকিপূর্ণ

নিখিল মানখিন ॥ দেশের ৬৩টি জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। একমাত্র রাঙ্গামাটি জেলায় করোনার থাবা পড়েনি। দৈনিক পরিসংখ্যানে সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি হলেও করোনায় নতুন করে আক্রান্ত ও মৃতের হার ঝুঁকিপূর্ণ রয়েই গেছে। দেশে করোনায় আরও পাঁচজনের মৃত্যু এবং নতুন করে ৫৬৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ৯৬৫ নমুনা পরীক্ষা করে এই ফল পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ১৬৮ এবং আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৭ হাজার ৬৬৭ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হওয়া ১০ জনসহ এ পর্যন্ত মোট ১৬০ জন সুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের করোনা পরিস্থিতি মহামারীর দিকে যাচ্ছে। ল্যাবরেটরির সংখ্যার তুলনায় পরীক্ষিত নমুনার হার বাড়ছে না। নমুনা পরীক্ষার এই হার দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারছে না। শনাক্তের বাইরে রয়ে যাচ্ছে বিশাল সংখ্যক রোগী । ঘরে অবস্থান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় না থাকায় শনাক্তের বাইরে থাকা রোগীরা প্রতি মুহূর্তে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। করোনাভাইরাস খুব দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় যে সীমিত সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে, একই সময়ে তার বহুগুণ বেশি মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে করোনাভাইরাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার তুলনায় করোনা শনাক্তের হার বাংলাদেশে বেশি। এদিক দিয়ে করোনা আক্রান্ত বিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। আর শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশ খুবই কম নমুনা পরীক্ষা করছে। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে নমুনা পরীক্ষা কয়েকগুণ বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে দেশে মোট পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার ভিত্তিতে করোনা রোগী শনাক্তের হার ১২ শতাংশ। তবে এই হার ১৩ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করে থাকে। বিশ্বের অন্য দেশে এই হার অনেক কম। আর বাংলাদেশ বর্তমানে শনাক্তকৃত রোগী সংখ্যার তুলনায় ৯ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই হার আরও অনেকগুণ বেশি। দেশে করোনা সংক্রমণ চতুর্থ ধাপের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে । করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ ধাপটি হলো ‘মহামারী’। এই ধাপে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের শেষ পর্যায়ে এসে দৈনিক করোনা টেস্ট করার সক্ষমতা বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেকগুণ বাড়ানো না হলে দেশের করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া না গেলে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করবে, যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন পাঁচজনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৫৬৪ জন- স্বাস্থ্য অধিদফতর ॥ বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অন লাইন ব্রিফিংয়ে দেশের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি জানান, ২৪ ঘণ্টায় যে পাঁচজন মারা গেছেন, তার মধ্যে পুরুষ তিনজন এবং নারী দুজন। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৬০ বছরের বেশি বয়সী দুজন এবং ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে তিন জন। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৫ হাজার ৬২৬টি। পরীক্ষা করা হয়েছে ৪ হাজার ৯৬৫টি। নমুনা সংগ্রহ বেড়েছে ১৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ১৩৮ জনকে, এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট আইসোলেশনের সংখ্যা ১ হাজার ৪২০ জন। ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৫৮ জন, এখন পর্যন্ত মোট ছাড়া পেয়েছেন ৮৯১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হোম কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে দুই হাজার ৬৭ জনকে। এখন পর্যন্ত এক লাখ ৭৭ হাজার ২৪৫ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে ১১৫ জনকে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ২৭৪ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করা হলো। ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন ২ হাজার ১৮২ জন। এখন পর্যন্ত মোট কোয়ারেন্টাইন করা হলো ১ লাখ ৮৬ হাজার ৫১৯ জনকে। কোয়ারেন্টাইন থেকে ২৪ ঘণ্টায় ছাড়া পেয়েছেন ৭৮২ জন। এখন পর্যন্ত মোট ছাড়া পেয়েছেন ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৭ জন। বর্তমানে মোট কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৭১ হাজার ৪৮২ জন। সাড়ে তিন লাখ পিপিই মজুদ রয়েছে- স্বাস্থ্য অধিদফতর ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, এ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে ১৭ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৭টি পিপিই এবং বিতরণ করা হয়েছে ১৪ লাখ ৩ হাজার ৩৯৮টি। বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৩৯টি পিপিই। করোনা সংক্রান্ত কলের বিষয়ে তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য বাতায়নের নম্বরে ৫১ হাজার ৭টি, ৩৩৩ নম্বরে ২৮ হাজার ২২৯টি এবং আইইডিসিআর’র নম্বরে ২৯৪০টি করোনা সংক্রান্ত কল এসেছে। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় মোট কল এসেছে ৭২ হাজার ১৭৬টি। এ পর্যন্ত হটলাইনগুলোতে করোনা সংক্রান্ত মোট কল এসেছে ৩৬ লাখ ৮৮ হাজার ৮৬৭টি। ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা বেশি আক্রান্ত- আইইডিসিআর ॥ আইইডিসিআর জানায়, আক্রান্তদের বয়স বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা ২৬ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা ২৪ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা ১৮ শতাংশ । আর ৫১ থেকে ৬ বছর বয়সীরা ১৩ শতাংশ, ৬০ বছরের বেশি বয়সীরা ৮ শতাংশ, ১০ বছরের নিচে বয়সীরা ৩ শতাংশ এবং ১১ থেকে ২০ বছরের বয়সীদের আক্রান্তের হার ৮ শতাংশ। লিঙ্গ ভিত্তিতে নারী ৩২ শতাংশ এবং পুরুষের আক্রান্তের হার ৬৮ শতাংশ। নতুন একটিসহ ৬৩ জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত- মিডিয়া সেল ॥ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেল জানায়, দেশের আরও ২টি জেলা সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশের ৬২টি জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা সিটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা নতুন ৩৭৫১ জন, যা দেশের মোট আক্রান্তের ৫৪.৩৯ শতাংশ এবং সিটির বাইরে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৯৯২ জন, যা মোট আক্রান্তের ২৮.৮৯ শতাংশ। এভাবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের ১২টি জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছে ৫৭৪৩ জন, যা মোট আক্রান্তের ৮৩.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত একদিনের ব্যবধানে ঢাকা বিভাগে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কিছটা কমেছে। গত বুধবার এ বিভাগে মোট আক্রান্তের হার ছিল ৮৫ শতাংশ। এ পর্যন্ত ঢাকা সিটিতে ৮৯ জন এবং ঢাকা বিভাগে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকা বিভাগেই করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৩ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯৬৫টি নমুনা পরীক্ষা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজিতে ১৩০টি, বিএসএমএমইউ ল্যাবে ৩৭১টি, চাইল্ড হেলখ রিসার্চ ফাউন্ডেশন ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১৪৯টি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১৮৫টি, আইসিডিডিআর’বি ল্যাবে ৭৫৬টি, আইদেশী ল্যাবে ২৪৫, আইপিএইচ ল্যাবে ৪৭০টি, আইইডিসিআর ল্যাবে ৩৮১টি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন ল্যাবে ৩৮০টি, মুগদা মেডিক্যাল কলেজে ১৭৪টি, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ ইনস্টিটিউটে ৮৫টি এবং ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ১৮৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার ভেতরে ৩৫১৩টি নমুনার পরীক্ষা করা হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে ৯৪টি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিকস এ্যান্ড ইনফরমেশন ডিজিজেস ল্যাবে ১১৩টি, চটগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৯টি, কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে ৯৪টি, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ১৮৮টি, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ৭২টি, রংপুরে মেডিক্যাল কলেজে ১৮৮টি, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ৮৩টি, খুলনা মেডিক্যাল কলেজে ১১৩টি, শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজে ৯৪টি, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে ১৮৮টি, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজে ২২টি, দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজে ৯৪টি এবং কুমিল্লায় মেডিক্যাল কলেজে ১০টি করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এভাবে ঢাকার বাইরে গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৪৫২টি নমুনার পরীক্ষা করা হয়েছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার ভেতরে ও বাইরে মোট পরীক্ষা করা হয় ৪৯৬৫টি। এ পর্যন্ত মোট ৬৪ হাজার ৬৬৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহে জটিলতার অভিযোগ ॥ ল্যাবরেটরির সংখ্যার তুলনায় পরীক্ষিত নমুনার হার বাড়ছে না। নমুনা পরীক্ষার এই হার দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারছে না। শনাক্তের বাইরে বিশাল সংখ্যক রোগী রয়ে গেছে। ঘরে অবস্থান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় না থাকায় শনাক্তের বাইর থাকা রোগীরা প্রতি মুহূর্তে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। করোনা ভাইরাস খুব দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় যে সীমিতসংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে, একই সময়ে তার বহুগুণ মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে করোনাভাইরাস।
×