ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী প্রণোদনা ছাড়া অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় সংশ্লিষ্টদের

করোনায় মহাদুর্যোগ সিনেমা শিল্পে

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ১ মে ২০২০

করোনায় মহাদুর্যোগ সিনেমা শিল্পে

গৌতম পাণ্ডে ॥ দেশীয় সিনেমার দুর্দিন বহু আগে থেকেই। এখন আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো জেঁকে বসেছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। তালা ঝুলছে সিনেমা হলে। লাইট, ক্যামেরা, এ্যাকশন, এর কোনটিই বহুদিন শোনা যাচ্ছে না স্টুডিওপাড়ায়। এক প্রকার থমকে গিয়েছে ঢালিউড। অঘোষিত লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ে কেমন করে দিন চালাবেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মানুষ? চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন সরকারী প্রণোদনা ছাড়া দেশের চলচ্চিত্র শিল্প টিকে থাকবে কি না সন্দেহ। ঈদ আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। একগুচ্ছ ছবি মুক্তির কথা ছিল এবার ঈদে। সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদের ‘মিশন এক্সট্রিম’, দীপঙ্কর দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’সহ বেশ কিছু বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল এবার ঈদে। এবার ঈদ-উল-আজহায় মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ঢালিউডের জনপ্রিয় জুটি অনন্ত জলিল ও বর্ষা অভিনীত দেশের সবচেয়ে বড় বাজেটের এ্যাকশন-থ্রিলারধর্মী সিনেমা ‘দিন দ্য ডে’। একশ কোটি টাকা বাজেটের এ ছবিটি নির্মিত হচ্ছে ইরানের মুর্তুজা আতাশ জমজম এবং বাংলাদেশের প্রযোজক অনন্ত জলিলের ‘এজে’ ব্যানারে। সম্প্রতি ছবিটির ট্রেলার প্রকাশিত হয়েছে। এবার বলিউডের সমতুল্য দুর্দান্ত এ্যাকশন ও বিজিএম নিয়ে ট্রেলারেই চমকে দিয়েছেন অনন্ত জলিল। এ ছবিগুলো আদৌ মুক্তি পাবে কি না কেউ জানে না। এছাড়া মুক্তির অপেক্ষায় ছিল দেবাশীষ বিশ্বাসের ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল পরিচালিত ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’, চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্বসুন্দরী’ সিনেমা। এই ছবিগুলোর মুক্তি স্থগিত করা হয়েছে। শূটিং বন্ধ হয়ে যাওয়া ছবির মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী ভিত্তিক সিনেমা ‘বঙ্গবন্ধু’। ছবিটির শূটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৭ মার্চ। করোনার কারণে সেটির নির্মাণকাজ পিছিয়েছেন ভারতীয় নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। ১৫ মার্চ থেকে নেপালে ‘কানামাছি’ সিনেমার শূটিং শুরুর কথা ছিল সেটিও স্থগিত। আরও বন্ধ হয়ে গেছে নেয়ামুলের ‘গাঙচিল’, ‘জ্যাম’, রায়হান রাফীর ‘স্বপ্নবাজী’, সৈকত নাসিরের ‘ক্যাসিনো’, সাইফ চন্দনের ‘ওস্তাদ’, ‘মন্ত্র’, ‘কাপ্তান’ ও ‘কয়লা’, দীপঙ্কর দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’সহ কয়েকটি ছবির শূটিং। এসব ছবির সেট নির্মাণসহ অনেক কাজই আগে শেষ হয়েছিল। করোনাভাইরাসের কারণে দেশীয় চলচ্চিত্র ব্যবসা এক প্রকার ভেঙ্গে পড়েছে বলা যায়। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খোঁজ পাওয়ার আগে মুক্তি পাওয়া দুটি বিগ বাজেটের ছবি ‘বীর’ ও ‘শাহেনশাহ’ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে মুক্তি পাওয়া কলকাতা থেকে আমদানি করা আরেকটি ছবি ‘রবিবার’ আর্থিক ক্ষতির অঙ্ক গুনেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে এবং আগামীতে এর পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে পৌঁছতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। এবার ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় শাকিব খান প্রযোজিত ‘বীর’ ছবিটি। প্রায় দেড় কোটি টাকা বাজেটের এই ছবিটি মুক্তি পায় ৮০টি সিনেমা হলে। প্রদর্শকদের মতে সিনেমা হলের সংখ্যা ও দর্শক কম হওয়ায় বিগ বাজেটের কোনো ছবির নির্মাণ ব্যয় ফেরত আনতে কমপক্ষে এক মাস সময় দরকার। কিন্তু ছবিটি মুক্তির পর ৮ মার্চ দেশে করোনা আক্রান্তের খবর প্রচার হওয়ায় ছবিটি নির্মাণ ব্যয়ের অর্ধেকও তুলে আনতে পারেনি বলে জানান এর প্রযোজক শাকিব খান। ৬ মার্চ মুক্তি পায় শাকিব অভিনীত ‘শাহেনশাহ’ ছবিটি। ছবিটি মুক্তির দুদিনের মাথায় দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় দর্শক আর হলমুখী হয়নি। দেড় কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত এই ছবিটি বিশাল লোকসানের কবলে পড়ে বলে জানায় ছবিটির প্রযোজনা সংস্থা শাপলা মিডিয়া। ২৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়া কলকাতা থেকে আমদানিকৃত ছবি ‘রবিবার’। ৮টি সিনেমা হলে মুক্তি পেলেও করোনার কারণে টানা প্রদর্শন করতে না পারায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়ে বলে জানান ছবির আমদানিকারক অনন্য মামুন। ৬ মার্চ মুক্তি পাওয়া ‘হলুদ বনি’ ছবিটিও করোনার কারণে ৯০ ভাগ টাকা তুলে আনতে পারেনি বলে জানায় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। প্রদর্শক সমিতির মতে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে সিনেমা হলগুলো। মিরপুরের সনি সিনেমা হলের কর্ণধার মোহাম্মদ হোসেনসহ বেশ ক’টি সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্সের কর্ণধার জানান, সিনেমা হল বন্ধ থাকলেও বিদ্যুৎ, পানিসহ নানা বিল, ট্যাক্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়মিত গুনতে হচ্ছে। এতে লোকসানের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে চলচ্চিত্রশিল্প। প্রযোজক, পরিচালক, টেকনিশিয়ানরা কার্যত বেকার এখন। কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াবে ঢালিউড? আদৌ পারবে? শূটিং ফ্লোরে রাত দিন কাটত যাদের তারা আজ কী করছেন? কী-ই বা ভাবছেন? জানা যাক তাদের কয়েক জনের মনের কথা। এই অনিশ্চয়তা চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখে ফেলে দেবে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে, মনে করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এটার ধকল প্রকৃতপক্ষে থাকবে দীর্ঘদিন। চলচ্চিত্রের মতো একটা মাত্র ইন্ডাস্ট্রি যেটার ধকল পোহাতে হবে দীর্ঘদিন। আমরা জানি করোনার উৎপত্তি হচ্ছে জনসমাগম থেকে। দেখেন একদম খেটে খাওয়া মানুষ সবাই জানে যে করোনা ছোঁয়াচে। আমাদের সিনেমা হলে যারা সিনেমা দেখতে যাবে ওদের মনে কিন্তু একটা আতঙ্ক ঢুকে গেছে। সবার মাঝে এখন করোনা আতঙ্ক আছে। আমি জানিনা সিনেমায় কতকাল আমরা এটা বহন করব। সব কিছু হয়ত একদিন কাটিয়ে ওঠা যাবে কিন্তু আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এটা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। এখন আমাদের চলচ্চিত্রের কিন্তু কোন কর্পোরেট ফাইন্যান্স নেই। চলচ্চিত্র এখন নির্মাণ করে দুই শ্রেণীর মানুষ। এক শ্রেণী হচ্ছে তাদের বিভিন্ন ব্যবসা আছে। হয়তবা এর ফাঁকে একটা দুইটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করল। এটা সখের বসে। আর কিছু ছেলে-পেলে যারা এটার ওপর পড়াশোনা করেছে। ইয়াং জেনারেশন। এরা খুব ডেডিকেটেড। পড়াশোনা শেষ করে চলচ্চিত্রের এই খরার মধ্যে হয়তবা কোন কাজ পাচ্ছে না। তখন তারা নিজে কারো কাছ থেকে লোন নিয়ে, বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, নিজে অন্য একটা কাজ করে সেখান থেকে অর্থ জমিয়ে এইভাবে কিছু ডিরেক্টর প্রডিউসার চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে। দেখা যায় সেগুলো জীবন ভিত্তিক চলচ্চিত্র। এই লোকগুলো বেশি ছাপার করবে। কয়েক দিনে আগে ফকরুল আরেফিনের ‘বন্দি’ গেল, সামনে গাজী রাকায়েতের ‘গোর’, খুবই আলোচিত চলচ্চিত্র ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। এর মধ্যে বড় বড় চলচ্চিত্রও আছে। আমাদের আলোচিত চলচ্চিত্র হচ্ছে ‘দিন দ্য ডে’। যেটা অনন্ত জলিল সাহেবের ইরান এবং বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চার। যেটার বাজেট