ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে নিরাপদ দূরত্ব মানা হচ্ছে না, অকারণে ঘোরাঘুরি

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ৩০ এপ্রিল ২০২০

রাজধানীতে নিরাপদ দূরত্ব মানা হচ্ছে না, অকারণে ঘোরাঘুরি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে অন্যতম প্রবেশপথ আব্দুল্লাহপুর পয়েন্ট। বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ঢাকায় প্রবেশে এই রুট ব্যবহার করেন। শহরের অন্যান্য সড়ক কম বেশি ফাঁকা হলেও আব্দুল্লাহপুর এলাকা দেখে মনে হওয়ার কোন কারণ নেই দেশজুড়ে কার্যত লকডাউন চলছে। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর মতো কোন প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রকোপ রয়েছে। কারণ এই পয়েন্টে রাতদিন পুলিশকে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে! হ্যাঁ। এটা সত্যি। পরিস্থিতি ঠিক এরকম চলছে কয়েক দিন। রাজধানীতে প্রবেশ ও বের হওয়ার বন্ধের ঘোষণার পর থেকে নগরীর প্রবেশপথগুলোতে বসানো হয়েছে পুলিশের নিরাপত্তা চৌকি। চেকপোস্টে প্রতিটি গাড়ি তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছাড়া হচ্ছে। কোন অসঙ্গতি পাওয়া গেলে যানবাহনের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে মামলা। কিন্তু জেল জরিমানাতেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না মানুষের বিনা কারণে চলাচল। পুলিশ বলছে, নগরীর প্রবেশপথগুলোর চেকপোস্টে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা গেছে, অন্তত ৬০ ভাগ মানুষ বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। বিশেষ করে প্রাইভেটকারে ঘোরাফেরার সংখ্যা বেশি। জিজ্ঞাসাবাদে বেশিরভাগ লোকজন সহজ উত্তর দেন ব্যাংকে অথবা হাসপাতালে যাব, রোগী আছে। আবার অনেকে অকপটে সত্যটা স্বীকার করে বলেন, ঘরে থাকতে থাকতে একেবারেই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই একটু বের হয়েছি। নগরীর যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ এলাকা অনেক বেশি জনবহুল। যাত্রাবাড়ী ছাড়িয়ে শনির আখড়ার দিকে গেলেই মনে হবে দেশে কোন করোনা আক্রান্তের খবর নেই, নেই মৃত্যুর মতো কোন দুঃসংবাদ। কারণ রাস্তায় রাস্তায় রীতিমতো মানুষের ঢল। বাজার স্বাভাবিক। গমগম করছে মানুষ। চলছে চাপানের দোকান। সবকিছু যেন আগের মতোই। নগরীর ভেতরে এরকম দৃশ্য যে কাউকে বিস্মিত করবে। অথচ সারাদেশে এখন পর্যন্ত নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সাত হাজার ১০৩ জনের মধ্যে প্রায় ৮৪ ভাগই ঢাকার। এরপর গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও ময়মনসিংহ। রাজধানীর ১৫৮টি এলাকায় পাওয়া গেছে করোনার রোগী। বিপজ্জনক এলাকার সংখ্যা ৩২টি। দিন দিন এসব এলাকায় বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে মহাবিপজ্জনক এরিয়া রাজারবাগ। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগই হলো ঢাকার। সব মিলিয়ে করোনার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা ঢাকা মহানগরী। তবুও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। অন্যথায় দিন দিন রাস্তায় মানুষের সংখ্যা বাড়বে। সরকারী ঘোষণা ছাড়াই সব কিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করবে। ফলে বাড়বে বিপদ। আক্রান্ত ও মৃত্যু হার লাফিয়ে বাড়ার আশঙ্কা থাকবে এমন পরিস্থিতিতে। রাজধানীসহ সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় নতুন করে আরও ৬৪১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর এটিই একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মোট ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত সারাদেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫৯ হাজার ৭০১ জনের। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দেশে মোট আক্রান্তের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আক্রান্ত ও মৃতের অর্ধেকেরও বেশি রোগী ঢাকার বাসিন্দা। গত সোম ও মঙ্গলবার মারা যাওয়া ১২ জনের ৯ জনই ঢাকার। বুধবার যে আটজনের মৃত্যু হয়েছে এর মধ্যে ছয় জনই ঢাকার বাসিন্দা। এই পরিসংখ্যানই সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু রাস্তার চিত্র তা বলছে না। রাজধানী ঢাকায় আক্রান্ত ও মৃতের হিসেবে শীর্ষে থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহা বেশি! এ বিষয়ে চরম উদাসীনতাও লক্ষ্য করা গেছে অনেকের মধ্যে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদরা বার বার বলছেন, জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘরে অবস্থান করতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক, গ্লাভস এবং নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ সেরে দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বুধবার রাজধানীর খিলগাঁও, আব্দুল্লাহপুর, বনানী, তেজগাঁও, বাসাবো, কমলাপুর, রাজারবাগ, লালবাগ, মালিবাগ, শাহবাগ, কাকরাইল, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের চেয়ে রাস্তাঘাটে যানবাহন ও মানুষের উপস্থিতি অনেক বেশি। রোজার অজুহাতে ফুটপাতসহ বিভিন্ন স্থানে খাবারসহ দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। পুরান ঢাকার বিভিন্ন রাস্তাঘাটে বাজার ও ওষুধ কেনার অজুহাতে অপেক্ষাকৃত তরুণরা অবাধে ঘোরাফেরা করছেন। কোথাও কোথাও শারীরিক দূরত্ব তো অনেক দূরের কথা গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছেন। অবস্থাদৃষ্টে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন তারা। চায়ের দোকানে চলছে আড্ডা। ফুটপাথের দোকানগুলো ছোট্ট পরিসরে খোলা হচ্ছে। বেড়েছে ফ্লাক্সে করে চা, সিগারেট বিক্রি। টিএজ ছেলেদের মোটারসাইকেল নিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলার দৃশ্য দেখা যায় অহরহ। খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, রাস্তায় রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কমেছে। তাই মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে সড়কে ভিড় করতে শুরু করেছেন। এটা বন্ধ করা জরুরী। মালিবাগ রেল গেইট বাজারে মানুষের যেন উপচেপড়া ভিড়। আবুজর গিফারী কলেজ সড়কের বাসিন্দা ফরিদ মিয়া জানান, বাজার না করেই বাসায় ফিরছি। মানুষের ভিড়ের কারণে নিরাপদ দূরত্বে বাজার করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া অকারণে রাস্তায় রাস্তায় মানুষ হাঁটাচলা করছেন। রাজধানীর কাকরাইল এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, কিছুদিন আগে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের জোরদার টহল দেখলেও এখন আর তাদের দেখা যাচ্ছে না। সরকারীভাবেও তো কোন ঘোষণা আসেনি। ফলে রাস্তাঘাটে যানবাহন ও মানুষের চলাচল বেড়েছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে বের হতে দিলেও একটা নিয়ম ও কঠোর নজরদারির মধ্যে চলাফেরার সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় রাজধানীতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। নগরীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে চলে রাত দিনের আড্ডা। ত্রাণ বিতরণের নামে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ত্রাণ বিতরণ যেমন চলছে তেমনি টিসিবি পণ্য কেনাতেও সুরক্ষার বালাই নেই। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সরব হতে শুরু করেছে পাড়া মহল্লার ক্লাবগুলোও। রাজধানীর ৩২ বিপজ্জনক এলাকা ॥ ঢাকার প্রায় ১৬০ পয়েন্টে পাওয়া গেছে করোনায় আক্রান্ত রোগী। এই হিসেবে পুরো ঢাকাই কোভিড-১৯ এর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩২টি এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, বংশাল (৪৯), বাসাবো (২৮), চাঁনখারপুল (২৭), বাড্ডা (২২), চকবাজার (৩২), ধানম-ি (৩৭), গে-ারিয়া (৩২), গুলশান (২৪), হাজারীবাগ (২৭), যাত্রাবাড়ী (৭০), জুরাইন (২২), কাকরাইল (৪৭), খিলগাঁও (২৬), লালবাগ (৬৭), মালিবাগ (৩০), মিরপুর-১ (২৯), মিরপুর-১১ (২৮), মিরপুর-১৪ (৩৭), মিটফোর্ড (৩৮), মগবাজার (৩৫), মহাখালী (৫৪), মোহাম্মদপুর (৬১), মুগদা (৪৩), রাজারবাগ (১১৯), রামপুরা (১৬), শাহবাগ (৩৬), শেখের বাজার (২৮), স্বামীবাগ (৩১), তেজগাঁও (৪৪), টোলারবাগ (১৯), উত্তরা (৪৬) ও ওয়ারীতে (৩৭) জন।
×