ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৪৯ বছরে ৪৭৯ ফাঁসি কার্যকর

প্রকাশিত: ২২:৩০, ২৯ এপ্রিল ২০২০

৪৯ বছরে ৪৭৯ ফাঁসি কার্যকর

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিগত ৪৯ বছরে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৪৭৯ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সর্বশেষ ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকা-ের আত্মস্বীকৃত খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের। কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগার স্থাপিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর খুনীর ফাঁসি রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে এই প্রথম ফাঁসি রায় কার্যকরের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর আগে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার, গাজীপুরের কাশিমপুরের কারাগারে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতকারী মানবতা বিরোধী অপরাধের আসামি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনী, বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীদেরসহ চাঞ্চল্যকর মামলার আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদ- হিসেবে ফাঁসির বিধান কার্যকর রয়েছে। খুন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহসহ গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হলে আদালতের বিভিন্ন ধাপ গড়িয়ে অপরাধীকে ঝুলানো হয় ফাঁসির রশিতে। হত্যা, ধর্ষণের পর খুন, মানবতাবিরোধী অপরাধ, রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আইনে মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে। নি¤œ আদালতের পর হাইকোর্ট বা আপীল বিভাগেও এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে বা ধারাবাহিকভাবে ওই সর্বোচ্চ দ- অব্যাহত থাকলে অপরাধী ফাঁসির মুখোমুখি হয়। এরপর অপরাধীর রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা না করলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারাকর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁসি কার্যকরের আদেশ পৌঁছালে আইনানুগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনের আসামি মৃত্যুদ- প্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে পাঁচ আসামির ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ফাঁসি কার্যকর হয়। তারা হলোÑ সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মুহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ। মৃত্যু-প্রাপ্ত অন্য ছয় আসামি পলাতক ছিল। এর মধ্যে আবদুল মাজেদকে ফাঁসিতে ঝুলানো হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, দেশান্তর ও ধর্মান্তরসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ- পাওয়া মোট ৬ জন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ৭টি রায়ের মধ্যে ৬টিতে জামায়াতে ইসলামীর দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ২০০৬ সালে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসির পর থেকে শুরু করে গতকাল বুধবার শীর্ষ জঙ্গী নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও তার দুই সহযোগীসহ এ পর্যন্ত ১০ জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ২০০৬ সালের ২৯ মার্চ মধ্যরাতে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানের ছোট ভাই আতাউর রহমান সানি, মেয়ের জামাই আবদুল আউয়াল, বোমা হামলাকারী ইফতেখার হোসেন মামুন ও খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুক। একই মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর। এছাড়া কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি ও সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ তিন জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেট হযরত শাহজালাল (রা) এর মাজারে বাংলাদেশের সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বহুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলার রায়ে তৎকালীন ৫ পুলিশ সদস্যকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। তৎকালীন ৮ দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার একটি বড় ধরনের টার্গেট ছিল বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পান। ঘটনাস্থল এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাণ হারান ২৪ আওয়ামী লীগ কর্মী। আদালত প্রাঙ্গণের পাদদেশে যাদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়ে আছে। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় মৃত্যুদ-ে দ-িতরা হলো সিএমপির কোতোয়ালি থানার তৎকালীন পেট্রোল ইন্সপেক্টর (পিআই) জেসি ম-ল (পলাতক), কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মোঃ আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। মামলায় চার্জশীটেড ছিলেন ৮ আসামি। ইতোমধ্যে বিচার চলাকালীন তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কনস্টেবল বশির উদ্দিন ও আবদুস ছালাম মারা গেছেন। মামলার বাদী এ্যাডভোকেট শহীদুল হুদাও প্রয়াত। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদসহ দলটির পাঁচ নেতাকে হত্যার দায়ে তিন আসামির মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হওয়া তিনজন হলেনÑ কুষ্টিয়ার মিরপুরের রাজনগর গ্রামের হাবিবুর রহমান। ১৯৯৪ সালে পাবনার ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার ট্রেনে গুলির মামলায় ২০১৮ সালে ৯ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ মামলার ৫২ আসামির মধ্যে জীবিত আছেন ৪৭ জন। যাদের মধ্যে কারাগারে থাকা ৩২ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। ফাঁসির দ-প্রাপ্তরা হলেনÑ এ কে এম আক্তারুজ্জামান, মোঃ জাকারিয়া পিন্টু, মোখলেছুর রহমান বাবলু, রেজাউল করিম শাহীন, শহীদুল ইসলাম অটল, আজিজুর রহমান ফড়িং, শ্যামল, মাহাবুবুর রহমান পলাশ ও শামসুল আলম। এদের মধ্যে ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু পলাতক রয়েছেন। বাকি পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে ফাঁসির রশিতে ঝুলেছে বহু রাজনীতিবিদ, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ গুরুতর অপরাধী। এরশাদ সিকদারসহ বহু ফাঁসি বিভিন্ন সময় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। নানা অপরাধে ১৯৭১ সাল থেকে গত ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৯ বছরে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ফাঁসির রশিতে ঝুলেছে ৪৭৯ জন। গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ২০১৬ সালে। সে সময় ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ১০ জনের। প্রায় প্রতিবছর কোন না কোন কারাগারে এক বা একাধিক মৃত্যু-প্রাপ্ত আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়ে আসছে।
×