একশ কোটি টাকার উপরে। এই চলচ্চিত্র তারা রিলিজ করার একটা প্রিপারেশন নিচ্ছিল। ‘বিদ্রোহী’ নামের একটা চলচ্চিত্র। এটা শাপলা মিডিয়ার এটাও অনেক বিগ বাজেটের। এবার ঈদে একটা প্রস্তুতি ছিল। ‘ঢাকা এ্যাটাক’ খ্যাত পরিচালকের ‘মিশন এক্সট্রিম’ ছিল। স্কয়ারের অঞ্জন চৌধুরীর ‘বিশ্ব সুন্দরী’, মুক্তিযুদ্ধের একটা চলচ্চিত্র ছিল বীরাঙ্গনা নিয়ে। সব কিছু মিলিয়ে এই ছবিগুলো যে রিলিজ হলো না। হলের দিকে যদি যাই, চল্লিশ পঞ্চাশটা হল ফেস্টিভেলকে টার্গেট করে সিনেমা হল খুলত। নববর্ষে সিনেমা হলের একটা অন্যতম ফেস্টিভ্যাল ছিল। আমাদের সামনে ঈদ। কারণ রমজান মাসে কোন ছবি রিলিজ হয় না। ঈদ একটা বড় ফেস্টিভ্যাল। আমরা বলতেও পারি না এ ভয়াবহ পরিস্থিতি কবে শেষ হবে। এটা যে কতদূর যাবে, আর কবেইবা আমরা সিনেমা হল খুলব, ঘরে বসে আমাদের ঈদ পালন করতে হবে কিনা। সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে, এটা কেটে উঠবে। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রের এই ধকল কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে। সেই যাবৎ পর্যন্ত চলচ্চিত্র আসলে টিকে থাকবে কিনা সেটা একটা বিষয়। এবং এটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে এই সেক্টরে হল মালিকদের, প্রডিউসারদের প্রণোদনা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা নাহলে এ ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকবে না। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমার চিন্তাধারাতে আমি মনে করি চলচ্চিত্রের অবস্থা প্রচ- রকমের খারাপের দিকে যাবে। ভাল হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেছেন হয়তো সাময়িকভাবে আমরা কেটে উঠতে পারব কিন্তু তিন বছরের মতো এর ধাক্কা থাকবে। সার্বিকভাবে যদি সারাদেশে তিন বছর এই ধাক্কা থাকে তাহলে আমাদের চলচ্চিত্রের কি হবে বোঝাই যাচ্ছে। আমাদের চলচ্চিত্রের কিছুই ছিল না, কিছু নাইও। যে সিনেমাগুলো রিলিজের কথা ছিল সেগুলোও বন্ধ। এখন বন্ধের পরে সিনেমা হলগুলোর অবস্থা কি দাঁড়ায় এটা বোঝা মুশকিল। এটা কিন্তু ভাবনার বিষয়। এতদিন পর্যন্ত সিনেমা হলের প্রজেক্টর বন্ধ থাকলে অনেক সময় টেকনিক্যাল জিনিস নষ্টও হয়ে যায়। তারপরে ছবির ব্যাপার আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এই দুর্দিনে সিনেমা হলের মালিকরা নতুন করে এইগুলো করতেও পারবে না। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছে একটা প্রাথমিক অনুদান চাই। সাহায্য চাই প্রত্যেক সিনেমা হলের একটা লিস্ট থাকবে ডিসি সাহেবের কাছে। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় কয়টা সিনেমা হল আছে চলে কয়টা? সেই লিস্ট নিয়ে সরকার যদি কিছুটা সহযোগিতা করে তাহলে সাময়িকভাবে কিছুটা হলেও উপকৃত হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে এটা আমাদের দাবি সরকারের কাছে তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যেসব শিল্পী দিন আনে দিন খায় তারা অনেক কষ্টে আছে। প্রডাকশন বয়, প্রডাকশন ম্যানেজার এদেরও একই অবস্থা। সব দিক বিবেচনা করে চলচ্চিত্রের দিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এদিকে যে ছবিগুলো ইতোমধ্যে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল করোনার কারণে সেগুলোর মুক্তি স্থগিত করায় সেগুলোও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে জানান চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দিন। তার কথায় কোন ছবি নির্দিষ্ট সময় মুক্তি না পেলে নানা কারণে ছবিটির মেরিট নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এটি লোকসানের কবলে পড়ে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক জায়েদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, যখন একটা দিকে দুর্যোগ শুরু হয় তখন কিন্তু সবদিক থেকেই শুরু হয়। দেশের অর্থনৈতিক দিক যখন বাধাগ্রস্ত হয় তখন ছোট ছোট অংশ যেমন সিনেমা, নাটক, গান, খেলাধুলা বা বিভিন্ন শিল্প সব কিছুতেই আঘাত লাগে।
×