ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অবস্থানের খবর জানিয়ে দেয় মাজেদই

মোসলেম ছয় দেশ ঘুরে ভারতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে

প্রকাশিত: ২২:৩২, ২৯ এপ্রিল ২০২০

মোসলেম ছয় দেশ ঘুরে ভারতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে

শংকর কুমার দে ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকা-ের মৃত্যুদ-প্রাপ্ত খুনী রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিন খান ভারতে আসার আগে অন্তত আরও ছয়টি দেশ ঘুরে, রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে, আত্মগোপন করে থাকার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ভারতে এসে লুকিয়ে ছিল। ভারতে আত্মগোপন করে থাকাটা হচ্ছে তার ছয় নম্বরের পর সপ্তম নম্বর রাষ্ট্র। ভারতের কলকাতায় আত্মগোপন করে থাকার পর ঢাকায় ধরা পড়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদই ভারতের এসে আত্মগোপন করে থাকার জন্য সর্বশেষ আশ্রয় দেয় রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিনকে। অবশেষে যখন কলকাতায় গোয়েন্দা জালে আটকা পড়ে তখন সেই মাজেদই আবার জিজ্ঞাসাবাদে রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিনের আত্মগোপন করে থাকার তথ্য ফাঁস করে দেয়। খুনী মোসলেম উদ্দিন খান সম্পর্কে অনুসন্ধানে, তদন্তে এমন তথ্য পেয়েছে বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ঢাকার ধানম-ির ৩২ নং রোডের বাড়িতে বিপথগামী একদল সেনা সদস্য যখন আক্রমণ করে তখন গুলির শব্দ শুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বিষয়টি জানার জন্য নিচে নামছিলেন সেই সময় সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে এই মোসলেমউদ্দিন খান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মোসলেম উদ্দিন বঙ্গভবনের হত্যাকা-ের অন্যতম রূপকার হিসাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পান রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমাদের। সাবেক সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ইরানের তেহরান ও সৌদি আরবের জেদ্দা দূতাবাসে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান মোসলেমউদ্দিনকে। সে তার দেশে যাতায়াত ছিল। ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অন্য খুনীদের সঙ্গে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় মোসলেমউদ্দিন। সে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় প্রথমে থাইল্যান্ডে। এরপর যায় পাকিস্তানে। এই দুই দেশে প্রথমে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ও পরে আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করে সে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে তখন মোসলেমউদ্দিন বুঝতে পারে যে, আর কোনভাবেই বাংলাদেশে যাওয়া সম্ভবপর নয় তখন সে ইরান ও সৌদি আরবেও রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানে যখন আত্মগোপন ও রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের জন্য ব্যর্থ হয় তখন চেষ্টা চালিয়ে যায়। বাংলাদেশ দেশ ছেড়ে প্রথমে থাইল্যান্ড ও পরবর্তীতে পাকিস্তানে পালিয়ে থাকতে না পেরে ফিরে আসে জার্মানিতে। জার্মানিতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের চেষ্টা করে মোসলেমউদ্দিন। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ইরান, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপন করাটা ছিল মোসলেমউদ্দিনের জন্য বিপজ্জনক। ওই সব দেশের মানুষজনের চাল-চলন, ভাষা, সংস্কৃতি সব কিছু মিলিয়ে একজন বাঙালীর জন্য বেশি দিন আত্মগোপনে থাকাটা সম্ভবপর নয়। এরপরই ভারতে আত্মগোপনে থাকা খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আরেক খুনী রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেমউদ্দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- প্রাপ্ত যে ৬ আসামি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক ছিল, তাদের মধ্যে তারা হলো খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী ও এ এম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও মোসলেমউদ্দিন। পলাতক ওই ৬ খুনীর মধ্যে আবদুল মাজেদ ছিল ভারতে। ভারতে আত্মগোপনে থাকা আবদুল মাজেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মোসলেমউদ্দিন। মাজেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মোসলেমউদ্দিন ভারতে আসার পর তারা দুজনেই কলকাতার তালতলা এলাকায় আত্মগোপনে ছিল বলে তদন্ত পরিচালনকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, ফাঁসিতে ঝোলানো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আরেক ঘাতক ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদকে কলকাতার পার্কস্ট্রিট এলাকা থেকে আটকের পর জেরা করেই জানা যায় আরেক খুনী মোসলেমউদ্দিনের আস্তানার খবর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও জেলার ঠাকুরনগর এলাকার চাঁদপাড়ায় যে খুনী মোসলেমউদ্দিন আত্মগোপন করে আছে সেই খবরটিও দেয় আরেক খুনী আবদুল মাজেদ। অথচ যেই খুনী আবদুল মাজেদ একদিন তার সহযোগী খুনী মোসলেমউদ্দিনকে ভারতে আত্মগোপনে থাকতে সহযোগিতা করেছিল, সেই খুনী মাজেদই ধরা পড়ে জেরার মুখে ধরিয়ে দিল তার সহযোগী খুনী মোসলেমউদ্দিনকে। মাজেদের তথ্যের ভিত্তিতে উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি আধাশহর থেকে খুনী মোসলেমউদ্দিনকে ধরে একটি গোপন জায়গায় জেরা শুরু করেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। ভারতীয় গোয়েন্দাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে খুনী মোসলেমউদ্দিন খানের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশী গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
×