ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আর্থিক সঙ্কটে ২৪ হাজার সমবায়ী প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ২১:২৫, ৩০ এপ্রিল ২০২০

আর্থিক সঙ্কটে ২৪ হাজার সমবায়ী প্রতিষ্ঠান

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ করোনাভাইরাসের প্রভাবে চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে দেশের প্রায় ২৪ হাজার সমবায়ী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ছুটির কবলে এসব সমবায় প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ঋণ আদায় ও সঞ্চয় কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে মাঠ পর্যায়ে ঋণ বিতরণ করা সাধারণের সঞ্চয়ের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রায় ৯ লক্ষাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অস্তিত্ব রক্ষার্থে এনজিও ঋণের মতো সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারের সাবেক সচিব ও সমবায় অধিদপ্তরের সাবেক নিবন্ধক মোঃ হুমায়ুন খালিদ জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের মতো আমরাও মহাসঙ্কটে পড়তে যাচ্ছি। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সঙ্কট শুরু হয়েছে। সামনে খাদ্য সঙ্কটের মুখে পরার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় লক্ষাধিক সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে হবে। মিল্কভিটার মতো বিভিন্ন সমবায়ী প্রতিষ্ঠান যারা সরাসরি আয় উৎসারি কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যাতে এসব কাজে বাধা না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে এনজিওদের মতো সরাসরি ঋণকার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৪ হাজার সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের প্রণোদনার অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ চলমান পরিস্থিতিতে যারা বর্তমান ঋণ নিয়েছেন, আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। তাদের আয় উৎসারি কাজে অংশগ্রহণ করতে অর্থের যোগান দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন এনজিওদের সদস্যদের মধ্যে ঋণ দেয়ার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার তহবির করেছে তেমনি দেশের সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন তারা। এতে যারা এসব প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় রেখেছিলেন তারা অর্থ ফেরত পাবেন না। তিনি মনে করেন, এজন্য সমবায় মন্ত্রণালয়সহ সমবায় অধিদফতরকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু সাধারণ ছুটির মধ্যে সরকারী কর্মকর্তারা ঘরে বসে থাকলে, আর অর্থনৈতিক কর্মকা- থেমে গেলে একসময় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য নিজেদের জন্যই যার যার অবস্থান থেকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। জানা গেছে, সমবায় অধিদফতর থেকে নিবন্ধিত দেশের সমবায়গুলো তাদের সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে সঞ্চয় ও আমানত নিয়ে আবার সমিতির সদস্যদের মধ্যেই গাভী পালন, মিল্কভিটার মতো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ঋণ প্রদান করে থাকে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, হকার, ছোট দোকানদার, বস্তিবাসীদের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সঞ্চয় গ্রহণ ও ঋণ কার্যক্রম, ব্যাংকে এফডিআর সবমিলে বছর শেষে যে পরিমাণ মুনাফা হয় তা সমিতির সদস্যদের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিতরণ করা হয়। কিন্তু দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দীর্ঘ এক মাস যাবত সরকারী নির্দেশে প্রায় সবধরনের অফিস বন্ধ রয়েছে। দেশের অধিকাংশ জেলা লকডাউন করা হয়েছে। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে দেশের সমবায় সমিতিগুলোর। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত ঋণকার্যক্রমসহ সকল আর্থিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে সুযোগ সন্ধানী কিছু সদস্য ঋণের কিস্তি, শেয়ার ও সঞ্চয় প্রদান বন্ধ করার সুযোগ চাচ্ছে। এতে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রেডিট ইউনিয়নগুলোর শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কাল্ব’র সাবেক সেক্রেটারি ও দি সেন্টাল এ্যাসোসিয়েশন অব খ্রিস্টান কো-অপারেটিভস লিমিটেডের চেয়ারম্যান নির্মল রোজারিও জানিয়েছেন, দেশের বেশিরভাগ এলাকায় লকডাউন ও সাধারণ ছুটির মধ্যে সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কাজ করতে পারছে না। এতে দেশের সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত আছেন তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। কোন কাজকর্ম না থাকায় আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তারা সময়বায় থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন তা পরিশোধ করতে পারছেন না। অপরদিকে সঞ্চয়ভাঙ্গানোর একটি চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনতে হবে। এনজিওদের মতো তাদেরও ঋণের ব্যবস্থা করলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকবে। সদস্যরা ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারবেন। ক্রেডিট ইউনিয়ন সম্প্রীতির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এমদাদ হোসেন মালেক জানিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয় দেশের সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো। এর সদস্যদের জমানো অর্থ থেকেই তাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ঋণ বিতরণ করা হয়। করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটির মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। সদস্যরাও ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। আবার যারা সঞ্চয় রেখেছিলেন তাদেরও সঞ্চয় ভাঙ্গানোর একটি চাপ রয়েছে। সবমিলে সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো আজ এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সমবায় অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমবায় অধিদফতর থেকে সুনির্দিষ্ট একটি সার্কুলার জারি করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন। বর্তমান সঙ্কটকালীন সময়ে সমবায় উন্নয়ন তহবিল থেকে বিনাসুদে তাদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে সকল সমবায় সমিতির অর্জিত নিট মুনাফার ওপর ২০১৫ সাল হতে আরোপিত ১৫ শতাংশ কর প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি এনজিও ঋণের মতো সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দ পেলে সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকবে। প্রসঙ্গত, সমবায় অধিদফতরের সর্বশেষ এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে সরাসরি ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত সমবায় সমিতির সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। সমিতিগুলোর সঞ্চয় আমানত রয়েছে প্রায় ৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৪৭ কোটি টাকা এবং ঋণ আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। আর সংরক্ষিত তহবিল রয়েছে প্রায় ৯৩০ কোটি টাকা। সমিতিগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অফিসসমূহে সরাসরি চাকরি করেন ৯ লক্ষাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী।
×