ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-ব্রিটেনে ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ

সেপ্টেম্বরেই বাজারে আসতে পারে করোনার টিকা

প্রকাশিত: ২২:৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২০

সেপ্টেম্বরেই বাজারে আসতে পারে করোনার টিকা

কাওসার রহমান ॥ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মার্কিন ওষুধ ব্যর্থ হলেও চীন-ব্রিটেনে শুরু হয়েছে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগও। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বরেই বাজারে আসতে পারে করোনা চিকিৎসার এই টিকা। মহামারী সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯ ভাইরাস যখন বিশ্ব জুড়ে হু হু করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তখনই নিজের দল নিয়ে প্রতিষেধক তৈরির গবেষণা শুরু করেন প্রতিষেধক-বিশেষজ্ঞ সারা গিলবার্ট। প্রায় সমসাময়িক সময় থেকেই লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজেও এক দল গবেষক শুরু করেন গবেষণা। বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজ প্রায় শেষের দিকে। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের দাবি, তাদের উদ্ভাবিত টিকা মানবশরীরে প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ইম্পিরিয়াল কলেজে এই প্রয়োগ শুরু হতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। যে কোন ধরনের টিকা তৈরি করে তা মানবদেহে প্রয়োগের জন্য সাধারণত কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি করা করোনাভাইরাসের টিকা। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে চীনে করোনাভাইরাসের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বের হওয়ার কিছুদিন পর জানুয়ারি মাসেই অক্সফোর্ডের কিছু বিজ্ঞানী নেমে পড়েন করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক খোঁজার কাজে। মাত্র চার মাসেরও কম সময়ে টিকা তৈরির কাজ শেষ করে ইতোমধ্যে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগও করা হয়েছে। যা কি না বিশ্ব রেকর্ড! বিজ্ঞানীরা এই টিকার নাম দিয়েছেন চ্যাডকস১ এনকোভ-১৯। এর আগে এত কম সময়ে কোন টিকা তৈরির পর তা মানবদেহে প্রয়োগের ঘটনা ঘটেনি। এই ধরনের একটি টিকা তৈরি করতে গেলে কখনও কখনও কয়েক বছর থেকে শুরু করে যুগ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। কিন্তু এই প্রকল্পের প্রধান ড. সারাহ গিলবার্ট জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলক ব্যবহারে আশান্বিত ফল মিললে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বাজারে পাওয়া যাবে এই টিকা। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারে এগিয়ে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেখানে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে কয়েক শ’ ব্যক্তির ওপর, সেখানে অক্সফোর্ডের এই প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৬ হাজার মানুষের ওপর। পরীক্ষার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে সবচেয়ে আগে। তাছাড়া এই প্রতিষেধক শুধু যে করোনার প্রতিরোধের নিরিখে দেখা হবে তাই নয়, মানবদেহে কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি না, তাও দেখবেন বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষায় সফল হলে সেপ্টেম্বরেই এসে যেতে পারে করোনার প্রতিষেধক। আপাতত সেই আশাতেই অক্সফোর্ডের গবেষক দলের দিকে তাকিয়ে ব্রিটেনসহ গোটা বিশ্ব। করোনার প্রথম ওষুধ ব্যর্থ? বর্তমানে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য সারাবিশ্বে এক শ’র বেশি প্রজেক্টে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। কয়েকটি প্রতিষেধকের ক্লিনিকাল ট্রায়ালও শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে করোনা প্রতিরোধের একই পরীক্ষা শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। কিন্তু সেই ওষুধ ব্যর্থ হয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (হু) ওয়েবসাইটে প্রকাশ হতেই বিশ্ব জুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র চাঞ্চল্য। পরে অবশ্য ওই হু-র ওয়েবসাইট থেকে ওই তথ্য তুলে নেয়া হয়েছে। যদিও ওষুধ প্রস্তুতকারী মার্কিন সংস্থা ‘জিলিয়াড সায়েন্সেস’-এর দাবি, ভুলবশত প্রকাশ্যে আসা এবং ডিলিট করে দেয়া কোন ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়। বরং এই ওষুধের কিছু সুফল পাওয়া গেছে। হু-এর ওয়েবসাইটে জিলিয়াড সায়েন্সেস-এর তৈরি করা এ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ‘রেমডেসিভির’ সম্পর্কে একটি রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই খবরটি প্রথম প্রকাশ্যে আনে ব্রিটিশ দৈনিক ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’। হু-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই রিপোর্টের স্ক্রিন শট দিয়ে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, জিলিয়াডের সম্ভাব্য করোনাভাইরাসের টিকা ব্যর্থ হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিলিয়াডের তৈরি ওষুধ ‘রেমডেসিভির’ চীনের ২৩৭ জন রোগীর ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। তার মধ্যে ১৫৮ জনকে সরাসরি ওষুধ দেয়া হয়েছিল এবং ৭৯ জনকে একটি নিয়ন্ত্রিত দলে রেখে প্রয়োগ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এই ৭৯ জনকে দু’তিনটি দলে ভাগ করে একটি দলকে রেমডেসিভির এবং অন্য দলগুলোকে প্রচিলত ওষুধ দিয়ে বা কোন ওষুধ না দিয়ে পার্থক্য বোঝার চেষ্টা হয়েছিল। এক মাস পর দেখা যায়, নতুন ওষুধ দেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি। মৃত্যুর হার ১২.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩.৯ শতাংশ হয়ে যায়। এ ছাড়া ১৮ জন রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় তাদের ওষুধ প্রয়োগ করা বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই কারণেই এই টিকা ব্যর্থ বলে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। তবে হু-এর পক্ষ থেকে ফিনান্সিয়াল টাইমসকে জানানো হয়েছে, ভুল করে ওই খসড়া রিপোর্ট প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। রিপোর্টটি বিস্তারিত রিভিউ করা হয়নি। অবশ্য রেমডেসিভির ব্যর্থ হয়েছে এই দাবি মানতে নারাজ প্রস্তুতকারী সংস্থা জিলিয়াড সায়েন্সেসও। সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘আমরা মনে করি ওই খসড়া রিপোর্টে ওষুধ প্রয়োগ থেকে উঠে আসা তথ্যের যথার্থ বিশ্লেষণ করা হয়নি। ওষুধ বন্ধ করা হয়েছিল কারণ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক নমুনা (এক্ষেত্রে মানুষ) পাওয়া যায়নি। তাই এই ওষুধ প্রয়োগ থেকে পাওয়া তথ্য অসম্পূর্ণ এবং পরিসংখ্যানগতভাবে অর্থহীন।’ সংস্থার পক্ষ থেকে আরও দাবি করা হয়েছে, রেমডেসিভির সম্পর্কে ওই তথ্যই শেষ কথা নয়। আরও বড় আকারে ওষুধের প্রয়োগ চলছে এবং শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সেই তথ্য থেকে খুব শীঘ্রই স্পষ্ট ছবিটা পাওয়া যাবে। করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় রেমডেসিভিরই প্রথম প্রতিষেধক হিসেবে মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। এই রেমডেসিভির দেয়া হয়েছিল ইন্ট্রাভেনাস পদ্ধতিতে। এই ওষুধের পরীক্ষা গোটা বিশ্বেই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আশা জাগিয়েছিল। সেই আশাতেই সিপলা, গ্লেনমার্ক, ডক্টর রেড্ডির মতো ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো এই ওষুধ তৈরির জন্য প্রাথমিক প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে এই খবরে সেই সব সংস্থার উদ্যোগেও প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে গেল। অক্সফোর্ড ও ইম্পিরিয়ালে পাশাপাশি গবেষণা ॥ কোভিড-১৯ ভাইরাসকে ধ্বংস করতে টিকা আবিষ্কারের কাজ করছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় ভায়রোলজিস্টরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব গবেষণাই কমবেশি এগচ্ছে। তবে ব্রিটেনের দুই গবেষণা বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে মানবশরীরে প্রয়োগও। এদের মধ্যে এক দল গবেষক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, সারা গিলবার্টের নেতৃত্বে। অপর দল কাজ করছেন লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের ল্যাবরেটরিতে। বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজ প্রায় শেষের দিকে। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের দাবি, তাদের উদ্ভাবিত টিকা মানবশরীরে প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ইম্পিরিয়াল কলেজে এই প্রয়োগ শুরু হতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। তবে এই দুই কলেজে আবিষ্কৃত টিকার মধ্যে কিছু তফাত আছে। দু’টি গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরাই মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে কোভিড-১৯ ভাইরাসের স্পাইকের প্রতিরূপ তৈরি করতে সফল হয়েছেন। কিন্তু তৈরির পদ্ধতি আলাদা আলাদা। কোথায় আলাদা? ইম্পিরিয়াল কলেজের গবেষকরা কোভিড-১৯-এর রাইবো নিউক্লিক এসিড অর্থাৎ আরএনএ থেকে এমন এক জেনেটিক উপাদান তৈরি করেছেন, যা ইঞ্জেকশনের সাহায্যে মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে কোষের মধ্যে কোভিডের শরীরে থাকা স্পাইক প্রোটিনের অনুরূপ স্পাইক প্রোটিন সৃষ্টি করবে। এই অনুরূপ স্পাইক প্রোটিনটির বৈশিষ্ট্য কোভিডের মতো হবে না। বরং কোভিডের কাজকর্মকে এ বাধা দেবে। এটিই তাকে প্রতি পদে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের দল আরএনএ সংগ্রহের পথে হাঁটেননি। বরং তারা করোনাভাইরাসের মতো সমআকৃতির এক কৃত্রিম ভাইরাস তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। এর বাইরের অংশেও করোনার মতোই স্পাইক প্রোটিন আছে। শিম্পাঞ্জির শরীর থেকে পাওয়া সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশির এ্যাডিনোভাইরাসকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কোভিডের সমআকৃতির কৃত্রিম ভাইরাসে পরিণত করে গবেষণা এগিয়েছেন তারা। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত টিকার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এটির সাহায্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের শরীরেও ইমিউনিটি তৈরি করা সম্ভব। তৈরিতে পার্থক্য থাকলেও মানুষের শরীরে এই দুই দলের গবেষকদের তৈরি করা প্রতিষেধক কাজ করবে একইভাবে। এই দুই ধরনের টিকাই মানুষের শরীরে নতুন করে কোন রকম সংক্রমণ ঘটাবে না, বরং কিছু বিশেষ এ্যান্টিবডি তৈরি করবে, যা এই করোনার প্রোটিন স্পাইককে ধ্বংস করতে পারে। অক্সফোর্ড ও ইম্পিরিয়াল দুটি গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরাই এখন পর্যবেক্ষণ করতে চান কীভাবে এই টিকা মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। অক্সফোর্ডের টিকা মানবশরীরে প্রয়োগের পর এদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যদি কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়, তা হলে অল্পসংখ্যক মানুষের ওপর ট্রায়াল করিয়ে মাস ছয়েকের মধ্যেই এর কার্যকারিতা সম্পূর্ণ জানতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। ইম্পিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রায়ালের ফল পাওয়া যাবে এই বছরের শেষের দিকে। কলকাতার এক বেসরকারী হাসপাতালের পালমোনলজিস্ট অশোক সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন ইম্পিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার মতে, পরীক্ষামূলকভাবে নতুন কোন টিকা প্রয়োগ করার পর তার কার্যক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে মোটামুটি মাস তিনেক সময় লাগে। মানুষের শরীরে নতুন টিকা দেয়ার পর কোনবিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না অনবরত লক্ষ্য রাখতে হয়। লাভ-ক্ষতির তুল্যমূল্য হিসেবে যদি লাভের পাল্লা ভারি হয়, তখনই ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। স্বাভাবিক নিয়মে ৬ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে ভ্যাকসিন নিয়ে ট্রায়াল দেয়া হয়। বারে বারে চরিত্র পরিবর্তন করতে থাকা কোভিড-১৯ ভাইরাসের এই টিকা কি আমাদের দেশেও সমান কার্যকর হবে? ভায়রোলজিস্টরা বলছেন, কোন টিকা সারাবিশ্বে সমান কার্যকর হয় না। উনিশ-বিশ থাকেই। সামান্য রদবদল ঘটানোরও অবকাশ থাকে। তবে টিকা দ্রুত হাতে এলে তবেই বোঝা যাবে আমাদের দেশে তা কতটা কার্যকর হবে। সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে দেশের ভায়রোলজিস্টরা তখন তৎপর হবেন। যদি টিকাটির কোন পরিবর্তন করার দরকার হয়, তবে তারা তা সেরে ফেললেই আমাদের দেশেও টিকা কার্যকরী ভূমিকা নেবে।
×